চাদর ট্রেক: বরফ ঢাকা নদীর উপর হাঁটা
দিনটি ছিল জানুয়ারির এক হাড় কনকনে শীতের রাত। দিল্লি থেকে লেহ যাওয়ার প্রথম ফ্লাইটে উঠতেই রাত প্রায় শেষ হতে চলেছে।
আমাদের বিমানটি যখন লাদাখের আকাশসীমায় প্রবেশ করে তখন ভোরের গোলাপি আভা আমার চোখের সামনে। এই গোলাপি আভা সকালের রোদের জন্য পথ তৈরি করে দিচ্ছিলও। আর সেই আভায় বরফে ঢাকা পাহাড়গুলো সোনার মতো জ্বলজ্বল করছিল।
অবশেষে, আমার বরফের নদীতে হাঁটার স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হতে চলেছে!
এই স্বপ্নের সূচনা প্রায় বছর চারেক আগে। ট্রান্স-হিমালয়ের মাঝখানে অবস্থিত একটি অঞ্চল 'ঝাঁসকার' এর উপর নির্মিত একটি ডকুমেন্টারি দেখার পর আমার স্বপ্ন দেখা শুরু।
ডকুমেন্টারিটিতে ওই এলাকার কিছু অনাবিষ্কৃত ভূখণ্ডের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখানো হয়। শীতের সময় যে পথটি অঞ্চলটিকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে সেটি তুষারপাত হয়ে পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ওই অঞ্চলে বসবাসরতরা যে অসুবিধার সম্মুখীন হয় সেটিও ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয়। ডকুমেন্টারিটিতে এটিও দেখানো হয়েছে যে, কীভাবে সেখানকার মানুষেরা দৃশ্যত দুর্গম ল্যান্ডস্কেপের মধ্য দিয়ে তাদের পথ খুঁজে বের করার শিল্পকে আয়ত্ত করেছে। এটি এতটাই অনুপ্রেরণামূলক ছিল যে, দেখার পর থেকে আমি এই সুন্দর ট্রেক সম্পর্কে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।
দেশের বৃহত্তম ভ্রমণ গোষ্ঠী 'ট্রাভেলার্স অফ বাংলাদেশ' (টিওবি) কে ধন্যবাদ স্বপ্ন পূরণ করার জন্য। গ্রুপের সব অ্যাডমিন বিশেষ করে আনিকা, রাব্বি ভাই, ফয়সাল ভাই এবং মরিদুল ভাই প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন।
ঝাঁসকার উপত্যকায় একটি ভয়ঙ্কর সবুজরঙা নদী সুউচ্চ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে গেছে যা গভীর গিরিখাতের মধ্য দিয়ে লাদাখের সিন্ধু নদীর সঙ্গে মিলিত। শীতকালে যখন তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি অবস্থায় পৌঁছে তখন নদীর উপর বরফের পুরু স্তর তৈরি হয়। স্থানীয়রা এই স্তরটিকে 'চাদর' বা কম্বল বলে থাকে। যুগ যুগ ধরে, তারা এই বিপজ্জনক চাদরের মধ্য দিয়ে ভ্রমণের শিল্পটি আয়ত্ত করেছে। তারা ইয়াক (তিব্বতের লোমশ গরু জাতীয় প্রাণী), পনির এবং পশম বিক্রি করতে শহরে যায় এবং লবণের মতো প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে। এমনকি এখানকার ছোট বাচ্চারাও লাদাখের অন্যান্য জায়গার স্কুলে যাওয়ার জন্য ঝাঁসকার উপত্যকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে এই দীর্ঘ এবং বিপজ্জনক যাত্রার ঝুঁকি নেয়।
আমি এই ঐতিহাসিক ট্রেক করতে লাদাখের সবচেয়ে বড় শহর লেহ-তে ছিলাম।
ট্রেকটি ছিল একটি প্রাচীন পথ জুড়ে যা একসময় বিখ্যাত সিল্ক রোডের অংশ ছিল। এই ভ্রমণটিতে, প্রত্যন্ত লাদাখি গ্রামে যাওয়ার, থাকার, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এবং কাছাকাছি থেকে তাদের জীবন অভিজ্ঞতা নেওয়ার সুযোগ আছে।
আমরা লেহ শহরে ৪ দিন অবস্থান করে শহরটি ঘুরে দেখি। লাদাখের স্থাপত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি 'তিব্বত' দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। এই শহর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ এখনও সেই অনন্য ঐতিহ্য বজায় রেখেছে।
পঞ্চম দিন সকালে, বাংলাদেশ থেকে আসা আমরা ৫ জন, আমাদের গাইড এবং সব সরঞ্জামসহ একটি ছোট ট্যুরিস্ট বাসে যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের গন্তব্য ছিল ঝাঁসকার নদীর তীরে অবস্থিত 'তিলাত সুমদো' নামের ছোট্ট একটি গ্রাম।
কারগিল হাইওয়ে ধরে লেহ থেকে ৩ ঘণ্টা পথ চলার পর আমরা নিমোতে পৌঁছলাম। এখানেই ঝাঁসকার নদী সিন্ধু নদীর সঙ্গে মিলেছে। সেখান থেকে প্রায় আধাঘণ্টা পর আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছলাম।
আমি রাস্তা থেকে ২০০ ফুট নামার পর প্রথমবারের মতো হিমায়িত ঝাঁসকার নদীতে পা রাখলাম। এটাকে কিভাবে বর্ণনা করবো? আমি আমার পায়ের নীচে দ্রুত প্রবাহিত নদীর ক্রুদ্ধ গর্জন শুনতে পাচ্ছিলাম। এই অনুভূতি যেমন রোমাঞ্চকর তেমনি ভীতিকরও!
