মানভূমের ভাষা আন্দোলন

এক পলাশ রাঙা অধ্যায়

সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে চলা ভাষা আন্দোলন
সত্যাগ্রহীদের পদযাত্রা। ছবি: সংগৃহীত

'শুন বিহারী ভাই, তোরা রাখতে লারবি ডাঙ দেখাই

তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি, বাংলা ভাষায় দিলি ছাই৷'

ভাইকে ভুলে করলি বড় বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই

বাঙালী-বিহারী সবই এক ভারতের আপন ভাই

বাঙালীকে মারলি তবু বিষ ছড়ালি—হিন্দী চাই

বাংলা ভাষার পদবীতে ভাই কোন ভেদের কথা নাই।

এক ভারতে ভাইয়ে ভাইয়ে/ মাতৃভাষার রাজ্য চাই।'

এটি একটি টুসু গান। গানের মধ্য দিয়েই যেন উঠে আসছে এক তেজদীপ্ত প্রতিবাদ। এ যেন নিজের মাতৃভাষার জন্য অক্লান্ত তীব্র অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ।

১৯৫৬ সালের ৬ মে। মানভূমের হাজারো সত্যাগ্রহী কলকাতার হাওড়া ব্রিজ অতিক্রম করছেন। ছবি: সংগৃহীত

ভজহরি মাহাতোর রচিত টুসু গানটি গাইতে গাইতে হেঁটে আসছে হাজারো সত্যাগ্রহীর মিছিল। পুরুলিয়ার পুঞ্চার পাকবিকড়া থেকে যখন তারা রওয়ানা দিয়েছিল তখন ছিল ২০ এপ্রিল। টানা ১৭ দিন পায়ে হেঁটে ৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে হাজারো সত্যাগ্রহীর দলটি যখন হাওড়া ব্রিজে এসে পৌঁছালো, সেদিন ৬ মে। লাবণ্যপ্রভা দেবী ও অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে সত্যাগ্রহীরা যখনই ডালহৌসি স্কয়ারে এসে পা রাখলো ঠিক তখনই পুলিশ গ্রেপ্তার করলো তাদের।

তবে ভাষার দাবিতে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ এই লং মার্চ ব্যর্থ হয়নি। ব্যর্থ হয়নি মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনও। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন চলেছে ৪৪ বছর ধরে। ১৯১২ সালে শুরু হওয়া মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলন শেষ হয় ১৯৫৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পুরুলিয়া জেলা সংযুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে।

মানভূমের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৩৩ সালে গঠিত হয় মানভূম জেলা। মানবাজার ছিল মানভূমের সদর। মানভূমের তৎকালীন আয়তন ছিল ৭ হাজার ৮৯৬ মাইল। ১৮৪৫ সালে সর্বপ্রথম মানভূম ভাগ করা হয়। এরপর ১৮৪৬, ১৮৭১ ও ১৮৭৯ সালে ৩ বার ভাগ করা হয়েছিল মানভূমকে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। কিন্তু তখন দেখা দেয় আরেক হঠকারী সিদ্ধান্তের। বাংলাভাষী মানভূম ও ধলভূম জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় বিহার ও উড়িষ্যা রাজ্যে। তখন মানভূমকে বিভক্ত করার প্রতিবাদে মানভূমের বাসিন্দারা আন্দোলনে নামলেও কাজ হয়নি। রদ হয়নি সেই হঠকারী সিদ্ধান্ত। কিন্তু কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে, কখনো ঐক্যবদ্ধভাবে চলছিল আন্দোলন সংগ্রাম।

ভজহরি মাহাতো। ছবি: সংগৃহীত

তৎকালীন সময়ে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ চাপিয়ে দেওয়া হয় মানভূমের জনপদে। একে একে বাংলা স্কুলগুলো বদলে যেতে লাগলো হিন্দি স্কুলে। বাংলাভাষী অধ্যুষিত মানভূমের সব প্রশাসনিক কাজে বাংলার বদলে চাপিয়ে দেওয়া হলো হিন্দি। এ নিয়ে বাংলা ভাষাভাষীরা শত প্রতিবাদ করেও লাভ হয়নি। ১৯২০ সালের জাতীয় কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ পুনর্গঠনের দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়।

১৯৩৫ সালে বিহার ও উড়িষ্যা ভেঙে পৃথক রাজ্য গঠিত হলে কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সভাপতিত্বে গঠিত হয় 'মানভূম বিহারী সমিতি' সংগঠনের। রাজেন্দ্র প্রসাদ বিহারী হওয়ায় হিন্দিভাষীদের স্বার্থ রক্ষার্থেই গঠন করেছিলেন এই সমিতি। যার ফলে মানভূমে চেপে বসে হিন্দির দৌরাত্ম্য। এমতাবস্থায় বাংলার আসন্ন পরিণতি বুঝতে পেরে ব্যারিস্টার পি আর দাসের নেতৃত্বে গঠিত হয় 'মানভূম সমিতি'।

