বাংলাদেশের কবিতায় ওমর আলীর হঠাৎ আলোর ঝলকানি

শরীরের কোথাও অস্বাভাবিক মাংস বৃদ্ধিকে সুস্বাস্থ্য বলে না। বরং ডাক্তারি শাস্ত্রে সেটা একটা রোগ। স্বাস্থ্য মানে শরীরের সব প্রত্যঙ্গের সুষম ও প্রয়োজনসম্মত বিকাশ। বাংলাদেশের সমাজ যে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী নয় তার প্রমাণ এর সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক। সবকিছুতে ঢাকার অস্বাভাবিক মাংস বৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু দেশের অন্যান্য জায়গার সেই আনুপাতিক বৃদ্ধি আগেও ঘটেনি, এখনো ঘটছে না। চৌষট্টিটি জেলা আর অসংখ্য মফস্বল শহর ও গ্রাম-গ্রামান্তর প্রায় সব ক্ষেত্রেই সুষ্ঠুভাবে বিকশিত হয়নি। একারণে সবাই সবকিছুর জন্য শুধু ঢাকায় আসতে চায়। ঢাকার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঢাকা যেন বাংলাদেশের কামরূপ-কামাক্ষা। এতে ঢাকার চাহিদা আর 'মাহাত্ম্যের' বাড়াবাড়িটা হয়ত বোঝা যায়, কিন্তু একইসাথে এই পরিস্থিতি ঢাকার বাইরের দীনতাও প্রকাশ করে। কথাগুলো কবি ওমর আলীক মাথায় রেখে মনে হলো। কারণ কবি ওমর আলী বলতে ঢাকার শিক্ষিত কবিকুল মফস্বলের ওমর আলীই বোঝেন।

ঢাকার বাইরে থেকে শিল্প-সাহিত্য-চিন্তা বা অপরাপর কিছুর নিবিড় চর্চা যে হতে পারে তা দিনদিন অবিশ্বাস্য হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে আমাদের সব ধরনের ভাবনার মধ্যেকার সামগ্রিকতার অভাবই মূলত দায়ী। আমরা এখনো সমগ্র দেশকে মাথার মধ্যে নিয়ে ভাবতে শিখিনি; কি রাজনীতি, কি অর্থনীতি, সংস্কৃতি- সব ক্ষেত্রেই। এ দিয়ে একইসাথে আমাদের চিন্তা ও প্রতিভার খামতি এবং জাতীয় চৈতন্যটা খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চিন্তা ও প্রতিভার খামতির কথা বললাম কারণ, শক্তি থাকলে প্রান্তে থেকেও যে কেন্দ্রে আলোড়ন তোলা যায় তার প্রমাণ তো জসীমউদ্দীন। ফরিদপুরের এক গ্রাম থেকেই তিনি কলকাতার পাঁশড় জুড়ে এমন ঘাঁ দিয়েছিলেন যে, সেই ঘাঁয়ের ব্যথা কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা কবিতা আজও ভুলতে পারেনি। এখনো কঁকিয়ে ওঠে মধ্যরাতে ব্যথা ওঠা রোগীর মতো।

ওমর আলীর ব্যাপারটাও অনেকটা সেইরকম। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে সবাই যখন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে রাজধানী ঢাকায় এবং আধুনিক হওয়ার জন্য কাছা খুলে দৌড়াচ্ছে তখন তিনি মাথাভর্তি গ্রাম নিয়ে ফিরছেন ঢাকায়। বিচলিত হচ্ছেন না। থাকছেন দরবেশি স্থিরতায়। জসীমউদ্দীনের মতো তিনিও নগর ঢাকার দীনতা উদোম করে দিয়েছিলেন অনাস্বাদিতপূর্ব কবিতা লিখে। একই কথা খাটে আল মাহমুদের বেলায়। তিনিও ঢাকাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছে নত হতে বাধ্য করেছেন। তিনি ঢাকায় ছিলেন নাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছিলেন সে প্রশ্ন বৃথা। শারীরিকভাবে ঢাকা থাকলেও তিনি গ্রামের স্পর্ধা নিয়ে চলা লোক ছিলেন।