যত তাড়াতাড়ি আমি বরফের উপর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম, আমি বুঝতে পারলাম যে কাজটি মোটেও সহজ নয়। সূর্যের তাপ বরফের বাইরের স্তরকে গলিয়ে অত্যন্ত পিচ্ছিল করে তুলেছিল। নদীর ওপারে পৌঁছতে আমাকে পেঙ্গুইনের মতো হাঁটতে হয়েছে।
আমরা এক ঘণ্টার ট্রেক করার পরে আমাদের প্রথম ক্যাম্পসাইটে পৌঁছেছিলাম, আমি একরকমভাবে পাতলা বরফের উপর হাঁটা শিখেছিলাম। নদীর ধারে আমাদের তাবু টানলাম। লোকালয় থেকে অনেক দূরে, সুউচ্চ পাহাড়ে ঘেরা বিশাল শূন্যতায় নেমেছে দীর্ঘ শীতের রাত।
পরদিন সকালে প্যানকেক এবং কার্গিলের বিখ্যাত নোনতা চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন আমাদের অনেকটা দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়েছিল। আমাদের গন্তব্য ছিল শিংড়া কংমা যা ১০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে!
কয়েক ঘণ্টা হাঁটার পর, নদীটি হঠাৎ সরু হয়ে যায়। যার ফলে বরফের আস্তরগুলো প্রবল স্রোতে ভেসে যেতে থাকে।
আমাদের কয়েকবার নদী ছেড়ে খাড়া পাহাড় বেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। কিছু জায়গায়, পাহাড়ের পাশে জমে থাকা খুব সরু এবং পাতলা বরফের চ্যানেলগুলো উপর দিয়ে আমাদের রীতিমতো হামাগুড়ি দিতে হয়েছিল।
বরফে হাঁটার সময় প্রতিটি ধাপে ভয়ংকর শব্দ হচ্ছিলো যেন এই বুঝি বরফ ভেঙ্গে ঠাণ্ডা নদীতে পড়ে যেতে হয়!