মানভূমে সংখ্যাগুরুই ছিল বাঙালি। ১৯৩১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মানভূমের সদর মহকুমার শতকরা ৮৭ জনই ছিল বাংলাভাষী।

তখন বিহার সরকার আদিবাসী ও উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রাথমিক স্তরের বিদ্যালয় খুলতে শুরু করলে বাঙালিরাও বাংলা স্কুল খুলতে তৎপর হয়ে পড়েন। কারণ বিহার সরকারের খোলা স্কুলের ভাষা ছিল হিন্দি।

তৎকালীন সতীশচন্দ্র সিংহ রাঁচি, পালামৌ, সিংভূম ও মানভূম জেলা নিয়ে ছোটনাগপুর নামে নতুন প্রদেশ গঠন হয় বা বাংলার সঙ্গে পুনরায় সংযুক্তির প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু তা মেনে নেওয়া হয়নি।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা শুরু হয়। এই পরিস্থিতিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু নিরাপত্তার জন্যই ভাষাভিত্তিক কমিশন গঠন করেন।

একই সঙ্গে এই কমিশনের প্রতিবেদন খতিয়ে দেখার জন্য ৩ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও গঠন করা হয়। যেখানে ছিলেন জওহরলাল নেহেরু স্বয়ং, বল্লভভাই প্যাটেল ও পট্টভি সীতারামাইয়া।

১৯৪৮ সাল থেকে বিহার সরকার রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর বাধ্যতামূলক হিন্দি ভাষা পড়ানোর নির্দেশ দেয়। জেলা স্কুলগুলোতে বাংলা বিভাগ বন্ধ করে হিন্দিকে রাজ্যের আনুষ্ঠানিক ভাষা ঘোষণাও দেওয়া হয়।

এ সময় বিক্ষোভে নামেন মানভূমের বাংলাভাষী মানুষ। মানভূমের বাসিন্দারা চেয়েছিলেন তাদের অঞ্চলটিকে যেন পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে একীভূত করে নেওয়া হয়। বিক্ষোভের একপর্যায়ে জেলা কংগ্রেসের মুখপত্র 'মুক্তি' পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়ও প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই সম্পাদকীয়তে মানভূমের বাংলার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও ব্যাপক বিশ্লেষণ করা হয়।

একপর্যায়ে ৩০ এপ্রিল জেলা কমিটির এক অধিবেশনে প্রতিনিধিদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক হয়। অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন অতুলচন্দ্র ঘোষ। মে মাসে মানভূম কি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সংযুক্ত হবে কি না, এ নিয়ে পুরুলিয়ায় জেলা শহরের এক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেই অধিবেশনে মানভূমকে বাংলার সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে ৪৩টি। অন্যদিকে বিপক্ষে ভোট পড়ে ৫৫টি। প্রস্তাবটি খারিজ হওয়া মাত্রই অতুলচন্দ্র ঘোষসহ ৩৭ জন জেলা কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগকারীরা ওই বছরের ১৪ জুন পাকবিড়রা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন 'লোক সেবক সংঘ'।

আন্দোলনের তীব্রতা অনুভব করে বিহার সরকার মানভূমে সব ধরনের মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ করে। কিন্তু তাতে আন্দোলন দমে না গিয়ে আরও যেন আন্দোলনের আগুনে ঘি পড়লো। তীব্র হয়ে উঠলো মানভূমের ভাষা আন্দোলন।

অতুলচন্দ্র ঘোষ। ছবি: সংগৃহীত

১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত মানভূম জেলার সর্বত্র চলেছিল সত্যাগ্রহ আন্দোলন। এই সময়ে আন্দোলন দমনের জন্য বিহার সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। আন্দোলনের প্রধান মুখ অতুলচন্দ্র ঘোষকে বন্দি করে পাঠানো হলো ১৩৫ মাইল দূরের হাজারীবাগ জেলে। আন্দোলনে অংশ নেওয়া হাজারো বাংলাভাষী আন্দোলনকারীকে কারাগারের প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। বিচারাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন রাঘব চর্মকার। বাদ যায়নি বাবুলাল মাহাতো নামের এক জন্মান্ধ বালকও।

তারপরও আন্দোলন থেমে না গিয়ে হয়েছে বেগবান। হাজারো নির্যাতন টলাতে পারেনি আন্দোলনকারীদের। পুরুলিয়া আদালতের আইনজীবী শরৎচন্দ্র সেন, রজনীকান্ত সরকার ও গুণেন্দ্রনাথ রায়ের নেতৃত্বে আদালতে উঠেছে একের পর এক অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াই।

