ইমো প্রতারণার শিকার হচ্ছেন গ্রিসপ্রবাসী বাংলাদেশিরা

ইমো
গ্রিসপ্রবাসী বাংলাদেশি ইয়াকুব আলীর স্ত্রীর ইমো নম্বরে পাঠানো প্রতারকের মেসেজ। ছবি: সংগৃহীত

গত ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সময়  সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে গ্রিসপ্রবাসী বাংলাদেশি ইয়াকুব আলীর ইমো নম্বর থেকে দেশে তার স্ত্রীর ইমোতে একের পর এক মেসেজ আসতে থাকে। তখন  গ্রিস সময় সকাল ৭টা ৩৬ মিনিট।

মেসেজে বলা হয়, 'আমি ঝামেলায় পড়ছি, আমাকে পুলিশে ধরেছে। এখান থেকে ছাড়া পেতে বাংলা ৩০ হাজার টাকা লাগবে। কী হলো কিছু বলছ না কেন, আমার হাতে সময় খুব কম, কতক্ষণ লাগবে? তাড়াতাড়ি জানাও, আমাকে খুব মারছে।'

মেসেজে একটি বিকাশ নম্বর দিয়ে ৩০ হাজার ৬০০ টাকা দ্রুত পাঠিয়ে দিতে বলা হয় ইয়াকুবের স্ত্রীকে, না হলে তাকে ১ বছরের জন্য জেল দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।

তবে মোবাইল ফোন কাছে না থাকায় তাৎক্ষণিক মেসেজগুলো দেখেননি ইয়াকুবের স্ত্রী। কিছুক্ষণ পর স্বামীর ইমো নম্বর থেকে কল আসে তার ফোনে। 

তিনি কল রিসিভ করলে অপর পাশ থেকে বলা হয়, 'আপনার স্বামীকে পুলিশে ধরেছে। তাকে ছাড়াতে চাইলে শিগগির ওই নম্বরে ৩০ হাজার ৬০০ টাকা বিকাশে পাঠান, নয়তো এক বছরের জন্য জেলে দেবে।'

এ কথা বলে দ্রুত কল কেটে দেন ওই অচেনা ব্যক্তি। ইয়াকুবের স্ত্রী স্বামীর ইমো নম্বর থেকে আসা মেসেজগুলো দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তবে আগের রাতে স্বামীর সঙ্গে আলাপে কোনো ঝামেলার আভাস পাননি তিনি। তাই কিছুটা সন্দেহ জাগে তার মনে।   

তখনই গ্রিসে থাকা অন্য আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ইয়াকুবের স্ত্রী। তখন জানতে পারেন, তার স্বামীকে পুলিশ আটক করেনি, তিনি ভালো আছেন। ইয়াকুবের হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়ে কথা হলে বুঝতে পারেন যে স্বামীর ইমো হ্যাকারের কবলে পড়েছে।

প্রতারণার শিকার হওয়ার কথা জানাতে গিয়ে প্রবাসী ইয়াকুব আলী বলেন, '৮ সেপ্টেম্বর গ্রিস সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে "বিডি অ্যাম্বাসি" লেখা একটি নম্বর থেকে কল আসে আমার ইমোতে। অচেনা ব্যক্তিটি বলেন, "আপনার নম্বর বন্ধ কেন? আপনাকে অনেকবার কল দিয়েও পাচ্ছি না"। আমি বলি, "আমার সিম তো চালুই আছে"। তখন অপর প্রান্ত থেকে বলে, "তাহলে লাইনে থাকেন, আমি কল দিয়ে দেখি"।'

'এ কথা বলার পর একটি নম্বর থেকে কল দেয় আমার মোবাইল ফোনে। তখন আমাকে বলে, "এখন তো কল যাচ্ছে"। আমি বললাম যে কল এসেছে। তখন ওই অচেনা ব্যক্তি বলেন, "আমার যে নম্বর থেকে কল গিয়েছে তার শেষ ৪ সংখ্যা কত"। আমি "বিডি অ্যাম্বাসি" মনে করে সরল মনে তা বলে দেই। উনি পরে কল দিচ্ছি বলে রেখে দেন।'

পরে ইয়াকুব জানতে পারেন যে তার স্ত্রী ছাড়াও আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুসহ বিভিন্ন মানুষের কাছে তার ইমো থেকে মেসেজ দিয়ে টাকা চেয়েছিল ওই প্রতারক। অবশেষে তিনি ইমো নম্বরটি ডিলিট করে দেন।

এভাবেই প্রবাসীদের ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। ইয়াকুবের মতো কেউ হয়তো ভাগ্য বা বুদ্ধির জোরে বেঁচে গেলেও, অনেকে সরলতার কারণে ফাঁদে পা দিচ্ছেন। তেমন একজন গ্রিসপ্রবাসী নজরুল ইসলাম। ইমো প্রতারণার ফাঁদে পরে প্রতারক চক্রকে টাকা দিয়েছেন তার বোন।

নজরুল ইসলাম বলেন, 'ইমো কলে দূতাবাস কর্মকর্তা পরিচয়ে একজন প্রবাসী কল্যাণ কার্ড বানানোর জন্য আমার নাম তালিকাভুক্তির কথা জানান। এজন্য মোবাইল নম্বর নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধনের জন্য একটি কোড পাঠিয়ে শেষের ৪ সংখ্যা জানতে চাইলে আমি বিশ্বাস করে দিয়ে দেই। এরপরই আমার একাউন্ট হ্যাক হয়।'

