টরেন্টোয় মঞ্চস্থ ২ নাটকে সমকালীন বাংলাদেশ

ছবি: সংগৃহীত

টরেন্টো একটি 'ভাইব্র্যান্ট' সিটি। একইভাবে 'ভাইব্র্যান্ট' এখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরাও। বছরজুড়ে এখানে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড লেগেই থাকে। এগুলোই প্রবাসে বিনোদনের অন্যতম উৎস। 

কখনো নৃত্য ও সংগীত সন্ধ্যা, কখনো আবৃত্তি বা আলোচনার আসর, আবার কখনোবা লোকমেলা বা আঞ্চলিক মেলা। এর বাইরে সমমনাদের ঘরোয়া আড্ডার পাশাপাশি রসনাবিলাস তো আছেই।

তবে এখানে নাটকের মঞ্চায়ন সঙ্গত কারণেই খুব একটা চোখে পড়ে না । নাটক মঞ্চায়নের গোটা প্রক্রিয়াটি একটি যৌথকলা (Composite Art) বা সমন্বিত শিল্পপ্রয়াস; যার জন্য প্রয়োজন প্রলম্বিত পূর্বপ্রস্তুতি। নির্দেশকের উপস্থিতিতে পাত্র-পাত্রী ও আনুষঙ্গিক কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত অনেক মানুষের দীর্ঘদিনের পৌনঃপুনিক মহড়া এবং টিমওয়ার্কের পর নাটক মঞ্চে আসে। এখানকার কর্মব্যস্ত জীবনে এমন লম্বা সময় বের করার সুযোগ সীমিত। তাই নাটকের মঞ্চায়নও এখানে বিরল ঘটনা। 

ছবি: সংগৃহীত

এর আগে টরেন্টোয় বাংলা নাটক দেখেছিলাম করোনা মহামারির আগে, ২০১৯ সালে, 'নাট্যসংঘ কানাডা'র পরিবেশনায় 'তিন মাতালের কাণ্ড'। সে পরিবেশনার একটি পর্যালোচনা লিখেছিলাম আমি, যার শেষ লাইনটি ছিলো এরকম- 'প্রত্যাশা করি উৎসাহী দর্শকদের কথা মনে রেখে নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়ে শীঘ্রই আবার মঞ্চে আসবে নাট্যসংঘ।'

সে প্রত্যাশা পূরণ হলো। নতুন উদ্যমে নাট্যসংঘ এবার 'তিন মাতালের কাণ্ড'র সঙ্গে মঞ্চে নিয়ে এলো 'গন্ধগোকুল' নামের আরও একটি মৌলিক নাটক। হলভর্তি দর্শকের সামনে গত ১৫ ও ১৬ অক্টোবর মঞ্চস্থ হলো নাটক ২টি।

এই ২টি নাটকেরই রচয়িতা নাট্যসংঘের অন্যতম সদস্য ও নির্দেশক সুব্রত পুরু। তার ভাষ্য, 'একঝাঁক নাট্য-অন্তঃপ্রাণ প্রতিভাবান মানুষ ২টি নাটকের সঙ্গে দীর্ঘসময় সম্পৃক্ত থেকে এগুলোকে মঞ্চায়নের যোগ্য করে তুলেছেন।'

প্রসঙ্গত প্রশ্ন জাগে- অবসর বিনোদনের সঙ্গী হিসেবে নাটকের কাজ কী নিছক আনন্দ দান? ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, সভ্যতার ঊষালগ্নে নাটক উদ্ভুত হয়েছিলা 'জনচিত্তরঞ্জন'- এর জন্যে প্রাচীন গ্রিসে ও ভারতবর্ষে। সেই যে শুরু, আর থেমে থাকেনি নাটকের অব্যাহত অগ্রযাত্রা। কালক্রমে নাটক হয়ে উঠেছে সমাজের দর্পণ। সামাজিক অনাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে নাটক মানুষকে সংঘবদ্ধ করে। মানুষের বিবেক ও সুপ্ত-চৈতন্যকে জাগ্রত করে। সংকট ও সংঘাতের মুহূর্তে মানুষের অন্তর্নিহিত রূপের যে প্রকাশ আমরা নাটকে দেখতে পাই, তা বিস্ময়কর। বিখ্যাত নাট্য সমালোচক John Gassner তার Masters of Drama গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন, নাটক 'represents humanity in moments of maximum tension, conflict and crisis.'। 

