অপারেশন কিলো ফ্লাইট: মুক্তিযুদ্ধের দুঃসাহসী বিমান অপারেশন
অপারেশন কিলো ফ্লাইট। এই নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তিবাহিনীর বিমান উইং এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্ম ও গোড়াপত্তনের ইতিহাস। ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত এক বিমানঘাঁটিতে জন্ম হয়েছিল যে ইতিহাসের, সেই ইতিহাস শত্রুর চোখে চোখ রেখে লড়াইয়ের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়।
অপারেশন কিলো ফ্লাইট মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অপারেশনগুলোর সমন্বিত সাংকেতিক নাম। এই কিলো ফ্লাইটের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন দুঃসাহসিক বিমান যোদ্ধারা। ফলে ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ সম্ভাবনাটিও চিরতরে হারিয়ে ফেলেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
যেভাবে এসেছিল অপারেশন কিলো ফ্লাইটের ভাবনা
মুক্তিযুদ্ধের মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই মুক্তিবাহিনীর বিমান উইং গঠনের জন্য প্রথমবারের মতো পরিকল্পনা করা হয়েছিল। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের আগরতলায় চলে যান পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বেশ কয়েকজন বাঙালি অফিসার। উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধে যোগদান। এই অফিসারদের মধ্যে ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খন্দকার, উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার, স্কোয়াড্রন লীডার এম সদর উদ্দিন, ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম।
আগরতলায় পৌঁছানোর পর ভারত সরকারের উদ্যোগে এই অফিসারদের নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লিতে। ২০ মে দিল্লিতে ভারতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। বৈঠক শেষে কলকাতায় চলে যান। সেখানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। এ সময় তিনি বিমান উইং গঠনের জন্য বিমানের বন্দোবস্তের জন্য অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, যেহেতু বাঙালি অফিসারেরা আছেন সুতরাং তারাই বিমান ব্যবহারে সক্ষম।
ফ্লাইং অফিসার (বর্তমানে স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) বদরুল আলম, বীর উত্তম ছিলেন সেই বৈঠকে।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন,'বৈঠকে এ কে খন্দকার সাহেব বিমান উইং গঠনের জন্য তাজউদ্দীন আহমেদকে বিমান জোগাড়ের জন্য অনুরোধ করেন। তাজউদ্দীন আহমেদ দেখলেন, যুদ্ধে বিমান অত্যাবশ্যক। তাই তিনি এবং খন্দকার সাহেব ২ জনই ভারত সরকারের কাছে বিমান সহায়তা চাইতে থাকেন। প্রাথমিকভাবে যখন দেখা গেল বিমান উইং গঠন করতে দেরি হবে, তখন বিমানবাহিনীর অফিসারদের বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধের জন্য পাঠানো হলো। আমাকে দেওয়া হলো স্টাফ অফিসারের দায়িত্ব। খন্দকার সাহেব হলেন মুক্তিবাহিনীর ডিপুটি চিফ অফ স্টাফ।'
অপারেশন কিলো ফ্লাইটের সঙ্গে শুরু থেকেই সংযুক্ত ছিলেন ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার, বীর প্রতীক।
তিনি বলেন, 'বিমানবাহিনীর অফিসাররা ফিরে আসার পরপরই আমাদের কয়েকজন বেসামরিক পাইলটকে আগরতলা থেকে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লিতে। সেখানে আমি ছাড়াও ছিলাম ক্যাপ্টেন সাহাব, ক্যাপ্টেন আকরাম, ক্যাপ্টেন শরফুদ্দীন, ক্যাপ্টেন খালেকসহ বেশ কয়েকজন পাইলট। আমাদের সঙ্গে তখন ফ্লাইং লাইসেন্স ও জরুরি প্রমাণপত্র না থাকায় ওরা আমাদের নজরবন্দী করে রেখেছিল। পরে যখন প্রমাণ হলো, তখন ওরা আমাদের চাহিদা সম্পর্কে জানতে চাইল।
পত্রিকার কল্যাণে আমরা ততদিনে বায়াফ্রার যুদ্ধে সুইডিশ পাইলট গুস্তাভ রজেনের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। তিনি ছোট একটি প্লেনে রকেট সংযোজন করে রাতের আঁধারেই নাইজেরিয়ার বিমান ঘাঁটিতে থাকা ৯টি মিগ-১৭ ধ্বংস করেছিলেন। আমরা বললাম, আমাদেরও যদি এমন বিমান দেওয়া হতো তাহলে আমরা এমন বীরত্ব প্রদর্শন করতে পারতাম। তারা ভেবে দেখবেন বলে জানালেন।'
