বাজার খরচ কমাতে কমাতেই বছর গেল

বাজার খরচ
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সবজি বাজার। ছবি: সুমন আলী/স্টার

এই বছরের শুরুতেও সকালের নাস্তার সময় বিলের পরিমাণ নিয়ে ভাবতেন না মনিরুল ইসলাম। দুপুরে মন চাইলেই বিফ খিচুরি বা মোরগ পোলাও খেতেন। কিন্তু, এখন তিনি বিলের পরিমাণ নিয়ে ভাবেন। চলতি বছরে তার ব্যয় যেভাবে বেড়েছে আয় সে হারে বাড়েনি।

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করেন মনিরুল ইসলাম। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বছরটা বাজার খরচ কমাতে কমাতেই পার হলো। আমার আয় নির্দিষ্ট। প্রথম ধাপে খাবার ও পরে জামা-কাপড়ের বেলাতেও কস্ট কাটিং করেছি।'

তিনি জানান, অসুস্থতা ও জীবনযাত্রায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় উপায় না পেয়ে তার ডিপোজিট পেনশন স্কিমটি ম্যাচিউর হওয়ার আগেই চলতি বছরের মাঝামাঝি ভেঙেছেন।

নতুন বছরে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাবেন মনিরুল। এক বছর আগে ছেলের স্কুলের খরচ নিয়ে তিনি যে পরিকল্পনা করেছিলেন তা এখন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বিষয়টা তাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে বলেও জানান তিনি।

শুধু মনিরুল নন, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে দেশের অনেককেই এই ধরনের পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন।

করোনা মহামারির সংকট কাটিয়ে চলতি বছরের শুরুর দিকে যখন জীবনে অনেকটা স্বস্তি ফিরেছিল ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় পণ্য সরবরাহে বাধা পড়ে। বিশ্বব্যাপী ডলারের দাম বেড়ে যায়। বিপরীতে অন্যান্য দেশের মুদ্রার দরপতন হয়। এসব কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে খরচ মেটাতে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বাজারে চাল, ডাল, তেল ও চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম ব্যাপক হারে বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে সাবান, টুথপেস্ট, প্রসাধন, টিস্যুসহ সংসারে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর পরিবহন ভাড়া বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ।

বাজার খরচ
বাজারে শীতের সবজির দাম অন্যান্য বছরের তুলনায় কেজিপ্রতি বেড়েছে। ছবি: সুমন আলী/স্টার

২০২১ সালে করোনার কারণে অনেক বাড়িওয়ালা বাসাভাড়া না বাড়লেও এই বছর অনেকে ভাড়া বাড়িয়েছেন। স্কুল-কলেজের বেতনের পাশাপাশি বেড়েছে খাতা-কলমের দামও।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবে গত ২০ ডিসেম্বরের বাজারদর অনুযায়ী গত এক বছরে চালের দাম ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, খোলা আটা ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ, সয়াবিন তেল ২৩ শতাংশ, মসুর ডাল ২৫ শতাংশ, গুড়া দুধ ৩০-৪২ শতাংশ, চিনি ৪৫ দশমিক ১৬ শতাংশ, লবণ ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ ও ডিমের দাম ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেড়েছে।

টিসিবির তথ্য বলছে, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, আদা, জিরা, তেজপাতা, মুগডাল, অ্যাংকার ডাল, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ ও ধনিয়ারও দাম বেড়েছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শীতের সবজির দাম অন্যান্য বছরের তুলনায় কেজিপ্রতি কিছুটা বেড়েছে।

কাঁচাবাজারে মাছ, মাংস ও সবজির দাম নিয়মিত ওঠানামা করে। তবে গত এক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, ফার্মে উৎপাদিত মুরগির দাম বছরজুড়েই বেশি থাকছে। ব্রয়লার মুরগির দাম এখন বছরের বেশির ভাগ সময় প্রতি কেজি ১৫০ টাকার বেশি থাকে।

করোনার আগেও এর দর ১৩০ টাকার আশপাশে থাকত। বিক্রেতাদের দাবি, মুরগির বাচ্চা, খাবারের দাম ও পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। তাই আর আগের দামে ফেরার আশা কম।

রাজধানীর নিউমার্কেটে কাঁচাবাজার করতে আসা আকরাম হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্বামী-স্ত্রী, ২ সন্তানের সংসার। খাওয়া বাবদ প্রতি মাসে সর্বোচ্চ খরচ ১০ হাজার টাকা। পাঙ্গাস মাছ আগে কখনো খাইনি। খরচ বাঁচাতে গত ৪ মাসে বহুবার পাঙ্গাস খেয়েছি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তেলাপিয়াও।'

তিনি আরও বলেন, 'গত এক মাসে একবারও মাংস কিনিনি। মাংস কিনতে গেলে অন্যান্য জিনিস কেনা কঠিন। গত ৩ মাসে আত্মীয়দের কাছ থেকে ৫টি অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেয়েছি। এর মধ্যে ৪টিতে যাইনি।'

দেশে দফায় দফায় অনেক পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি। সরকারের পক্ষ থেকে এই যুক্তি বারবার তুলে ধরা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি জাহাজভাড়া বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমায় আমদানি খরচ বেড়েছে।

প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় গত কয়েক মাস ধরে অনেকেই খাদ্য অধিদপ্তরের ওএমএস কর্মসূচির আওতায় বিক্রি করা চাল ও আটা কিনতে লাইনে দাঁড়াতে দেখা গেছে।

করোনার আগে খাদ্য অধিদপ্তরের ট্রাকের পেছনে ভিড় দেখা যেত না। এমনকি ২০২০ ও ২০২১ সালেও মানুষের এতটা ভিড় দেখা যায়নি।

পান্থপথ স্পটে লাইনে দাঁড়ানো মোশাররফ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে সংসার ঠিকভাবে চালানো যাচ্ছে না। সপ্তাহে ২ দিন পণ্য কেনার জন্য ভোরবেলা এসে লাইনে দাঁড়াই। গত ৩ মাস ধরে এখান থেকে চাল ও আটা কিনি।'

বাজার খরচ
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে শীতের সবজি। ছবি: সুমন আলী/স্টার

জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ায় গত ১১ মাসে টাকা সঞ্চয় করতে পারেননি চট্টগ্রামের ষোলশহরের রহমান নগরের বাসিন্দা ও দেশে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাইভেট ফার্মাসিটিউক্যাল কোম্পানিতে চাকরি করা চন্দন দেবনাথ।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সংসারের খরচ কমানোর জন্য গত ১১ মাসের মধ্যে ৪ মাস ঋণ করতে হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমার মেয়ের বয়স প্রায় ১৫ মাস। তার জন্য সেভিংস করতে না পরায় আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। মেয়ের বেড়ে উঠার এই সময়টাতে একটা বড় ফ্লাট ভাড়া নেব বলে ভেবেছিলাম। সেই পরিকল্পনা বাদ দিয়েছি।'

'স্ত্রী, সন্তান ও মায়ের অনেক ইচ্ছা এখন আর পূরণ করতে পারি না। যতই দিন যাচ্ছে ততই আমি হতাশ হয়ে পড়ছি,' যোগ করেন দেবনাথ।

গত নভেম্বরে প্রকাশিত বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বেশির ভাগ মানুষের সংসার চালানোর খরচ বেড়ে গেছে। বিপরীতে একটি বড় অংশের মানুষের আয় কমেছে।

রাজধানীর ফার্মগেটে গত ২০ নভেম্বর কথা হয় ভ্রাম্যমান চা বিক্রেতা নাজের আলীর সঙ্গে। তিনি ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি দুপুর ২টা পর্যন্ত একটি ফ্যাক্টরিতে ১০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চা বিক্রি করেন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ২ মাস ধরে বেতন পাচ্ছি ৮ হাজার টাকা। বছরের শুরুতেও দৈনিক ৪০০-৫০০ টাকা চা বিক্রি করতাম। এখন ৩০০ টাকার চা বিক্রি করাই বেশ কঠিন। কোনো কোনো দিন ২০০ টাকারও বিক্রি করতে পারি না।'

নাজের আলী বলেন, 'মেয়ে শীতের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাবে। সে নতুন জামা চেয়েছিল। কিনে দিতে পারিনি। বিষয়টা আমার জন্য ভীষণ কষ্টের।'

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছরটা ভোক্তারা বেশ সংকটের মধ্য দিয়ে পার করছেন। এটা তাদের জন্য মন্দের বছর। কোনোদিক থেকেই তারা সুখী ছিলেন না।'

তিনি আরও বলেন, 'মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের অনেকের আয় কমে যাওয়ায় তাদের জীবনে নানা দিক থেকে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।'

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০২২ সালে এসেনশিয়াল পণ্যগুলোর দাম স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। এই সমস্যা সমাধানে সরকারের দিক থেকে ইতিবাচক সীমিত উদ্যোগ নেওয়া হলেও খুব একটা সুফল আসেনি।'

তিনি আরও বলেন, 'কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই উদ্যোগগুলোর সুফল যাদের পাওয়ার কথা তারা না পেয়ে অন্যরা পেয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে।'

'সাধারণ ভোক্তাদের এই বছর যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, তার জের ২০২৩ সালেও থাকার ইঙ্গিত আছে,' যোগ করেন মোয়াজ্জেম।

Comments

The Daily Star  | English

Uncovering the silent deaths of migrant women

In the shadows of booming remittance flows and the quiet resilience of Bangladesh’s labour diaspora, a disturbing reality persists: numerous Bangladeshi female migrant workers, particularly those employed as domestic help in Gulf countries, are returning home in coffins.

18h ago