ছোট নাটকের সীমিত ক্যানভাসে সমাজের বড় সমস্যা তুলে ধরার মুনশিয়ানা খুব বেশি মানুষের থাকে না। সমকালীন বাংলাদেশের পটভূমিতে রচিত 'তিন মাতালের কাণ্ড' ও 'গন্ধগোকুল' নাটকে পুরু তার নিজস্ব শৈলীতে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন- ঘুষ, দূর্নীতি, ধর্মান্ধতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে অন্যায়ের সঙ্গে আপসকামিতার মতো সামাজিক ব্যাধি কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। 

ছবি: সংগৃহীত

বৈষয়িক ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ব্যক্তির কাছে প্রবাসে দেশীয় ভাষায় মঞ্চনাটক আয়োজনের মতো অলাভজনক কাজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করা পণ্ডশ্রম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে নাট্যসংঘের সদস্যদের কাছে এর গুরুত্ত্ব আর্থিক নয়, আত্মিক। নাটক মঞ্চায়নে তারা প্রগাঢ় আনন্দ পান। নতুন কিছু সৃষ্টির আনন্দ, নিজেকে অন্যের কাছে তুলে ধরার আনন্দ, অন্যকে আনন্দ দেওয়ার আনন্দ– যে আনন্দ অর্থ দিয়ে কেনা যায় না। 

নাট্যসংঘ, কানাডার এই পরিবেশনায় যুক্ত ছিলেন একঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ নাট্যকর্মী। অভিনয়ের বাইরে বিভিন্ন দায়িত্বে যারা নিয়োজিত ছিলেন তারা হলেন- শব্দ ও সংগীত পরিচালনায় অমিতাভ দাশ, কীবোর্ডে মামুন কায়সার, তবলায় সজীব চৌধুরী, রূপসজ্জা ও পোশাক পরিকল্পনায় কচি রানা ও রেহানা আক্তার রনি।

এদের প্রত্যেকেই স্ব-স্ব অবস্থান থেকে অবদান রেখেছেন নাটক ২টির সফল মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে। সাধুবাদ জানাই সংশ্লিষ্ট সবাইকে ২টি সুন্দর সন্ধ্যা উপহার দেবার জন্য।

দর্শক নাটক দেখতে আসেন মূলত অভিনয় দেখার জন্যে। অভিনয় উপভোগ্য হলে সময় কীভাবে গড়িয়ে যায় দর্শক তা আঁচ করতে পারেন না। আর সেজন্যই সাড়ে ৩ ঘণ্টা হলে বসে নাটক দেখার পরও উষ্ণ করতালি দিয়ে নাট্যকর্মীদের অভিনন্দন জানাতে দর্শকদের কোন ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি।

পরিশেষে বলা যায়- অসাধারণ অভিনয়, বুদ্ধিদীপ্ত নির্দেশনা, পরিমিত দৃশ্যসজ্জা, তবলা ও যন্ত্রসংগীতের যথাযথ প্রয়োগ, নৃত্য ও সংগীতের সুচিন্তিত সংযোজন নাটক ২টিকে দর্শকের কাছে উপভোগ্য করে তুলেছে। টরেন্টোয় বাংলা নাটকের অগ্রযাত্রায় নাট্যসংঘ, কানাডা'র এ পরিবেশনা নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।

লেখক: টরেন্টোর সেনেকা কলেজের শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক।

 

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

3h ago