তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্প

জীবিত উদ্ধারে প্রাণপণ চেষ্টা

জীবিত উদ্ধারে প্রাণপণ চেষ্টা
তুরস্কের হাতায়ে ভূমিকম্পের পর একটি ধসে পড়া মসজিদের কাছে পুতুল পড়ে আছে। ছবি: রয়টার্স

ধ্বংসস্তুপ থেকে ভেসে আসছে বাঁচার আকুতি, তাদের কাছে পৌঁছাতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন উদ্ধারকারীরা। তীব্র শীত আর প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে জীবিতদের উদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকাল সকাল থেকে আটকে পড়া ব্যক্তিদের আত্মীয়রা ধ্বংসস্তূপের পাশে অপেক্ষা করছেন। তাদের আশা, স্বজনদের হয়তো জীবিত খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু, তীব্র শীতের কারণে উদ্ধার প্রচেষ্টা কঠিন হয়ে উঠেছে। গৃহহীনদের দুর্দশা বেড়েছে। এছাড়া, কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নেই। ফলে, উদ্ধারকারীরা হিমশিম খাচ্ছেন।

বৃষ্টিতে কাঁদতে কাঁদতে স্থানীয় বাসিন্দা ডেনিজ হতাশায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, 'আটকে পড়ারা আকুতি জানাচ্ছেন, কিন্তু আমরা বিপর্যস্ত। তারা বলছে, 'আমাদের বাঁচাও' কিন্তু আমরা বাঁচাতে পারছি না। আমরা কীভাবে তাদের রক্ষা করব?'

সিরিয়া সীমান্তের কাছে তুরস্কের হাতায় প্রদেশের রাজধানী আনতাকিয়ায় ধ্বংসস্তূপের নিচে এক নারীকে সাহায্যের জন্য ডাকতে শোনা গেছে। রয়টার্সের সাংবাদিকরা কাছেই একটি শিশুর মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন।

মায়ের খোঁজে সোমবার গাজিয়ানটেপ থেকে হাতায়ে রওনা দিয়েছিলেন আয়লা। সেখানে ইস্তাম্বুলের ফায়ারসার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপে কাজ করছিলেন।

তুরস্কের ইসকন্দেরুনে ধসে পড়া হাসপাতালের ধ্বংসস্তূপ থেকে একজনকে উদ্ধার করা হয়। ছবি: রয়টার্স
তুরস্কের ইসকন্দেরুনে ধসে পড়া হাসপাতালের ধ্বংসস্তূপ থেকে একজনকে উদ্ধার করা হয়। ছবি: রয়টার্স

ধ্বংসস্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আয়লা বলেন, 'এখন হয়তো কেউ বেঁচে নেই।'

সিরিয়ার হামা শহরের আবদুল্লাহ আল দাহন রয়টার্সকে বলেন, 'মঙ্গলবার বেশ কয়েকটি পরিবারের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সব দিকেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য। আমাদের সঙ্গে অনেক কিছু ঘটেছে, কিন্তু এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি কখনো দেখিনি।'

সিরিয়ায় যেসব পরিবারের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের জন্য মসজিদগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে।

জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেন, 'এটি এখন সময়ের বিরুদ্ধে উদ্ধারকারীদের লড়াই। একটি মিনিট, একটি ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়া মানে জীবিতদের খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাওয়া।'

তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (এএফএডি) জানিয়েছে, ভূমিকম্পে ৫ হাজার ৭৭৫টি ভবন ধ্বংস হয়েছে এবং ২০ হাজার ৪২৬ জন আহত হয়েছেন।

তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর ইসকেন্দেরুনে মঙ্গলবারও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। হাতায়ের ড্রোন ফুটেজে কয়েক ডজন ধসে পড়া অ্যাপার্টমেন্ট দেখা গেছে। যা ইঙ্গিত দেয়, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা বর্তমান সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে।

জেনেভায় ইউনিসেফের মুখপাত্র জেমস এল্ডার বলেন, 'ভূমিকম্পে... হয়তো হাজারো শিশুর মৃত্যু হয়েছে।'

উত্তর-পশ্চিম সিরিয়া ও তুরস্কে বসবাসরত সিরীয় শরণার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান এল্ডার।

মঙ্গলবার এক ভাষণে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি প্রদেশকে দুর্যোগ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেন এবং ৩ মাসের জন্য ওই অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করেন।

সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত শহর জান্দারিসে ভূমিকম্পের পর ধ্বংসস্তূপের ওপর স্থানীয়রা বসে আছেন। ছবি: রয়টার্স
সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত শহর জান্দারিসে ভূমিকম্পের পর ধ্বংসস্তূপের ওপর স্থানীয়রা বসে আছেন। ছবি: রয়টার্স

৩ মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের মুখোমুখি হতে যাওয়া এরদোয়ান বলেন, সরকার পশ্চিমে পর্যটন কেন্দ্র আনাতালিয়াতে হোটেলগুলো চালু রাখার পরিকল্পনা করেছে। যেন ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের সেখানে অস্থায়ীভাবে রাখা যায়।

এরদোয়ান জানান, তুরস্কে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫৪৯ জনে।

তুর্কি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পশ্চিমে আদানা থেকে পূর্বে দিয়ারবাকির পর্যন্ত প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার (২৮০ মাইল) এবং উত্তরে মালাতিয়া থেকে দক্ষিণে হাতাই পর্যন্ত প্রায় ৩০০ কিলোমিটার এলাকায় ১ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সিরিয়ার কর্তৃপক্ষ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে হামা পর্যন্ত মৃত্যুর খবর জানিয়েছে।

সিরিয়ায় জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, জ্বালানি ঘাটতি এবং প্রতিকূল আবহাওয়া উদ্ধার কাজে বাধা সৃষ্টি করছে। অনেক স্কুল, হাসপাতাল ও অন্যান্য চিকিৎসা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।

জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক এল-মোস্তফা বেনলামলিহ দামেস্ক থেকে রয়টার্সকে বলেন, 'অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মানবিক কাজের জন্য আমরা যে রাস্তাগুলো ব্যবহার করতাম সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তুর্কি শহরগুলোর রাস্তা ও ধসে পড়া ভবন উদ্ধার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে।'

সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সানা জানিয়েছে, সিরিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৮১২ জনে দাঁড়িয়েছে। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নিহতের সংখ্যা ৭৯০ জনেরও বেশি বলে জানিয়েছে সিরিয়ার সিভিল ডিফেন্স, হোয়াইট হেলমেট নামে পরিচিত একটি উদ্ধারকারী সংস্থা।

হোয়াইট হেলমেটের প্রধান রায়েদ আল সালেহ বলেন, 'আমাদের দলগুলো অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা অসংখ্য ধসে পড়া ভবনের সঙ্গে পেরে উঠছেন না।'

তিনি বলেন, 'ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়া শত শত পরিবারকে উদ্ধারের সময় ফুরিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোর জরুরি সহায়তা প্রয়োজন।'

সিরিয়ায় বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সরকার ও একটি উদ্ধারকারী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সেদেশে নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ৬০০ ছাড়িয়েছে।

প্রায় ১২ বছরের গৃহযুদ্ধের পর মানবিক সংকটে জর্জরিত সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ত্রাণ কর্মকর্তারা।

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

2h ago