জুলাই মাসের শেষের দিকে তাজউদ্দীন আহমদের আহ্বানে ভারতীয় প্রতিরক্ষা সচিব কে বি লাল, ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল পিসি লালসহ উচ্চপদস্থ ভারতীয় অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করেন এ কে খন্দকার। এ সময় এ কে খন্দকার আবারও বিমান চেয়ে অনুরোধ করেন। বৈঠকে নানা নিয়মনীতির প্রসঙ্গ দেখিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সরাসরি বিমান সহায়তা দিতে অপারগতা জানায় ভারত সরকার।
সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে ভারত সরকার বাংলাদেশকে ৩টি বিমান দিতে পারবে বলে জানায়। এই ৩টি বিমানের মধ্যে ছিল যোধপুরের মহারাজার দেওয়া উপহারের ১টি ডাকোটা ডিসি থ্রি পরিবহণ বিমান, ১টি ডি.এইচ.সি-৩ টুইন অটার পর্যবেক্ষণ বিমান ও ১টি শস্যক্ষেতে ওষুধ ছিটানোর কাজে ব্যবহৃত অ্যালুয়েট থ্রি হেলিকপ্টার।
স্কোয়াড্রন লীডার বদরুল আলম, বীর উত্তম বলেন, 'খন্দকার সাহেব একদিন খুব এক্সাইটেড হয়ে আমাকে ডেকে বললেন, বদরুল, আমরা ৩টি এয়ারক্রাফট পেয়েছি। আমি ভেবেছিলাম যুদ্ধ বিমান হবে। বললাম, কী কী? তিনি বললেন, একটি অ্যালুয়েড হেলিকপ্টার, একটি অটার, আরেকটি ডিসি থ্রি। এগুলো সবগুলোই সিভিলিয়ান এয়ারক্রাফট। তবে এখন এগুলোকে আমাদের ফাইটার এয়ারক্রাফটে রুপান্তর করতে হবে। খন্দকার সাহেব আরও বললেন, এয়ারফোর্স থেকে যেসব বাঙালি অফিসার বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ করছেন তাদের ডেকে নিতে। আমি তখন বললাম, স্যার, আমার একটি সাজেশন ছিল। আমাদের অনেক বেসামরিক পাইলট আছেন। আমরা যদি তাদের সংযুক্ত করতে পারি তাহলে তাদেরকেও কাজে লাগানো যাবে।'
পরিত্যক্ত এক বিমানঘাঁটিতে বিমানবাহিনীর পথচলা শুরু
ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীর বিমানঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের জন্য দিয়েছিল নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে অবস্থিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত এয়ারবেইস। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে যা ছিল অনেকাংশেই ব্যবহারের অনুপযোগী।
নিরাপত্তার খাতিরেই এই ঘাঁটিটি মুক্তিবাহিনীকে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছিল বলে মনে করেন ২ মুক্তিযোদ্ধা।
বদরুল আলম বলেন, 'ওটা এমন একটা জায়গায় ছিল যে, চারপাশে শুধু পাহাড় আর গভীর জঙ্গল। আশেপাশে বাড়িঘর নেই। ওখানে আমাদের থাকার জন্য কিছু তাঁবু পেতে রাখা ছিল।'
২৮ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর ডিপুটি চিফ অফ স্টাফ এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে ৯ জন পাইলট ও ৪৭ জন গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের সমন্বয়ে যাত্রা শুরু হয় মুক্তিবাহিনীর এয়ার উইং এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর।
বেসামরিক বিমান যেভাবে রূপান্তরিত হলো সামরিক বিমানে
ভারত সরকারের দেওয়া বিমানগুলো বেসামরিক হওয়ায় সেগুলোকে সামরিক বিমানে পরিণত করার কাজ শুরু হয়, যা ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
এ অটার প্লেন এবং অ্যালুয়েড হেলিকপ্টারে পাখার নিচে সংযোজন করা হয় ২টি করে রকেট পড। এ রকেট পডগুলোতে ৭টি করে মোট ১৪টি রকেট বহন করা যেত। একইসঙ্গে এই ২টি বিমানে ছিল ভারি মেশিনগানের ব্যবস্থা। অটার বিমানের তলদেশে ২০ পাউন্ড ওজনের ২০টি বোমা বহনের ব্যবস্থা করা হয়। ডাকোটা বিমানটিকে ১ হাজার পাউন্ডের মোট ৫টি বোমা বহনের উপযুক্ত করা হয়।
ঠিক করা হয়, প্রতিটি বিমানেই থাকবেন ৩ জন করে পাইলট। এর মধ্যে ১ জন স্ট্যান্ডবাই। যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কোনো পাইলট আহত বা অসুস্থ হলে তখন তিনি দায়িত্ব পালন করবেন। একইসঙ্গে থাকবেন একজন করে গানার।
কিন্তু বেসামরিক বিমানগুলোকে সামরিক বিমানে পরিণত করার ক্ষেত্রে ছিল নানা বিপত্তি।
আলমগীর সাত্তার বলেন, 'আমরা এয়ারক্রাফটগুলোর তলদেশে বুলেট থেকে রক্ষার জন্য ১ ইঞ্চি স্টিল প্লেট লাগালে দেখা যায় অটারের সেন্টার গ্রেভিটি নষ্ট হয়ে গেছে। তখন তা ঠিক করা হলো। এটি যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তা বলাবাহুল্য।'
প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও ছিল অজস্র প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতা
এই বেসামরিক বিমানগুলো সম্পর্কে বৈমানিকদের তেমন ধারণা না থাকায় ভারতীয় প্রশিক্ষক স্কোয়াড্রন লিডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ঘোষালের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় নিবিড় প্রশিক্ষণ।
প্রশিক্ষণের বিষয়ে বদরুল আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এই ধরনের ট্রেনিংয়ে কমপক্ষে ৪ মাস সময় লাগে, অথচ আমাদের ট্রেনিং ১৫ দিনেই শেষ করতে হবে। প্রথমে ১০ দিনে বিমান আমাদের নিয়ন্ত্রণে এল। আমরা যেহেতু ঠিক করেছিলাম রাতে অপারেশন করব, তাই রাতের বেলায় ফ্লাইং প্র্যাকটিস হতো। ওরা ২৫ মাইল দূরে পাহাড়ের চূড়ায় প্যারাসুট ফেলে রাখত। আমরা ওই প্যারাসুটকে লক্ষ্য করেই টার্গেট ছুঁড়তাম।'
যে কারণে রাতে অপারেশনের সিদ্ধান্ত
কিলো ফ্লাইটের অপারেশনগুলো রাতে চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি-আক্রমণ ও নিরাপত্তা বিবেচনা। দিনে আক্রমণ চালালে পাকিস্তানের অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান ও মিসাইল ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হতো অপারেশন কিলো ফ্লাইটকে। তাই মধ্যরাতে অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত হয়।
শেষ মুহূর্তে স্থগিত
৩০ অক্টোবর বিমান উইংয়ের প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খন্দকার পুরো অপারেশন সম্পর্কে বৈমানিকদের জানান। সিদ্ধান্ত হয়, ২ নভেম্বর রাতে ডাকোটা বিমান দিয়ে ঢাকা বিমানবন্দরে আক্রমণ চালানো হবে। আক্রমণটি করবেন ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার, ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক ও ক্যাপ্টেন আবদুল মুকিত।
'খন্দকার সাহেব আমাকে ও ক্যাপ্টেন মুকিতকে আলাদা করে ডেকে বললেন, তোমরাই ঢাকা এয়ারপোর্টে আক্রমণ করবে। তোমাদের বেঁচে ফিরে আসার সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি। যদি যেতে না চাও বলতে পার। তবে এয়ারপোর্ট ছাড়া অন্য কোথাও বোমা ফেলতে পারবে না। এটি যে কতটা বিপজ্জনক ছিল তা ভাবনারও বাইরে। কারণ ওখানে তখন ৩ স্তরের অ্যান্টি এয়ারক্রাফট ছিল', বলতে গিয়ে সেই দিনগুলোতে ফিরে গেলেন ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার।
সিদ্ধান্ত হয়, কৈলাসহর থেকে এসে আক্রমণ চালাবেন কিলো ফ্লাইটের বৈমানিকরা। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ব সফরে থাকায় শেষ মুহূর্তে এসে স্থগিত করা হয় অপারেশনটি।
আমরা আবার ফিরে যাই আলমগীর সাত্তারের কাছে।
তিনি বলেন, 'অপারেশনের দিন সকাল ১০টার দিকে ২ জনের গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিংয়ের বিমান নিয়ে ডিমাপুরে আসার কথা। ওই বিমান নিয়েই আমরা অপারেশনে যাব। ১০টা পেরিয়ে গেলেও তাদের আসার নাম নেই। ১ ঘণ্টা পর তারা এসেই খন্দকার সাহেবের হাতে দিল্লি থেকে পাঠানো একটি টেলেক্স তুলে দিলেন। সেই টেলেক্সে লেখা ছিল এই মিশন বাতিল। আমাদের ৩ পাইলটকে ব্যারাকপুরে যেতে হবে।'
ক্যাপ্টেন সাত্তার বলেন, 'কেন অপারেশনটি বাতিল বাদ দেওয়া হয়েছিল তখন কিছু জানানো হয়নি। তবে পরে জেনেছি ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ব সফরে ছিলেন তাই। এয়ার মার্শাল ধাওয়ানের সঙ্গে পরে একদিন আমার একবার দেখা হয়েছিল। এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আপনি চিন্তা করতে পারেন সেদিন আপনারা ঢাকা এয়ারপোর্টে ৫ হাজার পাউন্ড বোমাবর্ষণ করলে কতটা ভয়াবহ অবস্থা হতো! পাকিস্তানিদের সব ফাইটার প্লেন ধ্বংস হতো। ওরা তখন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধই শুরু করে দিত। ভারত তখন চায়নি যুদ্ধে জড়াতে।'
আবারও অপারেশনের সিদ্ধান্ত এবং আবারও স্থগিত
মুক্তিযুদ্ধের ২৮ নভেম্বর ফের আক্রমণের দিন ধার্য করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ চালানো হবে। প্রথম অপারেশনটি হবে অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার দিয়ে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের ইউএসএসওর তেলের ডিপোতে। অন্যটি হবে অটার বিমান দিয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই অপারেশনের দিনও পেছানো হয়।
অবশেষে কিলো ফ্লাইট অপারেশন সফল
৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তানি বাহিনী ভারতের ৭টি ঘাঁটিতে একযোগে বিমান হামলা চালালে ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীর এয়ার উইংকে পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত অনুসারে অপারেশন শুরুর নির্দেশ দেয়। একইসঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের ইউএসএসওর তেলের ডিপোতে প্রথম অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলমকে। আর দ্বিতীয় অপারেশনে পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে হামলা চালাতে বরা হয় ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলমকে।
আমরা ফিরে আসি বদরুল আলমের কাছে।
তিনি বলেন, 'আমরা নির্দেশের অপেক্ষায় প্রস্তুত ছিলাম। আমি ও সুলতান মাহমুদ হেলিকপ্টার নিয়ে ডিমাপুর থেকে চলে গেলাম কৈলাসহরে। ওখানে থামার উদ্দেশ্য হলো আমাদের ফুয়েল নিতে হবে। নয়তো পথেই ফুয়েল শেষ হয়ে যাবে। কৈলাসহর থেকে ফুয়েল নিয়ে ম্যাপ ফলো করে এগোতে থাকি আমরা। সে রাতে জ্যোৎস্না ছিল। আমরা বেশি উঁচু দিয়ে উঠতে পারছিলাম না, পাকিস্তানিদের রাডারে ধরা পড়ে যাব। আবার বেশি নিচ দিয়ে গেলেও এক্সিডেন্ট হতে পারত।'
'আমাদের হেলিকপ্টারে ৭টি করে মোট ১৪টি রকেট ছিল। ইউএসএসওর তেলের ডিপোতে প্রথমে ২টি করে ফায়ার করলাম। ফায়ার করার সময় কিছুটা আড়াআড়িভাবে এসে হালকা নিচু হয়ে ফায়ার করে তৎক্ষণাৎ বাঁক নিতে হয়। আমরা ফায়ার করেই হেলিকপ্টার ঘুরিয়ে ফের একসঙ্গে ফায়ার করলাম। সবমিলিয়ে বোধহয় ৭-৮ মিনিট সময় লাগল। প্রথম বিস্ফোরণ এত বড় হয়েছিল যে পুরো এলাকা আলোকিত হয়ে যায়,' যোগ করেন তিনি।
'ফিরে আসলেন কীভাবে?' প্রশ্ন করতেই বদরুল আলম উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, 'ফিরে এলাম ওভাবেই। আমরা যেখানে ল্যান্ড করব ওটা ছিল একটা টিলার চূড়া। কোনো নেভিগেশন লাইট নেই। যখন টিলার শেষ মাথায় এসে পৌঁছেছি তখন দেখি নিচ থেকে কেউ টর্চের আলো ফেলছে। ল্যান্ডিং লাইটটা জ্বালাতেই দেখলাম ওখানেই হেলিপ্যাড। আমরা নামতেই ভারতীয়রা বলল, ওরা ভাবতেও পারেনি আমরা এভাবে সফল অপারেশন শেষে জীবিতাবস্থায় ফিরে আসতে পারব।'
৩ ডিসেম্বর রাতের কিলো ফ্লাইটের দ্বিতীয় অপারেশনে অটার বিমান নিয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে হামলা চালান ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম।
কিলো ফ্লাইটের এই ২টি অপারেশনে ধ্বংস হয়ে যায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বেশিরভাগ জ্বালানি তেল। ফলে জ্বালানি তেলের অভাবে উড়ার শক্তি অনেকটাই হারিয়ে ফেলে পাকিস্তানি বাহিনী। অনেকাংশেই মুক্ত হয়ে যায় বাংলার আকাশ। প্রথমদিকে মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের ঘাঁটি ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে থাকলেও পরে তা শমসেরনগরে স্থানান্তর করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী ১৩ দিনে অপারেশন কিলো ফ্লাইটের মাধ্যমে অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার ও অটার বিমান নিয়ে ৭০টি অপারেশন চালিয়েছিলেন কিলো ফ্লাইটের মুক্তিযোদ্ধারা।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ব্রিগেড ভিত্তিক ইতিহাস
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র
Comments