শিশুকিশোর

আর্জেন্টিনা কেমন দেশ

ম্যারাডোনা, লিওনেল মেসি
করোনার সময় আর্জেন্টিানর রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সের দৃশ্য। ফাইল ছবি, এএফপি

তোমরা নিশ্চয়ই জানো, আমাদের দেশের মানুষের কাছে আর্জেন্টিনা খুব পরিচিত একটি নাম। তার অন্যতম কারণ ফুটবল। ফুটবল দিয়েই এ দেশের মানুষ আর্জেন্টিনাকে চিনেছে।

আর আর্জেন্টিনা মানেই ম্যারাডোনা। তিনি ছিলেন হ্যমিলনের বাঁশিওয়ালার মতো। তার খেলা দেখে শুধু বাংলাদেশ না বিশ্বের ফুটবল ভক্তরা আর্জেন্টিনার খেলার ভক্ত হয়েছিলেন। আর এখন আর্জেন্টিনা দলে আছেন সময়ের আরেক সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি। তার নেতৃত্বে সর্বশেষ ফুটবল বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আর্জেন্টিনা। এ নিয়ে মোট ৩ বার বিশ্বকাপ শিরোপা জিতলো আর্জেন্টিনা, যথাক্রমে- ১৯৭৮, ১৯৮৬, ২০২২।

তোমরা আর্জেন্টিনার নাম জানো, ম্যারাডোনার কথা জানো, মেসির কথাও জানো। কিন্তু, আর্জেন্টিনা দেশ সম্পর্কে কতটুকু জানো? এখানে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো।

অবস্থান

আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ অংশে অবস্থিত একটি বড় দেশ। বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশে এটি এবং ব্রাজিলের পরে দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। দেশটি আন্দিজ পর্বতমালা এবং পশ্চিমে চিলি দ্বারা বেষ্টিত।

আন্দিজের পূর্ব দিকে আর্জেন্টিনার অভ্যন্তর সমতল এবং উর্বর তৃণভূমি, যাকে পাম্পাস বলা হয়। দেশের পূর্ব সীমান্ত হলো আটলান্টিক মহাসাগর। এর উত্তর-পশ্চিমে বলিভিয়া এবং উত্তরে প্যারাগুয়ে অবস্থিত। আন্দিজের উচ্চ পর্বত শৃঙ্গ আন্দিজ কর্ডিলেরা চিলির সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে ৩ হাজার ১৯৫ মাইল (৫ হাজার ১৪১.৯ কিলোমিটার) সীমানা তৈরি করেছে।

আর্জেন্টিনা দেশটি ৪টি অঞ্চলে বিভক্ত- আন্দিজ, উত্তর, পাম্পাস এবং প্যাটাগোনিয়া। পাম্পাসগুলো মূলত উর্বর কৃষি অঞ্চল।

মানুষ ও সংস্কৃতি

আর্জেন্টিনায় তুলনামূলকভাবে স্থানীয় বা আদিবাসী মানুষের সংখ্যা কম। এর জনসংখ্যার বড় একটি অংশ ইউরোপ থেকে এসেছে। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৯৫ শতাংশ প্রায় ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত। যাদের বেশিরভাগই ইতালি, স্পেন এবং জার্মানি থেকে এসেছেন।

আর্জেন্টিনার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক বুয়েনস আয়ার্সের আশেপাশের অঞ্চলে বাস করে। ইউরোপীয় প্রভাবের কারণে বুয়েনস আয়ার্সকে 'দক্ষিণ আমেরিকার প্যারিস' বলা হয়। জনসংখ্যার বেশিরভাগ মানুষ শিক্ষিত এবং ৯৭ শতাংশ পড়তে ও লিখতে পারে। ফুটবল আর্জেন্টিনার সবচেয়ে প্রিয় খেলা।

প্রকৃতি

আর্জেন্টিনা প্রাণী প্রজাতিতে সমৃদ্ধ একটি দেশ। প্যাটাগোনিয়া উপকূলে এলিফ্যান্ট সিল, ফার সিলস, পেঙ্গুইন এবং সি লায়নসের আবাসস্থল। আটলান্টিকের পানি হাঙর, অর্কাস, ডলফিন ও স্যামনের আবাসস্থল।

উত্তরে, বনবিড়াল, জাগুয়ার এবং ওসেলটের মতো বড় বড় প্রজাতির বিড়ালের আবাস। এছাড়াও আছে কুমির ও কাইমান। উপক্রান্তীয় উত্তরে বাস করে ফ্লেমিংগো, টুকান, কচ্ছপ।

প্যাটাগোনিয়া প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বন্যপ্রাণী সমৃদ্ধ এলাকা। এখানকার প্রাণীদের মধ্যে আছে হেরন, কনডোর, পুমা, কচ্ছপ এবং গুয়ানাকোস।

