মেসির হাতে বিশ্বকাপ দেখতে চান অন্য দেশের সমর্থকরাও!
ফুটবল মাঠে দাঙ্গার কথা এতদিন গণমাধ্যমে পড়ে এসেছি। কাল দেখলাম নিজের চোখে। কাতারের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে তিউনিসিয়া গোল দেওয়ার পর কয়েকশো তিউনিসিয়ান সমর্থক জোর করে স্টেডিয়ামে ঢুকার চেষ্টা করে। যেহেতু বিশ্বকাপের মাঠে টিকেট ছাড়া ঢুকার কোনো সুযোগ নাই, তাই কাতারের পুলিশ তাদেরকে মাঠে ঢুকতে বাঁধা দেয়। পরবর্তীতে পুলিশের সাথে শুরু হয় তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া।
কাতারের পুলিশ প্রথমে ভদ্রভাবে তিউনিসিয়া সমর্থকদের বাঁধা দেয়, কিন্তু উগ্র সমর্থকদের তারা কোনোভাবেই বোঝাতে পারছিল না যে টিকেট ছাড়া স্টেডিয়ামে ঢুকা যাবে না। কিন্তু দেশটির উগ্র সমর্থকরা যেন পণ করেই এসেছিল টিকেট ছাড়াই মাঠে ঢুকবে। যখন কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না, তখন অ্যাকশনে যায় কাতারি পুলিশ। গ্রেফতার করে তিউনিসিয়া বেশ কিছু সমর্থককে।
এর আগে অনেক নাটকীয়তার এক ম্যাচে ফ্রান্স হেরে যায় তিউনিসিয়ার কাছে। ফ্রান্স কোচ নিজের দলের বেঞ্চকে পরীক্ষা করার জন্য কাল মূল দলের ৯ জন খেলোয়াড়কে বসিয়ে রেখে একাদশ সাজিয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার জন্য মরিয়া তিউনিসিয়ার কাছে সেই ফ্রান্স দল পুরো ম্যাচেই নাকানি চুবানি খেয়েছে। শেষ মুহূর্তে ফ্রান্স তাদের মূল দলের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে মাঠে নামালেও আর জেতা হয়নি তাদের। অন্যদিকে ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচে জিতেও দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়া হয়নি তিউনিসিয়ার। একই সময়ে চলা গ্রুপের অন্য ম্যাচে ডেনমার্ককে হারিয়ে ফ্রান্সের সাথে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে দ্বিতীয় রাউন্ডে।
ম্য্যাচ শেষে তাই তিউনিসিয়ার সমর্থকরা একই সঙ্গে খুশিতে ফেটে পড়েছিলেন আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। একইসাথে খুশি এবং দুঃখের এক অনুভূতি ভর করেছিলো পুরো স্টেডিয়ামে। এমনকি এই ম্যাচে তিউনিসিয়া গোল দেওয়ার পর তিউনিসিয়া সমর্থকরা দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার ব্যাপারে এতটাই আশাবাদী হয়েছিলেন ম্যাচ চলাকালীন সময়ে অনেককেই দেখলাম ফিফার রিসেল প্লাটফর্মে দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচ টিকেট খুঁজতে শুরু করেছেন। কারণ, বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে ইতিমধ্যে দলগুলোর বিদায় নেওয়া শুরু হয়েছে। পরবর্তী রাউন্ডের টিকেট কিনে রাখা সমর্থকরা নিজেদের দল পরবর্তী রাউন্ডে যেতে না পারায় প্রায় সব সমর্থকই নিজেদের টিকেট বিক্রি করে দিচ্ছেন ফিফার রিসেল প্লাটফর্মে। কিন্তু তিউনিসিয়ার সমর্থকরা যে ম্যাচের টিকেট খুঁজছিলেন সেই ম্যাচের টিকেট পাওয়া আর সোনার হরিণ পাওয়া এক কথা। কারণ আর্জেন্টিনার সমর্থকরা ওই ম্যাচের সব টিকেট কিনে রেখেছে আগেই!
