ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: শতবর্ষের আলোর নিচে অন্য অন্ধকার

হোটেলে রুটি ভাজতে ব্যস্ত শাওন। ছবি: স্টার

১০ বছর বয়সী শাওনের ব্যস্ততা সারাদিনের। ব্যস্ততা থাকে দিন গড়িয়ে রাতেও। দিনের আলো ফোটার পরপরই তার কাজ শুরু হয়। কখনো কখনো কাজ শেষে ঘুমাতে যায় মধ্যরাতে।

সারা দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজ করা শাওনের ৪ মাস আগেও পরিশ্রম বলতে ছিল ছোটাছুটি, বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলে বেড়ানো। মাদারীপুরের কালকিনিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তো সে।

আর ৮-১০ জন শিশুর মতোই বেড়ে উঠছিল সে। ভ্যানচালক বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় সংকটে পড়ে যায় শাওনের পরিবার। বাধ্য হয়ে বড় ভাই জীবনের (১৬) হাত ধরে রোজগারের সন্ধানে নামতে হয় ছোট্ট শাওনকে।

মো. শাওন এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের একটা রুটির দোকানে কাজ করে। তার দিন শুরু হয় ভোরে। দোকান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা থেকে শুরু করে পানি টানা, রুটি তৈরি, খাবার পরিবেশন করার মতো কাজগুলো তার দায়িত্ব। কেউ হলের রুমে খাবার চাইলে দিয়ে আসতে হয় শাওনকে। মাস শেষে ৪ হাজার টাকা পায় সে।

খাবার পরিবেশন থেকে শুরু করে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার সব দায়িত্ব এই শিশুদের ওপরই। ছবি: স্টার

মাঝে মাঝে তার মনে পড়ে পুরনো দিনগুলোর কথা। এখন চাইলেও খেলার সময় পায় না সে, নদীতে গোসল করতে যেতে পারে না। ছকে বাধা বন্দি জীবনে মন পড়ে থাকে বাড়িতে।

প্রতিদিন দল বেঁধে ড্রেস পরে স্কুলে যেতে ভালো লাগতো তার।

'কাজের পাশাপাশি সুযোগ পেলে পড়তে চাই', সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলে শাওন।

এই চাওয়া শাওনের পাশাপাশি আরও অন্তত ২০০ শিশুর। এই শিশুরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্যানটিন, মেস, দোকান ও বাসা-বাড়িতে কাজ করে। উচ্চশিক্ষার আলো ছড়ানো শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ যেন এক অন্ধকার অধ্যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব শিশুদের আশ্রয় ও কাজ দিতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু তাদের শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব কার, সেটি অজানা।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২টি স্কুল পরিচালনা করে, আশপাশে বেসরকারি অন্তত ২টি প্রতিষ্ঠান পথশিশুদের পড়ায়। কিন্তু শাওনদের এসব স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয় না, ফুরসত মেলে না।

শাওনের বড় ভাই জীবন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তো। সে ঢাকায় এসেছে ৯ মাস আগে। বাবার অসুস্থতার দরুন ২ ভাই অর্থ উপার্জন করে। ছোট কাঁধে তাদের বাবা-মা আর এক বোনের বড় দায়িত্ব।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯টি আবাসিক হল এবং এগুলোর শতাধিক দোকানের বেশিরভাগ শ্রমিক শিশু। যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে।

দ্য ডেইলি স্টার এমন অন্তত ২০ জন শিশুর সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের বেশির ভাগই জানায়, পরিবারের আর্থিক সংকটে পড়ে কাজ করতে এসেছে। কিন্তু তাদের মালিকেরা পড়ার সুযোগ দেবে কি না সেটা নিয়ে তারা নিশ্চিত নয়।

তাদের কারো বাবা নেই, কারো মা নেই। পরিবারের সংকটের কথা ভেবে পড়াশোনা ছেড়ে কাজ করছে তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আহমদ শরীফ অধ্যাপক চেয়ার শিক্ষক ও প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম মো. ফজলুল হক বলেন, 'শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত করা বৈধ নয়— এমন বিধান থাকলেও দেশের সর্বত্র শিশুশ্রম আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও এর বাইরে নয়। এর প্রধান কারণ হলো দরিদ্রতা। ঝুঁকিপূর্ণ অনেক শ্রমের তুলনায় এখানে কাজের পরিবেশ ভালো হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষ চাইলে করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত ক্যান্টিন মালিক বা দোকান মালিকদের জন্য শর্ত রাখা, যেন শিশুদের কাজ করার পাশাপাশি পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়। সর্বোপরি এ ব্যাপারে সরকারেরও এগিয়ে আসা উচিত।'

