ডিএনসির মাদক মামলার জেরে এলোমেলো নুর আলমের জীবন

হেফাজনে নির্যাতন
নুর আলম। ছবি: সংগৃহীত

আর দশটি সাধারণ দিনের মতোই গত ১০ আগস্ট নূর আলম মাদবর শরীয়তপুরের গঙ্গানগর বাজারে আড্ডা দিচ্ছিলেন। সেখান থেকে হঠাৎ কিছু মানুষ এসে তাকে ধরে পাশের গলিতে নিয়ে যান।

এরপরই সেই সাধারণ দিনটি ভয়াবহ দিনে পরিণত হয় এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করা ২১ বছর বয়সী নুর আলমের জীবনে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) থেকে আসা ওই দলটি নুর আলমকে মারধর করে এবং তাকে একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। ওই বাড়িতে নিয়েও তারা নির্দয়ভাবে মারধর করে নুর আলমকে।

এরপর তারা নুর আলমকে গ্রেপ্তার করে ৫২টি ইয়াবা পাওয়ার অভিযোগে।

নুর আলমের বিরুদ্ধে পালং মডেল থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়। পরদিন ডিএনসি নূর আলমকে শরীয়তপুর আদালতে হাজির করে।

নুর আলম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, আসলে সেদিন তার কাছ থেকে কোনো মাদক উদ্ধার করা হয়নি।

তিনি বলেন, 'মাদক মামলার জেরে আমি অনার্স কোর্সে ভর্তি হতে পারিনি। সবকিছু মিলিয়ে আমি যতটা শারীরিকভাবে নির্যাতিত, তারচেয়েও বেশি নির্যাতিত মানসিকভাবে।'

শরীয়তপুর সদর উপজেলার শৈলপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ওয়ার্ড সদস্য গৌতম দাস বলেন, 'আমি নুর আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের ভালো করেই চিনি। তাকে কখনো মাদক সেবন করতে দেখিনি বা কোনো দিন এমন কিছু শুনিনি।'

নুর আলমকে ডিএনসির সদস্যরা যখন নির্দয়ভাবে মারধর করেছে, তার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী গৌতম দাস।

গত আগস্টে আদালতে হাজির করা হলে নূর আলম সেখানে বলেন, ডিএনসির অভিযানকারী দলের সদস্যরা হেফাজতে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে। তখন নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শামসুল আলম তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন এবং শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের সুপারকে নূর আলমের শারীরিক পরীক্ষা করে মেডিকেল রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দেন।

মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়েছে, নুর আলমের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন আছে। রিপোর্ট যাচাই-বাছাই করে গত ২২ আগস্ট ম্যাজিস্ট্রেট শরীয়তপুরের পুলিশ সুপারকে নিয়মিত মামলা হিসেবে নুর আলমের বক্তব্য নথিভুক্ত করার নির্দেশ দেন।

পুলিশ গত ১৩ সেপ্টেম্বর অজ্ঞাত ৫ থেকে ৬ জনের বিরুদ্ধে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে নিয়মিত মামলা হিসেবে তার বক্তব্য নথিভুক্ত করে।

তদন্ত শেষে পালং মডেল থানার উপপরিদর্শক ইব্রাহিম পাটোয়ারী গত ১৬ নভেম্বর শরীয়তপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। সেখানে বলা হয়, ডিএনসির ৪ জন সদস্য হেফাজতে নূর আলমকে নির্যাতন করেছেন।

ডিএনসির এই ৪ সদস্য হচ্ছেন, অপূর্ব বিশ্বাস, সহকারী উপপরিদর্শক তোফায়েল আহমেদ এবং সিপাহী প্রকাশ রায় ও প্রিয়াঙ্কা ঘরামি।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, শরীয়তপুরের গঙ্গানগর বাজারের পাশের গলিতে নূর আলমকে মারধর শুরু করেন অপূর্ব ও প্রকাশ।

