সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল সংসদে পাস
দেশের সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে আজ জাতীয় সংসদে 'সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল–২০২৩' পাস হয়েছে।
কোনো ব্যক্তিকে মাসিক পেনশন–সুবিধা পেতে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিতে হবে।
এ উদ্যোগের প্রশংসা করার পাশাপাশি বিরোধী দলের একাধিক সংসদ সদস্য বলেছেন, এই পেনশন–ব্যবস্থা ব্যাংকের ডিপিএস স্কিমের মতো। জনগণ চাঁদা দেওয়ার পর সরকার কী পরিমাণ অর্থ দেবে, সরকারের অংশগ্রহণ কী হবে, তা আইনে পরিষ্কার নয়। এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও দাবি করেন কেউ কেউ।
বিলের ওপর আনা জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি শেষে আজ মঙ্গলবার বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়।
বিলে বলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় ১৮ বছর বা তার বেশি বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সী সব বাংলাদেশি নাগরিক অংশ নিতে পারবেন। বিশেষ বিবেচনায় পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিদেরও পেনশন স্কিমের আওতায় রাখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে মাসিক পেনশন–সুবিধা পেতে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর চাঁদাদাতাকে ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিতে হবে। ১০ বছর চাঁদা দেওয়া শেষে তিনি যে বয়সে উপনীত হবেন, সে বয়স থেকে আজীবন পেনশন পাবেন। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরাও এতে অংশ নিতে পারবেন।
এ চাঁদার হার কত হবে, তা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। আইন হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটি নির্ধারণ করবে। মাসিক বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা দেওয়া যাবে এবং অগ্রিম ও কিস্তিতেও চাঁদা দেওয়ার সুযোগ থাকবে।
বিলে বলা হয়েছে, চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিলে মাসিক পেনশন পাবেন। চাঁদাদাতার বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভূত মুনাফাসহ জমার বিপরীতে পেনশন দেওয়া হবে। একজন পেনশনার আজীবন পেনশন–সুবিধা পাবেন।
সরকার গেজেট জারি করে বাধ্যতামূলক না করা পর্যন্ত এই পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ হবে ঐচ্ছিক।
বিলে বলা হয়েছে, পেনশনে থাকাকালে কোনো ব্যক্তি ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তার নমিনি অবশিষ্ট সময়ের জন্য (মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে মারা গেলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে।
পেনশন তহবিলে জমা দেওয়া অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন তোলার প্রয়োজন পড়লে চাঁদাদাতা আবেদন করলে জমা দেওয়া অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে তুলতে পারবেন। যা ফিসহ পরিশোধ করতে হবে। পেনশন থেকে পাওয়া অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে।
বিলে বলা হয়েছে, নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা অসচ্ছল চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারবে। বিলে সর্বজনীন পেনশন–পদ্ধতিতে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশ নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের চাঁদার অংশ কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। তবে সরকার সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত সরকারি ও আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা এই পেনশন–ব্যবস্থার আওতাবহির্ভূত থাকবেন।
বিল পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক বলেন, 'বিলের কথাগুলো ভালো। কিন্তু এই পেনশন স্কিমে সরকারের অংশগ্রহণ কী? সরকারের কোনো অংশগ্রহণ নেই। এটা ব্যাংকের ডিপিএস স্কিমের মতো। গুঞ্জন আছে, সরকারের কি টাকার অভাব হয়েছে যে জনগণের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলবে?'
টাকা পাচার, বিদেশে বাংলাদেশিদের বাড়ি কেনাসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করে মুজিবুল হক বলেন, 'অর্থমন্ত্রী কথা কম বলেন। বোবার শত্রু কম। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর কানে কথা পৌঁছায় কি না, জানা নেই। তার কোনো ফিডব্যাক, উদ্যোগ দেখা যায় না।'
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, আপাতদৃষ্টে ভালো। কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেভাবে প্রভিডেন্ট করে, এটি তার বাইরে কিছু বলে মনে হয় না। সরকার কী মুনাফা দেবে, তা পরিষ্কার নয়। তিনিও দাবি করেন, এ বিল সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমানও দাবি করেন, এই বিলের সংবিধানের সঙ্গে মিল নেই।
জাতীয় পাটির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা রাখার মতো। মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখবে আর ব্যাংক দেদার টাকা বিদেশে পাচার করবে। ব্যাংকগুলো মানুষের আস্থা হারিয়েছে। এক ব্যাংকের পরিচালক আরেক ব্যাংক থেকে টাকা নিচ্ছেন। ব্যাংকগুলো বারভূঁইয়াদের কাছে চলে গেছে। সব সুবিধা পাচ্ছেন ঋণখেলাপিরা। এ সময় বিদেশে টাকা পাচার নিয়ে প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, দেখার কেউ নেই। যারা টাকা পাচার করছে, তাদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, বিলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এটি চমৎকার উদ্যোগ। কিন্তু এই পেনশন–ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের সাড়া পাওয়া যাবে না। কারণ, সরকারি চাকরিজীবীরা যেভাবে পেনশন পান, তার সঙ্গে অনেক কিছুই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মানুষ রিটার্ন কীভাবে পাবে, তা পরিষ্কার নয়। এটা অনেকটা ব্যাংকিং প্যাকেজের মতো। এই বিল পাসের আগে সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া উচিত।
সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিলটি আনার আগে অনেক আলোচনা করা হয়েছে। যারা লিখিত মতামত দিয়েছিলেন, তাদের মতামত আমলে নেওয়া হয়েছে। সংসদীয় কমিটিতেও বিলটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বিলটি গ্রহণযোগ্যতা পাবে বিবেচনায় এটি সংসদে আনা হয়েছে।
বিলে একটি জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এই কর্তৃপক্ষে একজন নির্বাহী চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্য থাকবেন। তাদের নিয়োগ করবে সরকার।
বিলে ১৬ সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এর চেয়ারম্যান হবেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, অর্থ বিভাগের সচিব, এনবিআর চেয়ারম্যান, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব; প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব; সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান; এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি; এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি; উইমেন চেম্বাস অব কমার্সের সভাপতি এর সদস্য হবেন। পরিচালনা পর্ষদের সদস্যসচিব হবেন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান।
বিলে বলা হয়েছে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত এক বা একাধিক তফসিলি ব্যাংক জাতীয় পেনশন তহবিলের ব্যাংকার হিসেবে কাজ করবে।
Comments