‘ভালো আছি’

এই বেশ ভালো আছি

'এই বেশ ভালো আছি'-নচিকেতার গানের লাইন মনে পড়ল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য শুনে।

'আমরা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যদের থেকে ভালো আছি, এমনকি অনেক উন্নত দেশের থেকেও ভালো আছি।' গত ২৮ জানুয়ারি তিনি এ কথা বলেছেন। আমরা কীভাবে ভালো আছি, ভালো থাকা বলতে আমরা কী বুঝি? এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পরবর্তী ৫০ বছর জুড়েই বাংলাদেশের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, অবস্থা ভালো হয়েছে। ১৯৮০, ১৯৯০, ২০০০, ২০১০, ২০২০ এবং এখন ২০২৩ সালে এসে যদি পর্যায়ক্রমে হিসাব করা হয়, দেখা যাবে বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে। যা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।

কিছু সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। পুষ্টিমান ও শিশুমৃত্যুর সূচকে ভারত বা পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। সেইসঙ্গে এটাও স্বীকার করা দরকার যে পুষ্টিমান ও শিশুমৃত্যুর বিষয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের সরকারের চেয়ে বেসরকারি সংগঠন, বিশেষ করে ব্র্যাকের বড় অবদান আছে।

বাংলাদেশের এমন অনেক ক্ষেত্রের উন্নয়নে সরকারের চেয়ে বেসরকারি সংগঠনগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

মাথাপিছু আয়ের সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। যদিও মালদ্বীপের অবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশের চেয়ে অনেক বেশি ভালো। বাংলাদেশের কয়েক লাখ শ্রমিক মালদ্বীপে কাজ করেন। মালদ্বীপের সঙ্গে অর্থনৈতিক শক্তির হিসাবে বাংলাদেশে তুলনাই চলে না।

বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা, নেপালের চেয়ে ভালো আছে, পাকিস্তানের চেয়ে তো ভালো আছেই। মাথাপিছু আয়ের হিসাব করলে ভারতের চেয়েও ভালো আছে।

একটি দেশ ও জাতির উন্নতির আরও কিছু সূচকের ধারণা পৃথিবীতে প্রচলিত আছে। তার কয়েকটির দিকে নজর দেওয়া যাক, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন।

যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান বিষয়ক স্বনামধন্য জার্নাল 'নেচার' ২০২২ সালের দেশ ভিত্তিক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। নেচার ইনডেক্সে ভারতের চেয়ে তো বটেই, পাকিস্তান-নেপাল এমনকি শ্রীলংকারও পেছনে বাংলাদেশের অবস্থান। ভারত ১০ম পাকিস্তান ৩৯তম, শ্রীলঙ্কা ৮৬তম, নেপাল ৯১তম আর বাংলাদেশ ১০২তম। পৃথিবীতে যারা গবেষণায় গুরুত্ব দেয় না তারা হয়ত পেট ভরে ভাত খেতে পারার মতো ভালো থাকতে পারে, কিন্তু উন্নত বা এগিয়ে যাওয়া বলতে যা বোঝায়, সেখানে পৌঁছানো অসম্ভব।

উন্নত দেশ তো দূরের কথা, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শিক্ষায় বাংলাদেশ সবচেয়ে কম ব্যয় করে। গত ৩-৪টি বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শিক্ষাখাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ ছিল জিডিপির ২ শতাংশের মতো। ২০২১ সালে ছিল ২.০৯ শতাংশ। গত বাজেটে শিক্ষায় প্রকৃত বরাদ্দ ছিল মাত্র ১.৮৩ শতাংশ।

যেখানে ভারতের ৩.০৮ শতাংশ, পাকিস্তানের ২.৭৬ শতাংশ, আফগানিস্তানের ৩.৯৩ শতাংশ, মালদ্বীপের ৪.২৫ শতাংশ, নেপালের ৫.১০ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার ২.৮১ শতাংশ।

শিক্ষাখাতে গত ২০ বছর ধরেই দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম ব্যয় করে বাংলাদেশ। ইউনেস্কোর নির্দেশনা, শিক্ষাখাতে জিডিপির অন্তত ৪-৬ শতাংশ বরাদ্দ থাকতে হবে। বাংলাদেশে এই প্রস্তাবে রাজিও হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে গত ২০ বছর ধরে ২ শতাংশের আশেপাশেই থাকছে।

শিক্ষার মতো স্বাস্থ্যখাতেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কম ব্যয় করে।

২০২১ সালের মেধা ও জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩৪টি দেশের মধ্যে ১২৩তম। ভারতের অবস্থান ৮৮তম, শ্রীলঙ্কার ৯৩তম, পাকিস্তানের ১০৭তম, নেপালের ১১৩তম। দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ।

আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের পর স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছি। স্লোগান হিসেবে এটা চমৎকার। কিন্তু ডিজিটাল বা স্মার্ট বাংলাদেশে ইন্টারনেটের গতির ২০২১ সালের সূচকে ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৭তম। যেখানে ভারতের অবস্থান ১২৬তম।

ইন্টারনেটের গতিতে নেপালের অবস্থান বাংলাদেশের চেয়ে ভালো, ১১৪তম। মালদ্বীপের অবস্থান ৪০তম, পাকিস্তান ১২০তম। অর্থাৎ, ডিজিটাল বা স্মার্ট বাংলাদেশেও দক্ষিণ এশিয়ার সবার চেয়ে আমরা ইন্টারনেটের গতিতে ভালো নেই। এ কারণে আমাদের ফ্রিল্যান্সাররা কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত সমস্যায় পড়েন।

তাহলে বাংলাদেশ ঠিক কোন জায়গায় ভালো আছে?