নুর আলমকে গঙ্গানগর বাজার সংলগ্ন সুমন রবি দাসের বাড়িতে নিয়ে গেলে অপূর্ব ও তোফায়েল তাকে প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে পিটিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম করেন।

নূর আলমের বাম চোখে প্রকাশ এত জোরে আঘাত করেছিল যে সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। প্রিয়াঙ্কা তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং তার গালে থাপ্পড় দিতে থাকেন।

চার্জশিটে আরও বলা হয়েছে, আসামিরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য হওয়া সত্ত্বেও গ্রেপ্তারের সময় অভিযোগকারীকে তাদের হেফাজতে রেখেছিলেন এবং তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অমানবিক নির্যাতন করেছিলেন।

দ্য ডেইলি স্টারকে ভুক্তভোগীর আইনজীবী শহিদুল ইসলাম সজিব বলেন, 'চার্জশিটে আসামিদের বর্বরতা এবং তাদের অপরাধের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। এরপর অভিযুক্তরা আইনত ডিএনসিতে চাকরি কর্মরত থাকতে পারেন না।'

সজিব জানান, চাকরি হারানোর আশঙ্কায় এই মামলার ৩ আসামি গত শুক্রবার নূর আলমের বাড়িতে গিয়েছিলেন এবং মামলা তুলে নেওয়ার জন্য তাকে হুমকি-ধামকি দিয়েছেন।

নূর আলমের বরাত দিয়ে আইনজীবী বলেন, 'ওই সময় স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাসহ প্রায় ২০-২৫ জন আসামিদের সঙ্গে ছিলেন। এখন আমার মক্কেল নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছেন।'

যোগাযোগ করা হলে আসামি তোফায়েল স্বীকার করেন যে তারা বিষয়টি মীমাংসা করতে নূর আলমের বাড়িতে গিয়েছিল।

তিনি বলেন, 'কিন্তু সেখানে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।'

শরীয়তপুর সদর উপজেলার শৈলপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ওয়ার্ড সদস্য হারুন মোল্লা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, শুক্রবার তিনি স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে নূর আলমের বাড়িতে গিয়েছিলেন।

তিনি আরও বলেন, 'ডিএনসি কর্মকর্তারা নুর আলমের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। প্রশাসনের লোকজন এখন বুঝতে পেরেছেন যে তারা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে মাদক মামলাটি করেছেন।'

মাদক মামলা

গত ১৯ অক্টোবর ডিএনসি মাদক মামলায় নূর আলমের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে।

চার্জশিটে বলা হয়, তোফায়েল এই মামলাটি করেছেন এবং অপূর্ব তদন্ত করেছেন। সাক্ষী হিসেবে প্রকাশের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

চার্জশিটে অপূর্বর ভাষ্য, স্থানীয় বাসিন্দা আলমগীর মাদবর, মারুফ মাদবর ও লুৎফর চৌধুরীর সামনে ডিএনসি সদস্যরা নূর আলমের দেহ তল্লাশি করেন এবং তার কাছ থেকে ৫২ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেন।

তবে, গত ১৪ সেপ্টেম্বর ওই ৩ স্থানীয় বাসিন্দা ডেইলি স্টারকে জানান, ডিএনসি কর্মীরা নুর আলমের কাছ থেকে কোনো ইয়াবা উদ্ধার করেছে, এমন কিছু তারা দেখেননি।

আলমগীর মাদবর বলেন, 'ঘটনা শোনার পরপরই আমি কয়েকজনকে নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। সেখানে ডিএনসি কর্মীদের একজনের হাতে মাদক দেখতে পাই। তারা আমার কাছে আমার ঠিকানা দিতে বলেছে, আমি দিয়েছি।'

একই কথা বলেছেন লুৎফর চৌধুরী ও মারুফ মাদবরও।

Comments

The Daily Star  | English

Drug sales growth slows amid high inflation

Sales growth of drugs slowed down in fiscal year 2023-24 ending last June, which could be an effect of high inflationary pressure prevailing in the country over the last two years.

17h ago