১৯৫২ সালের লোকসভা নির্বাচন করে জয়লাভ করেন লোক সেবক সংঘের ২ প্রার্থী ভজহরি মাহাতো ও চৈতন মাঝি। এ ছাড়া, বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন নির্মলকুমার চট্টোপাধ্যায়, কমলকুমার বসু, মোহিত মৈত্র, তুষার চট্টোপাধ্যায়, হীরেন মুখোপাধ্যায়সহ ৭ প্রার্থী। মানভূমে বাংলা-ভাষাভাষীদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে লোকসভায় ও রাজ্যসভায় ঝড় তুললেন তারা।

মানভূমের লোকগান যখন আন্দোলনের ভাষ্য

আন্দোলনের একপর্যায়ে পুরুলিয়া, সাঁতুরিয়া ও ঝালদায় বিক্ষোভ জনসভায় পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করলে মানভূমের টুসু গানকে কেন্দ্র করে ১৯৫৪ সালের ৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় টুসু সত্যাগ্রহ আন্দোলন।

৯ জানুয়ারি রঘুনাথপুরে হেমচন্দ্র মাহাতোর নেতৃত্বে লোক সেবক সংঘের সদস্যরা শহর পরিক্রমা শুরু করেন। বিহার সরকার নিরাপত্তা আইনের অজুহাতে ৮ আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে। যদিও তারা শেষপর্যন্ত অর্থের বিনিময়ে জামিন পান। ১০ জানুয়ারি ১১ আন্দোলনকারী টুসু গান গাওয়ার সময় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। ১২ জানুয়ারি সরকারি বাধা উড়িয়ে দিয়ে পুরো মানভূমকে মুখরিত করার নির্দেশ দেন অতুলচন্দ্র ঘোষ। এরপরই মানভূমের বিভিন্ন অঞ্চলে টুসু সত্যাগ্রহ ছড়িয়ে পরে।

লাবণ্যপ্রভা ঘোষ। ছবি: সংগৃহীত

মানভূমের লোকগান 'টুসু', 'ভাদু', 'ঝুমুর' হয়ে উঠে আন্দোলনের ভাষ্য। আন্দোলনে সমস্বরে বাজে মধুসূদন মাহাতোর লেখা অমর গান,

'মন মানে না রে হিন্দি সইতে।

ভাষা মোদের হরে নিল হিন্দীতে।।

মাতৃভাষা হরে যদি

আর কি মোদের থাকে রে।

(তাই) মধু বলে মাতৃভাষার

ধ্বজা হবে বহিতে।।'

বিহার সরকার তখন আন্দোলন কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেওয়া শুরু করলে ২২ জানুয়ারি লাবণ্যপ্রভা ঘোষ ও  ভজহরি মাহাতো, ২৫ জানুয়ারি সমরেন্দ্রনাথ ওঝা, কালীরাম মাহাতো ও ভাবিনী দেবী স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেন। টুসু গানের মধ্য দিয়ে সত্যাগ্রহ চলেছিল ৩ ধাপে। ৯ জানুয়ারি থেকে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম, ২০ থকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত দ্বিতীয় এবং ২৭ জানুয়ারি থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলেছিল টুসু সত্যাগ্রহের তৃতীয় পর্যায়ে।

নানা ছন্দে, বর্ণে প্রোথিত মানভূমের লোকগানগুলো হয়ে ওঠে প্রবল জনপ্রিয়। কৃষক, দিনমজুর থেকে শুরু করে সব পেশার  মানুষের গানে প্রকাশ পায় প্রতিবাদের সুর। এর মধ্যেই ফেব্রুয়ারি ও মার্চে টুসু দলের ৪০ সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করেছিল বিহার পুলিশ। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন অতুলচন্দ্র ঘোষ, লাবণ্য প্রভা ঘোষ, ভজহরি মাহাতোসহ অনেকে। ১১ মার্চ পুলিশ মধুপুর গ্রামের লোক সেবক সংঘের অফিস ভাঙচুর করে। বাজেয়াপ্ত করে প্রচুর টুসু গানের বই। এ ছাড়া, ২১ মার্চ সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মানবাজারের পিটিদারী গ্রামে সত্যাগ্রহীদের বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। মানভূমের বাঙালিদের বিরুদ্ধে চালানো হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যাচার ও অপপ্রচার।

পাকবিড়রায় আন্দোলনের আগে শপথ গ্রহণ করছেন সত্যাগ্রহীরা। ছবি: সংগৃহীত

টুসু গানের গীতিকার ও আন্দোলন কর্মী অরুণচন্দ্র ঘোষ যেমন টুসু সংগীতের মধ্য দিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী স্বরে লিখেছিলেন,