ওমর আলী কোনো অর্থেই ঢাকার নন। জীবনের অধিকাংশ সময় পাবনায় কাটানোর দিক থেকেও আবার কবিতার দিক থেকেও তিনি ঢাকার কেউ নন। তিনি নাগরিক জটিলতার ধার ধারেননি। কোনো প্রকার পাড়াপাড়ি হুড়োহুড়ির মধ্যে যাননি। কোনো রকম 'ছোটলোকি' করেননি। কোনোকিছু সাজতে যাননি। তিনি আস্থা রেখেছিলেন নিজের প্রতিভার উপর; চিন্তার উপর। ফল যা দাঁড়ালো তা এই যে, ঢাকা কিছু সময়ের জন্য হেলে পড়ল পাবনার দিকে। একদিন যেমন কলকাতা হেলে পড়েছিল ফরিদপুরের দিকে।

প্রসঙ্গত একটা কথা বলে রাখা যাক। বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিকতার বড়াই করে হম্বিতম্বি করেছে নগর ঢাকার মানুষেরা। কিন্তু জয়ী হয়েছে সব সময় প্রান্ত ও গ্রাম। পরবর্তীতে শহরই বড়াই করেছে এই প্রান্তের মানুষদের নিয়ে। এর বড় প্রমাণ  জসীমউদ্দীন, আল মাহমুদ ও ওমর আলীসহ আরও অনেকে। যারা ঢাকা ঢাকা করেছেন তাদেরও কবিতা জুড়ে দেখা যায় গ্রামীণ জনপদের লীলালাস্য। বাংলাদেশের বড় অধিকাংশ কবি সম্পর্কেই বোধ করি একথা বলা যাবে।

কিন্তু ওই অধিকাংশ কবির কবিতার বাংলাদেশ আর ওমর আলীর বাংলাদেশের মধ্যে একটা ফারাক আছে। ওমর আলীর কবিতায় বাঙালি সংস্কৃতি উল্লেখ আকারে হাজির হয়নি। বাঙালি সংস্কৃতির সার শোণিত প্রবাহের মতো কবিতার অভ্যন্তরে গভীরভাবে ক্রিয়াশীল থেকেছে। ওমর আলীর কবিতার বিষয়, নারীকে দেখার ভঙ্গি, নারীর সৌন্দর্য চিহ্নিতকরণে ক্রিয়াশীল রুচি, নারীর সঙ্গে পুরুষের সম্পর্কের কাঠামো, সংসার ও চারপাশের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক ইত্যাদির প্রশ্নে তার কবিতা বাঙালি সংস্কৃতির একেবারে ঘরের কবিতা হয়ে উঠেছে। ওইসব কবিতায় আদিম শ্যামাঙ্গী স্বাস্থ্যবতী নারী যখনই কীর্তিত হয় তখনই খাঁটি বাঙালি রুচি আর জাতি-পরিচয় কবিতার মধ্যে উঁকিঝুকি মারে। উদাহরণ লক্ষ করা যেতে পারে তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতাটি আবার পাঠ করে−

এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা;
সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে,
রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা।

সে শুধু অবাক হয়ে চেয়ে তাকে হরিণীর মতো
মায়াবী উজ্জ্বল দুটি চোখে, তার সমস্ত শরীরে
এদেশেরই কোন এক নদীর জোয়ার বাঁধভাঙা;
হালকা লতার মতো শাড়ী তার দেহ থাকে ঘিরে।

সে চায় ভালবাসার উপহার সন্তানের মুখ,
এক হাতে আঁতুরে শিশু, অন্য হাতে রান্নার উনুন,
সে তার সংসার খুবই মনে প্রাণে পছন্দ করেছে;
ঘরের লোকের মন্দ আশংকায় সে বড় করুণ।

সাজানো গোছানো আর সারল্যের ছবি রাশি রাশি
ফোটে তার যত্নে গড়া সংসারের আনাচে-কানাচে,
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর এ ব্যাপারে খ্যাতি;
কর্মঠ পুরুষ সেই সংসারের চতুষ্পার্শ্বে আছে। (এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি)