প্লেট-গ্লাস ধোয়ার কাজে ব্যস্ত এক শিশু। ছবি: স্টার

সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার সার্ভে ২০২১ এর তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশুশ্রমিক রয়েছে, যাদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কয়েকটি স্কুল পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। এ রকম একটি স্কুল হিউম্যান সেইফটি ফাউন্ডেশন-১। তাদের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ৪টি স্কুল পরিচালনা করছে। সপ্তাহে ৪ দিন উদ্যানের একটি অংশে খোলা আকাশের নিচে পথ শিশুদের পড়ালেখা করান তারা।

এই স্কুলে পড়ে পথশিশু জিনিয়া। জিনিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলে, 'আমি বড় ভাইয়াদের কাছে পড়ি। আমার সঙ্গে আরও অনেকে পড়ে। ভাইয়ারা আমাদের অনেক আনন্দের সঙ্গে পড়ান। পড়া শেষে খাবারও দেন।'

স্কুল বাচ্চাদের পড়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী অসীম তালুকদার। তিনি বলেন, 'উদ্যান ও টিএসসিতে অনেক পথশিশু ফুল বিক্রি করে। তাদের কাছে গিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলে পড়তে আগ্রহী হয়। স্কুলে আসলে খাবারের ব্যবস্থা করি। যাতে তারা নিয়মিত আসে। এরা তো শিশু। তাদের আগ্রহ ধরে রাখতে খাবারের আয়োজন।'

এ স্কুল পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন ফিরোজ হাসান। তিনি জানান, ৩৫-৪০ জন পথশিশু তাদের স্কুলের তালিকাভুক্ত। এই স্কুলে যারা পড়ে, তাদের বেশির ভাগ টিএসসি ও এর আশেপাশে ফুল বিক্রি করে।

তারা ক্যানটিন বয়দের সুযোগ দিতে পারে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের মূল লক্ষ্যই যারা শিশু কিন্তু পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত রয়েছে, তাদের পড়ালেখা শেখানো। ক্যানটিনের শিশুরা কাজের মধ্যে আটকে থাকে। পড়াশোনার সুযোগ কম পায়। তারা যদি আগ্রহী হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা তাদের পড়ানোর উদ্যোগ নেবো।'

শাওনের মতো জীবন পার করছিল রানাও (১৪)। চাঁদপুরের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে সে। তার বাবা একজন কৃষক। অল্প জমিতে চাষাবাদ করে যা উৎপাদন করে, তা দিয়ে সংসার চলে না রানাদের। এর মধ্যে ঋণগ্রস্ত হয়ে আর্থিক চাপে পড়ে তাদের পরিবার। যে কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেয় সে। কাজ করতে চলে আসে হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের ক্যানটিনে। কিন্তু পড়াশোনার করতে এখনও আগ্রহী রানা। সুযোগ পেলে কাজের পাশাপাশি পড়তে চায় বলে জানায় রানা।

শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আবদুর রহিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মানবিক দিক থেকে এসব শিশুদের পাঠদানের সুযোগ দেওয়া যেতেই পারে। নিজ নিজ হলের শিক্ষার্থীরাও চাইলে তাদের পড়াশোনা শেখানোর উদ্যোগ নিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি কোনো উদ্যোগ নেয়, আমরা সহযোগিতা করবো।'

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আব্দুস শহীদ মাহমুদ বলেন, 'উন্মুক্ত স্থানে যেসব শিশু কাজ করে, তাদের তুলনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব শিশু কাজ করে তাদের কাজে ঝুঁকি একটু কম। এসব শিশুদের পড়ানোর উদ্যোগ যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ নেয়, তাহলে নিঃসন্দেহে এটা খুব ভালো উদ্যোগ হবে।'

বিষয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি এসব শিশুদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।

উপাচার্য জানান, বিষয়টি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রভোস্টদের বৈঠকে তুলবেন। তবে গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে এসব শিশুদের টেকনিক্যাল শিক্ষার ব্যবস্থা করার পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, 'এই শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। আমরা যদি তাদের টেকনিক্যাল শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারি, তাহলে তারা খুব দ্রুত কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে পারবে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমি যখন ছাত্র ছিলাম, তখনও হলগুলোতে এমন শিশুদের ক্যানটিনে ও দোকানে কাজ করতে দেখতাম। তারা আর্থিক সংকটে পড়ে এখানে কাজ করতে আসে।'

Comments

The Daily Star  | English

From gravel beds to tourists’ treasure

A couple of decades ago, Panchagarh, the northernmost district of Bangladesh, was primarily known for its abundance of gravel beds. With thousands of acres of land devoted to digging for the resource, the backbone of the region’s rural economy was based on those natural resources.

13h ago