প্রতারকরা নজরুলের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ ৩০-৩৫ জনের কাছে টাকা ধার চেয়ে মেসেজ পাঠায়। তার মধ্যে একজন ছিলেন দেশে থাকা তার ছোট বোন। বিকাশ নম্বর দিয়ে পাঠানো মেসেজ লেখা ছিল, 'আপা আমি খুব বিপদে আছি। আমার ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন, তাড়াতাড়ি দিলে খুব উপকার হবে।'

প্রবাসী ভাই বিপদে পড়েছে মনে করে বোন বিকাশে ২০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন।

গত ৩-৪ বছর ধরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো গ্রিসেও এমন ইমো প্রতারণার ঘটনার শিকার হচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। 

গ্রিসে বাংলাদেশি কমিউনিটি নেতা খালেক মাতুব্বর বলেন, 'প্রায়ই এমন প্রতারণার ঘটনা আমরা জানতে পারি। কেউ বেঁচে গেছেন, কেউ ফাঁদে পড়ে টাকা খুইয়েছেন। প্রতারক চক্র অজানা, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।'

জানা যায়, চক্রের সদস্যরা ইমোর মাধ্যমে প্রবাসীদের নম্বর সংগ্রহ করে পরে একটি ওয়ানটাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) পাঠান। নানা অজুহাত দেখিয়ে কৌশলে ওটিপি নিয়ে সেই ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে। তারপর দ্রুত সেই অ্যাকাউন্ট থেকে ঘনিষ্ঠজনদের কল বা মেসেজ দিয়ে বিপদের কথা বলে আর্থিক সহায়তা চাওয়া হয়।

ফাঁদে পড়ে প্রবাসে থাকা অনেক নারীও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়েছেন। ইমোতে গোপন ছবি ও রেকর্ড করা কণ্ঠ ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে প্রতারকরা হাতিয়ে নিচ্ছে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ।

সরল প্রবাসীদের সঙ্গে প্রতারণা করতে ব্যবহার করা হয় নানা কৌশল। বাংলাদেশ দূতাবাসের নাম ব্যবহার এমন এক কৌশল। দূতাবাসের নামে ইমো আইডি ব্যবহার করে কিংবা দূতাবাসের কর্মকর্তা পরিচয়ে দিয়ে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা চালায় প্রতারক চক্র।

ইমো প্রতারণার ফাঁদ থেকে রক্ষা পাওয়া আরেক প্রবাসী স্বপন তালুকদার বলেন, 'বিডি অ্যাম্বাসি নামের আইডি থেকেই আমিও কল পাই। কলার খুব সুন্দরভাবেই কথা বলেছিলেন। মনে হচ্ছিল উচ্চশিক্ষিত কারও সঙ্গে কথা বলছি। নিশ্চয়ই তিনি বাংলাদেশ দূতাবাসের কোনো কর্মকর্তা।'

তবে ফোনে শেষের ৪ ডিজিট চাইতেই স্বপন তালুকদারে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে তিনি প্রতারকের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছেন। বলেন, 'আমি এতই বোকা নই যে আপনার ফাঁদে পা দেবো।'
এ কথা শুনে লাইন কেটে দিয়েছিল প্রতারক।

বিষয়টি এথেন্সে বাংলাদেশ দূতাবাসের নজরেও এসেছে এবং এরই মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ। 

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, 'বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে এ রকম কোনো ফোন করা হচ্ছে না। দূতাবাস থেকে ফোন করে কখনো কোনো কোড চাওয়া হয় না।'
মিনিস্টার ও দূতালয় প্রধান মোহাম্মদ খালেদ বলেন, 'এ ধরনের প্রতারণার ক্ষেত্রে প্রবাসীদের সচেতনতার বিকল্প নেই। আমরা সে দিকেই বেশি জোর দিচ্ছি। বিজ্ঞপ্তি ছাড়াও কমিউনিটির সমাবেশ-অনুষ্ঠানগুলোতে বিষয়টি তুলে ধরে প্রবাসীদের সচেতন করার চেষ্টা করা হয়।'

'স্মার্ট ফোনের পাসওয়ার্ড বা কোড নম্বর কারও সঙ্গে শেয়ার না করা, নিশ্চিত না হয়ে টাকা পাঠানোর ব্যাপারে নিজের পরিবার ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের সচেতন করার জন্য প্রবাসীদের প্রতি আমরা অনুরোধ করছি। আশা করছি নিজেদের স্বার্থেই তারা সতর্ক থাকবেন,' যোগ করেন তিনি। 
বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন গ্রিসের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস বলেন, 'আইন-কানুন দিয়ে এসব অজানা প্রতারকদের ধরা খুব কঠিন। প্রবাসীদের সচেতন করেই তাদের ঠেকাতে হবে।'

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে কি না বা হ্যাক হলে হ্যাকারের তথ্য 'অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি' অপশনে ঢুকে ম্যানেজ ডিভাইসে ক্লিক করলেই জানা সম্ভব।

লেখক: গ্রিসপ্রবাসী সাংবাদিক
 

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

3h ago