তবে হ্যাঁ, একথা কবুল করতেই হবে যে, ওমর আলীর এই কবিতা জসীমউদ্দীনের কবিতার মতো পরমাত্মীয় জ্ঞানে গলা জড়িয়ে ধরে না। এও আত্মীয়, ঘনিষ্ঠ, খুব চেনা। কিন্তু জসীমউদ্দীনের কবিতার চেয়ে একটু যেন ফিটফাট।  ভাষা, ভাব আর উপস্থাপনার মধ্যে আরও যেন একটু মাজা-ঘঁষার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এ যেন গ্রামের মেয়ে-ই কিন্তু শহরের খোঁজ-খবর একটু আধটু রাখে। চাচা, মামা, খালু বা বাপ-ভাই কেউ হয়ত শহরে থাকে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ কবি যখন- অন্তত পঞ্চাশের দশক থেকে- আধুনিকতার জন্য তাঁদের কেবলা বানিয়েছেন ইউরোপ ও কলকাতাকে, তখন ওমর আলী গ্রামকেই নিরিখ করলেন কেন! এর প্রধান কারণ হয়ত তাঁর চেতনার গঠনকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল। চেতনার মধ্যে গ্রামের উপস্থিতি ওমর আলীর একপ্রকার নিয়তিই বলা যায়। কারণ, চৈতন্যের বিশেষ ঝোঁকের কারণে অনেক সময় অনেকের অন্য কিছু করার থাকে না। ওমর আলীরও হয়ত ছিল না। কিন্তু বিশেষত ষাটের দশকের বাংলাদেশের কবিতায় গ্রাম, গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ রুচি ও সংস্কৃতির বয়ান অন্য কথাও বলে। এই কথার নাম জাতীয়তাবাদী চেতনা।

পূর্ব বাংলা চল্লিশের দশকে ছিল এক অবিকশিত খণ্ডের নাম। এই অবিকশিত রূপ প্রকটিত ছিল এই অঞ্চলের জীবন-যাত্রায়, নগরায়ণে, চিন্তায় আর সংগত কারণেই শিল্পসাহিত্যেও। একারণে লক্ষ করা যায়, বাংলাদেশের সাহিত্যের শুরুটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছিল গ্রামীণ জীবন নির্ভর। উপন্যাসের দিকে তাকালে বিষয়টি বেশি স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে এসে পূর্ব বাংলায় দেখা দেয় আধুনিক বুর্জোয়া চেতনা-ঋদ্ধ এক প্রজন্ম। এই সময় নতুন রাজধানী ঢাকায় নানা নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দেখা দিতে থাকে। গড়ে ওঠে নতুন আমলাতন্ত্র। শুধু তাই নয়, ঢাকায় গড়ে উঠতে থাকে নতুন নতুন বিপণিবিতান, দালানকোঠা, আবাসন ব্যবস্থা। মোটকথা, ঢাকা ক্রমে ঢুকতে থাকে নগরজীবনের বাস্তবতার মধ্যে। একারণে পঞ্চাশের দশকের প্রজন্মের শিল্পসাহিত্য সহজেই অঙ্গীকৃত করে নিয়েছে আধুনিক জীবনচেতনা। ব্রাকেটে বলে রাখা দরকার যে, এই আধুনিক জীবনচেতনার কিছু আরোপিত আর কিছু স্বোপার্জিত।

আধুনিক জীবনচেতনার আবির্ভাবের ফলে, এসময় থেকে সাহিত্যে গ্রামীণ জীবন ও এর রূপায়ণ কিছুটা কমতে থাকে। কবিতায় শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক এবং এঁদের প্রজন্মের অধিকাংশই এই তালিকায় পড়বেন। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের পরে বাংলাদেশের রাজনৈতি ঘটনাপ্রবাহ ঘোলাটে হতে থাকে। জাতীয়তাবাদী চেতনা পরিগঠিত হতে থাকে। আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তা প্রকাশ পেতে থাকে।

