এই বস্তায় ঘুমিয়ে আছেন একজন মানুষ

কারওয়ান বাজার ও পান্থপথ মোড়ে কয়েকজনকে দেখা যায় প্লাস্টিকের বস্তায় ঢুকে শুধুমাত্র একটি পাটির ওপর শুয়ে আছেন। ছবিটি শুক্রবার ভোররাত ২টায় পান্থপথ মোড় থেকে তোলা। ছবি: সুমন আলী/স্টার

রাত ২টা। বাইরে কনকনে ঠান্ডা। সঙ্গে বইছে বাতাস। রাজধানীর রাস্তা জনশূন্য বললেই চলে। রাস্তায় মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে দূরপাল্লার ২-১টি বাস এবং পণ্যবাহী ট্রাক। পান্থপথ মোড়ে প্লাস্টিকের বস্তায় ঢুকে থাকা নাম পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, তার থাকার কোনো জায়গা নেই। কাজ করতে পারেন না। কেউ কিছু খাবার দিলে খান। আর খাবার না পেলে অনেক সময় না খেয়ে থাকতে হয়।

তিনি জানান, একটি পাতলা কম্বল, প্লাস্টিকের বস্তা আর একটি পাটিই তার সম্বল। খুব ঠান্ডা তাই কম্বল মুড়িয়ে বস্তার ভেতর ঢুকে আছেন। ঠান্ডায় ঘুম আসে না।

এ সময় পান্থপথ মোড়ে দেখা মেলে ছোট্ট এক মেয়ে একজন নারীর সঙ্গে দোকানের সামনে বসে আছে।

একটু কাছে গিয়ে জানা গেল ছোট্ট এই মেয়েটির নাম তারা। বয়স ৬ বছর। বাড়ি বরিশাল। পাশে থাকা নারীটি তার মা। একটি প্লাস্টিকের ওপর মোটা কাপড় বিছানো। সেখানে মা ও মেয়ে পাতলা ২টি কম্বলে জড়িয়ে আছেন। পাশে কিছু ফুল রাখা আছে। মায়ের সঙ্গে সে পান্থপথ এলাকায় ফুল বিক্রি করে।

তীব্র শীতে তারা ও তার মা মাসুদা বেগমের চোখে ঘুম আসছে না। ছবিটি শুক্রবার ভোররাত ২টার দিকে পান্থপথ মোড় থেকে তোলা। ছবি: সুমন আলী/স্টার

বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, পান্থপথ ও গ্রিনরোডে ফুটপাতে অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

এসব এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, কয়েকদিন ধরে তীব্র শীতের কারণে অনেকেই রাতে ঘুমাতে পারছেন না। শীত নিবারণের সম্বল হিসেবে কয়েকজনের কাছে শুধু পাতলা কাপড় দেখা গেছে। যাদের কাছে কম্বল ছিল, সেগুলো অনেক পাতলা। হালকা শীতের জন্য এসব কম্বল উপযোগী হলেও রাজধানীতে গত ২-৩ দিন ধরে যে ঠান্ডা পড়েছে, তাতে এসব কম্বলে শীত নিবারণ হওয়ার কথা না। অনেকেই সারারাত বসে বসে কাটিয়ে দেন। ঘুম আসলে কেউ কেউ আবার বসেই ঘুমান। কারণ নিচ থেকেও ঠান্ডা লাগে।

প্রতিদিন গড়ে ২০০ টাকার মতো আয় হয়। বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। মা ও মেয়ে মিলে বিভিন্ন জনের কাছে খাবার চেয়ে খাই। কেউ দিলে খাই। কখনো বা খাওয়া হয় না। একবারেই কোনো কিছু না পাইলে ২০-৩০ টাকার খাবার হোটেল থেকে কিনে খাই। অনেক রাত কাটে না খেয়ে। ক্ষুধার জ্বালায় ঘুমও আসে না। এখন আবার অনেক শীত। খুব কষ্টে আছি।

ফুটপাতে মেয়েকে নিয়ে রাত কাটানো মাসুদা বেগম

এত রাতে ঘুমাওনি কেন, প্রশ্ন করতেই তারা বলে, 'ঘুম আসে না।' কেন ঘুম আসে না জানতে চাইলে বলে, 'অনেক শীত লাগে।' বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, 'মারা গেছে।'

ফুটপাতে থাকা লোকদের বিভিন্ন সময় কম্বল দিতে শোনা যায়। তারা পেয়েছে কি না, জানতে চাইলে বলে, '১টা পাইছি।'

সেসময় পাশে বসে থাকা তারার মা মাসুদা বেগম (৫০) দেখান যে কম্বলটি তারা পেয়েছে। কম্বলটি অনেক পাতলা।

মাসুদা বেগমের ছেলে-মেয়ে ৪ জন। ৩ মেয়ে ১ ছেলে। করোনার প্রথম লকডাউনের সময় স্বামী মারা গেছেন। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বরিশালে ছেলেকে নিয়ে তার আরেক মেয়ে থাকেন। ছেলেটির বয়স ৭ বছর। মায়ের সঙ্গেই পান্থপথ এলাকায় থাকত সে। অন্যদের পাল্লায় পড়ে ডান্ডি খেয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। পরে ছেলেকে বরিশালে এক মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিয়েছে। ফুল বিক্রি করে তাদের টাকা পাঠান মাসুদা।

শুভ রাতে ঘুমানোর জন্য প্লাস্টিকের ওপর একটি কাপড় বিছিয়ে তৈরি করেছে বিছানা। গায়ে দেওয়ার জন্য সঙ্গে আছে একটা লুঙ্গি। ছবি: সুমন আলী/স্টার

মাসুদা বলেন, 'প্রতিদিন গড়ে ২০০ টাকার মতো আয় হয়। বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। মা ও মেয়ে মিলে বিভিন্ন জনের কাছে খাবার চেয়ে খাই। কেউ দিলে খাই। কখনো বা খাওয়া হয় না। একবারেই কোনো কিছু না পাইলে ২০-৩০ টাকার খাবার হোটেল থেকে কিনে খাই। অনেক রাত কাটে না খেয়ে। ক্ষুধার জ্বালায় ঘুমও আসে না। এখন আবার অনেক শীত। খুব কষ্টে আছি।'

রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় কথা হয় শুভর সঙ্গে। বয়স আনুমানিক ১৫-১৬ বছর। শুভ ৩ বছর ধরে সেখানেই থাকে। বাড়ি মানিকগঞ্জ। ৩ বছর আগে মা মারা যাওয়ার পর বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে সে। বাবা অন্য জায়গায় বিয়ে করে সংসার করছে। সৎ মায়ের কারণে সে বাড়ি যায় না শুভ। ৩ বছর ধরে কেউ তার খোঁজও নেয় না। কথা বলার সময় ঠান্ডায় কাঁপছিল শুভ। প্লাস্টিকের ওপর একটি কাপড় বিছিয়ে তৈরি করেছে বিছানা। মাথায় দেওয়ার জন্য রাখা আছে পায়ের জুতা। গায়ে দেওয়ার জন্য সঙ্গে আছে একটা লুঙ্গি।

এই লুঙ্গি গায়ে দিয়ে শীত নিবারণ হয় কি না, জানতে চাইলে শুভ বলে, 'আর কিছু নেই। গত বছর একটা কম্বল পাইছিলাম। চুরি হয়ে গেছে। এই বছর এখনো পাইনি। ঠান্ডায় ঘুম আসে না। এভাবেই থাকি।'

খাও কীভাবে, জানতে চাইলে শুভ বলে, 'মানুষের কাছে চেয়ে খাই। কেউ দেয়, কেউ দেয় না। কখনো কখনো প্লাস্টিক টোকাই। আজকে সারাদিন কিছু খাইনি। ক্ষুধা আর ঠান্ডায় ঘুম আসছে না।'

মোহাম্মদ মহসিন (৪০) প্রায় ১৪ বছর ধরে রাস্তায় থাকেন। তার গল্পটা একটু ভিন্ন। বাড়ি জামালপুরে। ব্র্যাক স্কুলে পড়ার সময় এক মেয়ের সঙ্গে তার প্রেম হয়। সেই মেয়েটির নাম এখনো তার হাতে লেখা আছে। মেয়েটির নাম সুমি (ছদ্মনাম)। দুজনে শপথ করেছিল কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না। ১৪ বছর বয়সে বাড়ি থেকে সুমিকে নিয়ে ঢাকায় পালিয়ে আসে মহসিন। কাজ নেন গার্মেন্টসে। পরবর্তীতে সুমির খালা তাকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেন। মহসিন সুমির সঙ্গে দেখা করেন। বিয়েতে সুমির মত ছিল কি না, জানতে চান। সুমি জানান, তার মত ছিল। তারপর থেকে রাস্তায় রাস্তায় থাকা শুরু করেন মহসিন।

কারওয়ান বাজারে সড়কের পাশে নিচে পত্রিকা বিছিয়ে পাতলা কম্বল গায়ে শুয়ে আছেন একজন। ছবি: সুমন আলী/স্টার

মহসিন ২ মাস ধরে কারওয়ান বাজার এলাকায় থাকেন জাহিদের সঙ্গে। মহসিনের বিছানা, কম্বল কিছুই নেই। জাহিদের বিছানা ও কম্বলের নিচে ঘুমান মহসিন। সেসময় দেখা যায় তাদের কাছে পাতলা ২টি কম্বল। জাহিদের বয়সও ৪০ বছরের ওপরে। মাকে হারিয়ে ২০১৪ সাল থেকে রাস্তায় রাস্তায় থাকেন জাহিদ। তিনি একটি চায়ের হোটেলে কাজ করেন।

জাহিদ বলেন, 'আমি যে টাকা পাই, তা দিয়ে কোনো একটা বস্তিতে থাকতে পারবো। কিন্তু আমার ঘর ভালো লাগে না। তাই পথেই ঘুমাই। এ বছর ২টা কম্বল পাইছি। এগুলো অনেক পাতলা, তাই একটু কষ্ট হয়। কয়েকদিন ধরে শীত বেশি। নাহলে তেমন একটা সমস্যা হতো না।'

যারা ফুটপাতে থাকেন, তাদের গল্পগুলো কমবেশি এমনই। কেউ সর্বস্ব হারিয়ে কেউবা আপনজন হারিয়ে ফুটপাতে বাস করছেন। যারা ফুটপাতে থাকছেন, তাদের অনেকেই খেয়ে না খেয়ে এভাবে দিন কাটাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে তীব্র শীত যেন তাদের দুর্দশাকে আর কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda departs for London

The air ambulance ferrying the former prime minister departed from Hazrat Shahjalal International Airport at 11:47pm

6h ago