আন্দিজ পর্বতমালার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হল আকনকাগুয়া। এটি ২২ হাজার ৩৮৪ ফুট (৬ হাজার ৯৬০ মিটার) উচ্চতায় অবস্থিত। উত্তর-পূর্ব আর্জেন্টিনায় রেইন ফরেস্ট এবং ইগুয়াজো জলপ্রপাত আছে। ব্রাজিলের সঙ্গে আর্জেন্টিনার সীমান্তে এই দর্শনীয় জলপ্রপাত ১.৬ মাইল (২.৭ কিলোমিটার) নেমে এসেছে। তবে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় দেশটির বন উজাড় হচ্ছে এবং দূষণের কবলে পড়ছে।

সরকার ও অর্থনীতি

আর্জেন্টিনা একটি ফেডারেল প্রজাতন্ত্র। দেশটিতে বহু বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতার পর কয়েকজন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।

জাতীয় কংগ্রেস সিনেটে ৭২টি আসন এবং ২৫৭টি আসন নিয়ে চেম্বার অব ডেপুটিজ গঠিত। সুপ্রিম কোর্টে ৭ জন বিচারপতি থাকলেও আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সেই সংখ্যা কমে ৫ জনে দাঁড়াবে। বিচারকদের বাছাই করেন প্রেসিডেন্ট। তবে, সিনেটকে অবশ্যই সেই নিয়োগের অনুমোদন দিতে হয়।

ভেড়া পালন, তেল, খনি, কৃষি, এবং পর্যটন দেশটির আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস।

ইতিহাস

স্প্যানিশরা ১৫১৬ সালে আর্জেন্টিনা আসেন। তারা ৩০০ বছর ধরে দেশটি শাসন করেন। ১৮০৬ সালে একদল ব্রিটিশ বাহিনী বুয়েনস আয়ার্সে স্পেনের সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করে। এরপর ব্রিটিশ বাহিনী মালভিনাস দ্বীপপুঞ্জ আক্রমণ করে, যা ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ নামেও পরিচিত। পরে স্থানীয়রা রাজধানী পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু, দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়নি। এসব ঘটনা আর্জেন্টিনার ওপর ধীরে ধীরে স্পেনের কর্তৃত্ব কমায়।

১৮১০ সালে নেপোলিয়ন বাহিনী স্পেনের দখলে থাকা প্রধান শহরগুলো জয় করে এবং আর্জেন্টিনার মানুষকে দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়। এরপর ১৮১৬ সালে আর্জেন্টিনা স্বাধীনতা লাভ করে।

১৯৪৬ সালে জোয়ান পেরোন তার জনপ্রিয়তার কারণে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হন। তিনি দেশটির শ্রমিক শ্রেণির মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম ছিল ইভা, যিনি দেশটির মানুষের কাছে এভিটা নামে পরিচিত ছিলেন। ইভা আর্জেন্টিনার দরিদ্র মানুষকে নগদ অর্থ ও সুবিধা দিতে একটি ফাউন্ডেশন গঠন করেন। ১৯৫২ সালে ক্যান্সারে তার মৃত্যু হলে সারাদেশের মানুষ শোকে ভেঙে পড়েন। তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনার দরিদ্র মানুষের কাছে আশার প্রতীক। পরে জোয়ান পেরোনকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। কিন্তু, তিনি ক্ষমতা ছাড়ার পরও তার অনুসারীরা লড়াই চালিয়ে যান।

এরপর অনেক বছর ধরে সহিংসতা ও গৃহযুদ্ধের দিকে জড়িয়ে পড়ে দেশটি। তখন পেরোন পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী ইসাবেল ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। পেরোনের হঠাৎ মৃত্যুতে ইসাবেল প্রেসিডেন্ট হন। এর পরপরই দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।

১৯৭৬ সালে দেশটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে সেনাবাহিনী। তখন দেশটি মারাত্মক সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে, যাকে 'ডার্টি ওয়ার' বলা হয়। তখন ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজারের মতো বিপ্লবী বা সমর্থককে হত্যা করা হয়।

১৯৮২ সালে, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জেনারেল লিওপোলডো গ্যালটিয়েরি আটলান্টিক মহাসাগরীয় উপকূলে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ আক্রমণ করেন। তিনি ভেবেছিলেন ব্রিটিশরা হয়তো তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে না। কিন্তু, গ্যালটিয়েরির ধারণা ভুল ছিল এবং ব্রিটিশ বাহিনী সহজ জয় পেয়েছিল। ওই পরাজয়ের পর আর্জেন্টিনা গণতন্ত্র ও বেসামরিক শাসনের দিকে এগিয়ে যায়।

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka airport receives 2nd bomb threat

Operations at HSIA continue amid heightened security

2h ago