এই পরিস্থিতিতে অনেক কবির কবিতা ক্রমে নোঙর করতে শুরু করে নতুন এক বন্দরে। জাতীয়তাবাদী চেতনার স্বভাব মোতাবেক অনেক কবির কবিতা ফিরতে শুরু করে গ্রাম-বাংলা ও এর জীবনচিত্রে। এ যেন ভিন্ন এক প্রত্যাবর্তন। কারণ জাতীয়তাবাদী যেকোনো প্রয়াস সাথে রাখতে চায় একটি জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষকে। ব্যাপক মানুষের একত্রকরণ ছাড়া জাতীয়তাবাদী চেতনা সফলভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে না। পূর্ব বাংলা যেহেতু গ্রামপ্রধান ভূখণ্ড সেহেতু এর জাতীয়তাবাদী জাগরণের সঙ্গে গ্রামকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে এই জাগরণ ব্যর্থ হতে বাধ্য ছিল। একারণে আমরা লক্ষ করি, ষাটের দশকের পুরোটায় এমনকি পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকেই যেন পরিকল্পিতভাবেই অনেক কবিতায় গ্রামীণ জীবন রূপায়িত হওয়া শুরু করেছে। গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া মানুষকে কোনো কোনো কবি তাঁদের চিন্তার কেন্দ্রে স্থাপন করতে চেয়েছেন। দাবি করেছেন, তাঁর কাব্য-কবিতা-চিন্তার কেন্দ্রে আছে গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ।

ফলে ষাটের কবিতায় গ্রাম এক গভীর রাজনৈতিকতায় উঠে আসতে থাকে। এই উঠে আসাটা কৃষকজীবনের সঙ্গে কবির শুধু রোমান্টিক আবেগে যুক্ত হওয়ার বিষয় নয়। কবির কবিতায় গ্রামে ফিরে যাবার ব্যাকুলতা, গ্রামীণ জীবনের স্মৃতিকাতরতা প্রকাশিত হতে থাকে রাজনৈতিকভাবে। গ্রামীণ রুচি ও সংস্কৃতিও একই রাজনৈতিকতায় বাক্সময় হয়ে ওঠে। সমালোচকের ভাষায়, 'স্বদেশের মাটি মানুষের উপলব্ধি ষাটের দশকের কবিতার অপর একটি প্রধান সুর।' (মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ, সমকালীন বাংলা সাহিত্য, সম্পাদক খান সারওয়ার মুরশিদ, এশিয়াটিক সোসাইটি অব  বাংলাদেশ, ঢাকা) 

সমালোচকের এই উক্তি ষাটের দশকের কবিকুল নিয়ে হলেও প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকে এসে ক্রিয়াশীল চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের কবিদের মধ্যেও এই একই চেতনার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। কারণ ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশধারায় সব কবি-সাহিত্যিকই পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই লক্ষ করি ষাটের দশকে রচিত একটা বড় অংশ কবিতা জাতীয়তাবাদী জাগরণের ধাক্কায় গ্রামীণ জীবন আর গ্রামীণ প্রকৃতিকে আত্মস্থ করেছে। 

গ্রামীণ জীবনের প্রতি আকর্ষণ, গ্রামীণ চৈতন্যের প্রকাশ, গ্রামীণ সাহিত্য-ঐতিহ্যের প্রতি টান প্রদর্শন পঞ্চাশের দশকের শেষাংশে ও ষাটের দশকের কবিতায় শুধু নিরীহ গ্রামপ্রিয়তার ব্যাপার নয়। এর মধ্যে সংস্কৃতির লড়াইটাও যুক্ত রয়েছে। পূর্ব বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির বিপরীতে ষাটের দশকে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী চেতনার অনুকূলে সাংস্কৃতিক তোড়জোড় লক্ষ করা গিয়েছিল। সেই তোড়জোড়ের জবাব লক্ষ করা যায় বাঙালি কবিদের গ্রামপ্রধান পূর্ব বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির কোল ঘেঁষে লেখা কবিতাগুলোর মধ্যে। ফলে ওমর আলীর কবিতা কেবল গ্রামীণ রুচির কবিতা হিসেবে আর পাঠ করা যায় না। তার কবিতা- অন্তত ষাটের দশকে রচিত তিনটি কাব্যগ্রন্থের কবিতা- রাজনৈতিক চেতনার সাথে যুক্ত করে পাঠ করতে হয়। পাঠ করতে হয় সাংস্কৃতিক লড়াই-সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে।