আমার বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে।

(ও ভাই) মারবি তোরা কে তারে।।

বাংলা ভাষা রে।।

এই ভাষাতে কাজ চলছে

সাত পুরুষের আমলে।

এই ভাষাতেই মায়ের কোলে

মুখ ফুটেছে মা বলে।।

এই ভাষাতেই পরচা রেকর্ড

এই ভাষাতেই চেক কাটা

এই ভাষাতেই দলিল নথি

সাত পুরুষের হক পাটা।।

দেশের মানুষ ছাড়িস যদি

ভাষার চির অধিকার।

দেশের শাসন অচল হবে

ঘটবে দেশে অনাচার।।

আন্দোলনের মাঝেই ১৯৫৩ সালে গঠিত হয় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন। ১৯৫৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন শুরু করে মানভূমে পর্যবেক্ষণ।

সে বছরের ১০ অক্টোবর কমিশন তার পর্যবেক্ষণের ফলাফল জমা দেয়। পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে মানভূম থেকে ১৯টি থানা নিয়ে নতুন করে পুরুলিয়া নামে একটি জেলা গঠন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। অন্যদিকে ধানবাদের ১০টি থানা ও পুরুলিয়া মহকুমার ২টি থানাকে বিহার রাজ্যে রাখার প্রস্তাবও দেওয়া হয়।

কিন্তু তাতে কিছুটা আপত্তি দেখা গিয়েছিল। কারণ ধমভূম পরগণায় বেশিরভাগ বাংলা-ভাষাভাষী বসবাস করলেও জামসেদপুরে ছিল ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের বসবাস। যার ফলে জামসেদপুরকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করতে চাচ্ছিল না কমিশন। অন্যদিকে জামসেদপুরকে বিহারের সঙ্গে রেখে দিতে হলে ধলভূম পরগণা ভাঙতে হবে। তাও ছিল বেশ ঝক্কির।

এতে খুশি ছিলেন না ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ। তখন বিহারপন্থীরা মানভূমে ধর্মঘটের ডাক দেন। অন্যদিকে ধানবাদ বিহারে যুক্ত হওয়ায় খুশি ছিলেন না বাংলা ভাষাভাষী আন্দোলনকারীরাও।

১৯৫৬ সালের ২৩ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিং পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার নিয়ে পূর্বপ্রদেশ নামের নতুন এক প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে তারা বলেন, প্রদেশের কেন্দ্রীয় ভাষা হবে বাংলা ও হিন্দি। সব এক হলেও উচ্চ আদালত হবে দুটি। এই প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ জানায় কংগ্রেসসহ বাম দলগুলো। শুরু হয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন। কিন্তু এর মাঝেই ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবটি পাশ হয়ে যায়।

২০ এপ্রিল ১৯৫৬। লাবণ্যপ্রভা দেবী ও অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে হাজারো সত্যাগ্রহীর পদযাত্রা শুরু হয় পুরুলিয়ার পুঞ্চা থানার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে। উদ্দেশ কলকাতা। একের পর এক গ্রাম জনপদ পেরিয়ে যায়। সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে যোগ দেন হাজারো জনতা। সবার কণ্ঠে তখন বাংলার প্রতি বাঁধভাঙা আবেগ। মানভূমের টুসু গান ও রবীন্দ্রনাথের অমর 'বাংলার মাটি বাংলার জল' গানে কম্পিত হাজারো সত্যাগ্রহী ও জনতার মিছিল ছোটে কলকাতার দিকে।

টানা ১৭ দিনে ৩০০ কিলোমিটার পদযাত্রা শেষে ৬ মে সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে হাজারো জনতার মিছিল কলকাতায় এসে পৌঁছায়। কলকাতায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গ্রেপ্তার করে সত্যাগ্রহীদের। অন্যদিকে ৭ মে মহাকরণ অবরোধ শেষে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেন ৯৬৫ জন সত্যাগ্রহী। প্রায় ১২ দিন কারাগারে আটক থাকার পরে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।

কিন্তু এরই মধ্যে ৪ মে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ একীভূত হওয়ার প্রস্তাবনা বাতিল হয়ে যায়। ওই বছরের ১ নভেম্বর গঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গের নতুন জেলা পুরুলিয়া। যেখানে কেবলই বাংলা ভাষাভাষীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ৪৪ বছর দীর্ঘস্থায়ী মানভূমের ভাষা আন্দোলন পেয়ে যায় ইতিহাসে ঠাঁই।

সূত্র:

মানভূম জেলার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস (১৯১২-৫৬)/ প্রদীপ কুমার মণ্ডল

১৯৫৬ মানভূম থেকে পুরুলিয়া/ গৌতম দে

লোকভূমি মানভূম/ শ্রমিক সেন

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments