মৃত্যুর পর জানা গেল পরিচয়, ফিরলেন আপন ঠিকানায়

ফেনীর বাসিন্দাদের কাছে ‘বুলবুল’ ছিলেন প্রতিদিনের পরিচিত মুখ। ছবি: সংগৃহীত

এক বা ২ নয়, একে একে ১৮ বছর কেটেছে। দীর্ঘ এই সময়ে তাকে পাওয়া যেত ফেনী শহরের নানান জায়গায়—কখনো রেল স্টেশন, কখনো শহীদ মিনার, রাজাঝির দীঘিরপাড়, কখনো স্টেশন রোড বা কখনো ব্যস্ততম ট্রাংক রোডে।

লোকটির গায়ে জামা কাপড় ছিল না। বস্তা গায়ে জড়িয়েই শহরের এদিক-ওদিক উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতেন। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা কিছুতেই বাঁধ মানতেন না।

কেউ কিছু খেতে দিলেই কেবল নিতেন। খাবার না পেলে বিরক্ত করতেন না। আগ বাড়িয়ে কিছু বলতেও যেতেন না।

ছোট্ট শহর ফেনীর বাসিন্দাদের কাছে এই 'বুলবুল' ছিলেন প্রতিদিনের পরিচিত মুখ। বাসিন্দাদের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন তিনি। কেউ কেউ তাকে ডাকতেন 'রাষ্ট্রপতি', কেউ ডাকতেন 'চেয়ারম্যান' বা 'মেম্বার' বলে।

শহরের বাসিন্দাদের জানা ছিল না লোকটির আসল পরিচয় কী, কোথা থেকে এসেছেন। জানা যায়নি সুদীর্ঘ ১৮ বছরেও।

গত ২৭ জানুয়ারি ভোররাতে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন 'বুলবুল'। মৃত্যুর পর জানা যায় তার আসল পরিচয়, পাওয়া যায় পরিবারের সন্ধান।

ফেনীর মানুষের কাছে 'বুলবুল' নামে পরিচিত হলেও লোকটির নাম আতাউর রহমান। জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার বড়াইল ইউনিয়নের গাংগাইর গ্রামের মৃত আবদুস সাত্তারের ছেলে তিনি।

আতাউর রহমানের মৃত্যুর পর ফেনীর স্থানীয় সামাজিক সংগঠন 'সহায়'র স্বেচ্ছাসেবকেরা 'বুলবুল'র ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেন। এর কয়েক ঘণ্টা পরই ছবিটি নজরে আসে ঢাকায় থাকা 'বুলবুল'র এক স্বজনের। তখন সেই স্বজন 'বুলবুল'র পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

'বুলবুল'র পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, তিনি ছোটবেলায় মাকে হারান। ১৯৮৮ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তার মানসিক সমস্যার শুরু হয়। দীর্ঘদিন মানসিকভাবে অসুস্থ থাকার পর ২০০৬ সালে বাবার মৃত্যু হলে তিনি পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

হাসপাতালে ‘বুলবুল’। ছবি: মঞ্জিলা মিমি

একপর্যায়ে তিনি বাড়ি থেকে নিখোঁজ হন। পরিবারের সদস্যরা নানাভাবে চেষ্টা করেও তার খোঁজ পাননি।

২০১৮ সালের দিকে তার পরিবারের সদস্যরা জয়পুরহাটের এক রিকশাচালকের মাধ্যমে ফেনীতে 'বুলবুল'র খোঁজ পেয়েছিলেন। তখন তার ভাই ও স্বজনরা 'বুলবুল'কে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেও তিনি রাজি হননি। এসব তথ্য জানতেন না শহরের বাসিন্দারা।

'বুলবুল'র ছোটভাই জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার বড়াইল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মশিউর রহমান লেবু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বুলবুল আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ায় বাবা অন্যত্র বিয়ে করেন। মেট্রিক পরীক্ষায় ফেল করার পর তার মানসিক সমস্যা শুরু হয়। শুরুতে তিনি আত্মীয়দের বাড়িতে গিয়ে থাকতেন।'

'২০০৬ সালে বাবার মৃত্যুর পর হঠাৎ তিনি নিখোঁজ হন। ৭ দিন নিখোঁজ থাকার পর তাকে পার্শ্ববর্তী পাঁচবিবি থানার এক গ্রামে খুঁজে পাই। বাড়ি নিয়ে আসার পর একদিন রাতে জানালা ভেঙে তিনি আবার পালিয়ে যান। এরপর দীর্ঘদিন আমরা তার খোঁজ পাইনি।'