তিউনিসিয়া আর ফ্রান্স ম্যাচ শেষ করে ছুটে গিয়েছি আর্জেন্টিনা আর পোল্যান্ড ম্যাচ দেখতে। সেই ম্যাচে উজ্জীবিত আর্জেন্টিনার সামনে দাঁড়াতেই পারেনি পোল্যান্ড। তবে আর্জেন্টিনা দল মাঠে যতটা উজ্জীবিত ছিল , তারচেয়ে বেশি উজ্জীবিত ছিল গ্যালারির আর্জেন্টিাইন সমর্থকরা। তারা নাচে গানে পুরো ম্যাচ জুড়ে প্রিয় দলকে সমর্থন করে গেছে।
এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে আর্জেন্টিনা আর পোল্যান্ড ম্যাচে নির্ধারিত সময়ে স্টেডিয়ামে পৌছার জন্য ট্যাক্সিই ছিল একমাত্র ভরসা। কারণ মেট্রো আর ফ্রি শাটল বাস ধরতে গেলে ম্যাচের অনেকটা মিস হয়ে যেতে পারে। তাই উবার কল করলাম। যে ড্রাইভার আমাকে পিক করতে আসলেন, কথা প্রসঙ্গে জানা গেল সিলেটে তার বাড়ি আমার বাড়ির কাছেই। প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে তিনি কাতার প্রবাসী। আমার ঢাকা জীবনও অনেকদিনের। তাই একই পাড়ায় বাড়ি হলেও দেখা হয়নি কখনো। তার কাছ থেকে শুনলাম কাতারের থাকা বাংলাদেশিদের অনেক কথা। তিনি জানালেন, এখানে টাকা পয়সা ভালো কামানো গেলেও খরচ অনেক বেশি। এই দেশটা খুব ব্যয়বহুল। অনেক কষ্টে এখানে জীবনযাপন করে দেশে টাকা পাঠাতে হয়। কিন্তু দেশে থাকা প্রিয়জন এটা বুঝতেই চান না। তাদের শুধু টাকার দরকার। কিন্তু এই টাকা কামাতে গিয়ে তাদের যে কষ্ট করতে হয় সেটা জানতে চান না কেউই, প্রবাস জীবনের তাদের সেই কষ্টটাও বুঝতে চান না কেউ। তার কথা শুনে সমব্যথী হওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না।
আর্জেন্টিনা ম্যাচে মাঠে ঢুকেই দেখি আর্জেন্টাইন আকাশী সাদা উৎসব। যেদিকে চোখ গেছে সেদিকেই শুধু আকামী সাদা সমর্থক। স্টেডিয়ামে ঢুকতে ঢুকতে কথা হলো মরক্কো থেকে আর্জেন্টিনার খেলা দেখতে আসা তরুণী রিম এর সাথে। ম্যাচ শুরুর আগেই দৃঢ় কণ্ঠে জানালো- এবারের আর্জেন্টিনা দল চ্যাম্পিয়ন না হলেও সেমিফাইনালে যাবে। মরক্কোর ম্যাচগুলো দেখার পাশাপাশি রিম আর্জেন্টিনার প্রথম রাউন্ডের সব কটি ম্যাচেরই টিকেট পেয়েছে। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, মরক্কোর মেয়ে হয়ে আর্জেন্টিনার সমর্থন কেন করছো? হাসিমুখে রিম আমাকে জানালো- মেসির জন্য!
শুধু রিম না, আর্জেন্টিনা এই বিশ্বকাপে ভালো কিছু করুক এটা চাইছেন অনেক দলের সমর্থকই। কারণ, একটাই মেসির মতো একজন ফুটবল কিংবদন্তীর হাতে একটা বিশ্বকাপ দেখতে চান অনেকেই। যদি বিশ্বকাপ যদি জিততে না পারেন তাহলে মেসির এমন একটা উজ্জ্বল ক্যারিয়ারে একটা অপূর্ণতা থেকেই যাবে! কাল পোল্যান্ডকে উড়িয়ে দিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তের মেসি সমর্থকদের মনে আশা জাগিয়েছে আর্জেন্টিনা দল। তারা এই বিশ্বকাপে কতদূর যেতে পারবে সেটা সময়ই বলে দিবে। কিন্তু বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিভিন্ন দলের সমর্থকরাও চাইছেন- মেসির জন্য হলেও বিশ্বকাপ জিতুক আর্জেন্টিনা। কাল যেমন খেলা শেষে স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে স্পেনের মার্কো বললো- 'আমার নিজের দেশ বিশ্বকাপে থাকলেও, আমি চাই এই বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনা জিতুক। আর্জেন্টিনা এই বিশ্বকাপটা জিতুক প্রিয় লিওনেল মেসির জন্য!'
লেখক: দ্য ডেইলি স্টারের পাঠক। লেখার ব্যবহৃত ছবি লেখকের।
Comments