উদাহরণ হিসেবে লক্ষ করা যাক ওমর আলীর নদী কাব্যগ্রন্থের 'পালং' কবিতাটি- 'গভীর রাত্রে গজারী গাছের তলে/হোমরা বেদের প্রেতাত্মা বুঝি কাঁদে,/আকাশের চোখ সমবেদনায় বুঝি গলে,/শিশিরের ফোটা গড়ায় আর্তনাদে।/মাটির দরজা মুক্ত অন্ধকারে,/দুজনে তখন নির্জন নদী পাড়ে,/নদের কণ্ঠ উজ্জ্বল ফুলভারে,/পেলব কান্তি মহুয়ার সাদা হাড়ে।/রাত্রে রূপসী যৌবন পায় ফিরে,/আলেয়ার মতো হয়ত বা জ¦লে ওঠে,/জোনাকীরা চলে তাকে ও নদেকে ঘিরে,/সুজনের ঘোড়া সেদিকে দাপটে ছোটে।' রাজনৈতিক ইতিহাস-ঐতিহ্য নয়, স্রেফ সাহিত্যিক ঐতিহ্যের উল্লেখ ওমর আলীর অনেক কবিতাকে ষাটের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক করে তুলেছে। যা কিছু পূর্ব বাংলার নিজস্ব তাই নিয়েই ষাটের ওমর আলীর কবিতা অহংকার করেছে। পূর্ব বাংলার সাহিত্যিক ঐতিহ্য ময়মনসিংহ গীতিকার উল্লেখ সেই অহংয়েরই প্রকাশ বটে।

এভাবে ষাটের দশকে আধুনিকতার প্রবল প্রতাপের মধ্যে কবিতার মধ্যে গ্রাম ঢুকে পড়েছে তার সংস্কৃতিসহ। ষাটের কবিতার গ্রামে নোঙর করার ব্যাখ্যা জাতীয়তাবাদী চেতনা ছাড়া আর কী দিয়ে সম্ভব! ষাটের দশকের কবিতায় একদিকে আধুনিক কাব্যরুচি, প্রকরণ-প্রকৌশল এবং অন্যদিকে গ্রামীণ অনুষঙ্গের প্রবেশ দেখে বলা যায়, ষাটের কবিতা বর্মে আধুনিক-নাগরিক-স্মার্ট কিন্তু মর্মে তার গ্রামীণ জীবন-পিপাসা। কেন এমন? এই প্রশ্নের উত্তর ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ইতিহাসের মধ্যেই অনুসন্ধেয়। ওমর আলীর ষাটের দশকে রচিত কবিতাবলির রাজনৈতিকতাও তাই ষাটের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মধ্যেই খোঁজা যেতে পারে বলে মনে করি।

পরিশেষে বলা যায়, ওমর আলীর ষাটের দশকে রচিত কবিতাবলির একটা নিরীহ নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে। এবং এটাও জানি ওই রস-সম্ভোগী ব্যাখ্যাই হয়ত প্রধান হয়ে উঠেছে তার কবিতার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে। কিন্তু একথা তো অস্বীকারের উপায় নেই যে, ষাটের উত্তাল সময়ে বাঙালি যখন নিজের দিকে তাকিয়ে আত্ম-আবিষ্কারের নেশায় মত্ত হয়েছিল তখন ওমর আলীর একটি কবিতাই হয়ত হাজার মানুষের একটি মিছিলের চেয়েও উদ্দীপনাময় মনে হয়েছে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের আগুনে এই কবিতাবলি যে ঘি ঢেলেছিল তাতে সন্দেহ কী! 

যেমনটি জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা নাকি বাংলার মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা যুগিয়েছিল। কিন্তু একথা বলা অবশ্যই জরুরি যে, ওমর আলী যে চেতনার প্রকাশের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের কবিতার জগতে পা রেখেছিলেন সেই চেতনার ভেতরেই ঘুরে ঘুরে নিঃশেষ হয়েছেন। এমনকি বলা ভালো প্রথম দিককার নিজের সার্থকতার ব্যর্থ অনুকরণের ভেতর দিয়ে তার কাব্য অভিযাত্রাটি শেষ করেছেন। একারণে তিনি বাংলাদেশের কবিতায় হঠাৎ আলোর ঝলকানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছেন। নিজেকে বিচিত্র উত্তীর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। তবু ওমর আলীকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস রচিত হতে পারে না। কারণ, নিজেকে জানতে আর নিজের দিকে চোখ ফেরাতে ওমর আলী অতীতের মতো এখনো আমাদের সাহস আর শক্তি যোগান।

Comments

The Daily Star  | English

Nahid warns against media intimidation, vows stern action

The government will take stern action against those trying to incite violence or exert undue pressure on the media or newspapers, said Information Adviser Nahid Islam today

2h ago