পরের দিন, আমাদের গন্তব্য ছিল 'তিব্ব' যা আরও ১২ কিমি দূরে অবস্থিত। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমরা প্রবেশ করলাম বরফের জলপ্রপাত রাজ্যে। ভ্রমণের এই অংশটা ছিল সবচেয়ে সুন্দর। যেন এক দুষ্ট যাদুকর যাদু করে সবকিছু হিমায়িত করে দিয়েছে।
এই জলপ্রপাতগুলোর মধ্যে একটি পাহাড়ের মাঝখানের এক গুহা থেকে বের হয়েছে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করে যে, এই জলপ্রপাতটি সরাসরি মানস সরোবর থেকে নেমে এসেছে।
তারপর আমরা নদীর সংকীর্ণ অংশে এলাম। আমাদের সাঙ্গু নদী যেমন আন্ধারমানিকের দিকে সরু হয়েছে, তেমনি এখানে ঝাঁসকা নদীর প্রস্থ ছিল মাত্র ৮ ফুট। এই স্থান পেরিয়ে আমরা আমাদের গন্তব্য 'তিব্ব'-এ পৌঁছলাম।
নদীর তীর থেকে প্রায় বিশ ফুট দূরে একটি বিশাল গুহা পাওয়া গেল। আমরা ভেতরে ক্যাম্প করছিলাম। রাতে গুহার মুখে বিশাল আগুন জ্বলে উঠল। উষ্ণ গুহার ভেতরে ভাত আর ভাজা টুনা দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে আমাদের বেশ ভালো একটা ঘুম হয়েছিল।
আমাদের ট্রেইলের শেষ গন্তব্য ছিল তিব্ব থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ঝাঁসকার নদীর তীরের একটি প্রাচীন গ্রাম নেরাক। নদীর উপর বরফের আবরণ বেশ পুরু হওয়ায় ট্রেকটি মোটামুটি সহজ ছিল।
আমাদের গন্তব্যের কাছাকাছি বরফ পড়া দেখেছি। আমরা নদীর উপর একটি কাঠের ঝুলন্ত সেতু দেখতে পাচ্ছিলাম। সামনে জুনিপার গাছের সঙ্গে সারিবদ্ধ বরফে ঢাকা একটি প্রশস্ত উপত্যকা ছিল। ওই মুহূর্তে দৃশ্যটি ছিল শ্বাসরুদ্ধকর।
নদীর ধারে ২ থেকে ৩টি পাথরের ঘর। ট্রেকাররা এখানে আসে এবং রাত্রি যাপন করে। নেরাকের মূল গ্রামটি নদীর তীর থেকে প্রায় ২ হাজার ফুট উপরে। আমরা সেখানে পাথরের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিলাম।
লাদাখে প্রবেশের পর এটি ছিল পুরো ভ্রমণের সবচেয়ে শীতল রাত। তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ২৫ ডিগ্রি। সঙ্গে করে নিয়ে আসা সব জামাকাপড় পরেও আমরা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারছিলাম না। সূর্য ওঠার জন্য এত অধীর আগ্রহে আগে কখনো অপেক্ষা করেছি বলে মনে হয় না।
পরের দিন সকালে সূর্য উঠলো এবং জাদুর মত ঠাণ্ডা দূর করে দিলো। সেদিন আমাদের রিজার্ভ ডে ছিল। কিছুক্ষণ পর, আমরা গ্রাম দেখতে গেলাম যা ছিল একগুচ্ছ পাথরের ঘর।
গ্রামের প্রবেশ পথে ছাউনি দিয়ে ঢাকা একটি বিশাল ধর্মচক্র ছিল। অনেক দূর থেকে গানের সুর ভেসে আসছিল।
গ্রামে পৌঁছে জানলাম সেখানে উৎসব চলছে। গ্রামের সবাই পাথরের তৈরি দোতলা বাড়ির খোলা বারান্দায় জড়ো হয়েছিল। কয়েকজন ঢোল ও বাঁশি নিয়ে লাদাখি গান বাজাচ্ছিলো। গ্রামের যুবক-যুবতীরা সেই সুরের তালে নাচছিলেন। গ্রামবাসীরা আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা তাদের সঙ্গে অংশ নিলাম।
ঝাঁসকার সংস্কৃতিকে এত কাছ থেকে দেখতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো।
ঝাঁসকার জুড়ে হাঁটা আমাকে এক অন্যরকম আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা দিয়েছিল। আরো কয়েকদিন এখানে থাকলে ভালো হতো। কিন্তু একই পথ ধরে পরের দিন আমাদের ফিরতি যাত্রা শুরু করতে হলো।
কখন যেতে হবে?
চাদর ট্রেক জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে হয়। তবে, বরফ সাধারণত জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে নিরাপদে হাঁটার জন্য যথেষ্ট স্থিতিশীল হয়ে যায়। আমরা ৭ দিনে রাউন্ড ট্রিপ শেষ করেছি। যদি এই অঞ্চলটি ঘুরে দেখতে চান তবে আপনি আরো কয়েক দিনের ট্যুরের ব্যবস্থা করতে পারেন।
কীভাবে যাবেন এবং খরচ?
সরাসরি ফ্লাইট নয়াদিল্লিকে লেহ থেকে সংযুক্ত করে এবং ট্রাভেল এজেন্সিগুলো সাধারণত বিমানবন্দর থেকে আপনাকে হোটেলে নামানোর এবং তারপর আপনাকে আপনার ট্রেকিং সাইটে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। এই ভ্রমণে প্রত্যেকের ৬০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। গ্রুপের আকার এবং ট্রেক চলাকালীন আপনার যে সুযোগ-সুবিধা থাকবে তার উপর নির্ভর করে খরচ পরিবর্তিত হবে।
অনুবাদ করেছেন ফাবিহা বিনতে হক
Comments