'২০১৮ সালে বাড়ির পাশের এক পরিচিত রিকশাওয়ালার মাধ্যমে তারা জানতে পারি বুলবুল ফেনীতে থাকেন' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'ভাই মানসিকভাবে পুরোপুরি অসুস্থ ছিলেন বলে আমরা তখন তাকে নানাভাবে বুঝিয়েও বাড়ি আনতে পারিনি। জয়পুরহাট থেকে ফেনীর দূরত্ব বেশী হওয়ায় তার খোঁজও রাখতে পারিনি।'

গত ২৭ জানুয়ারি দুপুরে তারা মামাতো ভাইয়ের মাধ্যমে জানতে পারেন 'বুলবুল' ফেনীতে মারা গেছেন।

গতকাল শনিবার রাতে মশিউর রহমান যখন ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন তারা 'বুলবুল'র মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। মশিউর রহমান আরও জানান, আজ রোববার বুলবুলকে তার নিজ বাড়িতে দাফন করা হবে।

সামাজিক সংগঠন 'সহায়'র সভাপতি মঞ্জিলা মিমি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত কয়েকদিন ধরে বুলবুল অসুস্থ ছিলেন। হাসপাতালে যেতে বললেও তিনি যেতে রাজি হতেন না। একপর্যায়ে আমরা তাকে স্থানীয় কমিশনারের সহযোগিতায় ফেনী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করাই। সাধারণত বস্তা পরে থাকলেও আমরা তাকে জোর করে জামাকাপড় পরিয়ে দিই। রাতেই তিনি মারা যান।'

ফেনীতে বুলবুলের জানাজা। ছবি: মঞ্জিলা মিমি

তিনি জানান, বুলবুলের মৃত্যুর পর ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে পরিচয় জানার চেষ্টা চালানো হয়। একপর্যায়ে ঢাকায় থাকা তার এক নিকটাত্মীয়ের চোখে পড়ে পোস্টটি। তখন তিনি তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

'যেহেতু বুলবুল ফেনীর প্রায় সবারই আপন হয়ে গিয়েছিলেন সেহেতু আমরা প্রথমে চেয়েছিলাম এখানেই তার দাফন হোক। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় ফেনীতে তার জানাজা হয়। এরপর স্বজনেরা তার মরদেহ নিয়ে জয়পুরহাটে রওয়ানা দেন,' যোগ করেন মিমি।

ফেনীর মোহাম্মদ সালেহ উদ্দিন ডেইলি স্টারকে, 'তিনি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিশেই গিয়েছিলেন। প্রতিদিন শহরে তাকে দেখা যেত। কাউকে কখনো বিরক্ত করতে দেখিনি। মাঝেমধ্যে টাকা চাইতো, না দিলেও রাগ করতো না। ফেনীর সবাই তাকে চিনতো।'

'মৃত্যুর পরে হলেও তার নাম-পরিচয়-ঠিকানা জানা গেছে তাতেই আমরা খুশি।'

সালেহ উদ্দিনের কথার প্রমাণ মিলে বুলবুলের মৃত্যুর পর ফেসবুকে নানাজনের স্ট্যাটাস ও মন্তব্যে। ফেনীর বাসিন্দা হাবিবুর রহমান লিখেছেন, 'ফেনী জেলার রাষ্ট্রপতি আর নেই, শহ‌রের এক উদ্ভূত চ‌রিত্র হার‌ালো! দেখা হলে আর কখনই হাত বাড়িয়ে বলবে না আছে নাকি ১০ টাকা।'

মোহাম্মদ আরাফাত ফেসবুকে লিখেছেন, 'তাঁকে মেম্বার বা চেয়ারম্যান নামে ডাক‌লে ভীষণ খুশি হতো। আর কখনো দেখতে পাবো না ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যায়।'

'বুলবুল'র স্বজন মাহবুবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মানসিক ভারসাম্যহীন বুলবুলকে ফেনীর মানু‌ষেরা আপন করে নিতে পারলেও আমাদের গ্রামের স্বজন বা এলাকাবাসী কখনো তাকে আপন করে নিতে পারেননি। ফেনী থেকে জোর করে তাকে নিয়ে আসার চেষ্টা করলেও তিনি রাজি হননি। ফেনীতেই থেকেছেন। ফেনীর মানুষদের মাঝেই তার মৃত্যু হয়েছে। মানুষের ভালোবাসার শক্তি যেন আবারও প্রমাণ করলেন ফেনীর বাসিন্দারা।'

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

8h ago