বাংলাদেশ ভালো আছে এক্ষেত্রে যে, কৃষক ১৬ বা ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করে। এখানে যেকোনো সরকারের চেয়ে কৃষকের নিজের কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি। কৃষককে সার-বীজ-সেচ সুবিধা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্য অন্য যেকোনো সরকারের চেয়ে বেশি। যদিও এখনও মাত্র ৪০ হাজার টাকা ঋণের জন্যে কৃষককে হাতকড়া পরানো হয়।

পৃথিবীব্যাপী ধান উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইরি)। অবদান আছে বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ব্রি)। গত ৫০ বছরে তারা ১০০ জাতেরও বেশি উচ্চফলনশীল ধান উদ্ভাবন করেছে। ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নাম বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট রাখা হয় স্বাধীনতার পর। নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে তারা সাফল্য পেয়েছে। গবেষণার সাফল্যকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন বাংলাদেশের কৃষক।

বাংলাদেশের ভালো থাকা বা সাফল্য মানে জনগণের সাফল্য। বাংলাদেশের উন্নতির আরেকটি বড় কারণ ১ কোটিরও বেশি প্রবাসী। যাদের অধিকাংশই গেছেন মূলত নিজের চেষ্টায়। তারা একেবারে নিঃস্বার্থভাবে শ্রম দিয়ে দেশে অর্থ পাঠাচ্ছেন।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি বড় খাত পোশাক শিল্প। এই শিল্পের কারখানা মালিকরাও নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। তারা পৃথিবীর এতগুলো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ব্যবসায় টিকে আছেন। কিন্তু, এখানেও সবচেয়ে বড় অবদান বাংলাদেশের গরিব মানুষের। যে কৃষকের সন্তানর প্রবাসী, সেই কৃষকের ছেলে-মেয়েই পোশাক শিল্পের মূল কারিগর। তারা সস্তা শ্রম দিচ্ছেন বলেই কারখানা মালিকরা অর্ডার পাচ্ছেন, ব্যবসা করছেন।

শহরকেন্দ্রীক অবকাঠামো নির্মাণে চাকচিক্য বেড়েছে। যা উন্নয়নের একটা বড় সূচক হিসেবে সরকার দেখাতে চায়। অবশ্যই অবকাঠামো উন্নয়নের সূচক। সঙ্গে এও বিবেচনায় থাকা দরকার অবকাঠামো নিজে উন্নয়ন নয়, অবকাঠামো উন্নয়নের সহায়ক। এবং এই উন্নয়নের সুবিধাভোগী খুব কম সংখ্যক মানুষ। অনেকটা অপরিকল্পিত চাকচিক্যের আড়ালের মানুষের দুঃখ-কষ্টকে চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশে প্রায় ৫ কোটি মানুষই খাদ্য সংকটে আছে। ২ কোটির বেশি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়।

গবেষণা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে তো আমরা পিছিয়ে আছি এবং ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি। শুধু পেট ভরে ভাত খেয়ে ভালো থাকার সূচকেও নেই স্বস্তিদায়ক অবস্থায়।

'ভালো আছি' শুধু রাজনৈতিক বক্তৃতায় নয়, বাস্তবেও থাকারই কথা ছিল। কিন্তু সরকারি নীতি দেশের সব মানুষের ভালো থাকার সহায়ক নয়। বিদেশ থেকে আমাদের গরিব মানুষ ডলার পাঠান, আর বিত্তবানরা সেই ডলার পাচার করেন। সাধারণ মানুষ ব্যাংকে টাকা জমা করেন, আর অল্প কিছু বিত্তবান সেই টাকা ঋণের নামে নিয়ে আর ফেরত দেন না। তারা ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাবান মানুষ।

যার চিহ্নিত হওয়ার কথা শীর্ষ ঋণ খেলাপি হিসেবে, তিনি 'প্রকৃত ঋণ খেলাপি'র নীতি নির্ধারণ করছেন। সরকার গঠিত শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির তদন্ত প্রতিবেদনে যার নাম আসে, তিনি পেয়ে যান অর্থ সামলানোর দায়িত্ব।

ফলে ২০২২ সালের সমীক্ষায়ও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ে, বাড়ে অভুক্ত মানুষের সংখ্যা। 'ভালো আছি' থেকে যায় শুধু গানে, বক্তৃতায় আর শ্লোগানে।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh GDP growth vs employment

Economy expanded 50% in eight years, but jobs grew only 11%

Over the past eight years until fiscal year 2023-24, the country’s economy grew by more than 50 percent, painting a rosy picture of performance by major sectors, while the expansion did not translate into job creation.

12h ago