র‍্যাবের ‘সাজানো’ সেই মামলার তদন্ত করছে খোদ র‍্যাবই

র‍্যাব

র‍্যাবের বিরুদ্ধে একটি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজির মামলা সাজানোর যে অভিযোগ উঠেছে, সেই মামলার তদন্ত শুরু করেছে খোদ র‍্যাবই।

চলতি বছরের ৭ মার্চ রাজধানীর মিরপুরে এক কিশোরের মোটরসাইকেলের ধাক্কায় আহত হন এক বৃদ্ধ। কিন্তু ওই ঘটনায় মামলা হয় চাঁদাবাজির। র‌্যাবের করা এ মামলায় আসামি করা হয় গুমের শিকার এক লোকের কিশোর ছেলেসহ ৮ শিক্ষার্থীকে।

যে বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা সাজানোর অভিযোগ, সেই বাহিনীই এর তদন্ত করলে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে কি না—তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।

মামলায় অভিযুক্ত এক কিশোরের মা সাহিদা বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মিথ্যা মামলা তারাই (র‌্যাব) সাজালো, এবার তারাই সেই মামলার তদন্ত করছে। তাহলে কীভাবে আমরা বিচার পাবো?'

এদিকে মামলার তদন্তভার পল্লবী পুলিশের কাছ থেকে র‍্যাব-৪ এ হস্তান্তরের পর 'প্রচন্ড চাপে' আছেন বলে জানিয়েছেন মামলার বাদী।

গত ২৫ জুলাই দ্য ডেইলি স্টার 'র‍্যাবের অভিযানের পর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা হয়ে গেল চাঁদাবাজির মামলা' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

এর আগে মে মাস থেকে এই ঘটনাটি নিয়ে অনুসন্ধান করছিল দ্য ডেইলি স্টার। এর অংশ হিসেবে বাদী, বিবাদী, সাক্ষীসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে ডেইলি স্টার।

মামলার নথি থেকে জানা যায়, এই মামলার তদন্তভার চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে জুন মাসে আবেদন করে র‍্যাব।৩ জুলাই মামলাটির তদন্তভার পল্লবী থানা থেকে র‍্যাব-৪ এ হস্তান্তর করার জন্য মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার বরাবর চিঠি দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ক্রাইম ডিভিশন। 

মামলাটির আগের তদন্ত কর্মকর্তা পল্লবী থানার উপ-পরিদর্শক আনোয়ারুল ইসলাম জানান, গত ২৫ জুলাই র‍্যাব-৪ মামলাটির সব নথিপত্র (ডকেট) বুঝে নেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‍্যাব-৪ অধিনায়ক মোজাম্মেল হক গত ১ আগষ্ট দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারা মামলার ডকেট বুঝে পেয়েছেন। তিনি বলেন, 'এই মামলাটির তদন্ত এখন আমরা করব। মামলার বাদীর সঙ্গে আমরা এ বিষয়ে কথা বলেছি।'

৭ মার্চ সন্ধ্যায় মিরপুর ১২ নম্বর এলাকার বায়তুর রহমান জামে মসজিদের সামনে এক কিশোরের মোটরসাইকেলের ধাক্কায় আহত হন আব্দুল বারেক (৬০)।

কিন্তু ঘটনার ৩ দিন পর র‌্যাব ৪ এর মামলার খসড়ায় পুরো ঘটনাটিকে অন্যভাবে বর্ণনা করা হয়।

এতে দুর্ঘটনা বা বাইকারের কোনো উল্লেখ নেই। সেখানে ৮ কিশোরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৫ জন কলেজের ও ৩ জন স্কুলের শিক্ষার্থী।

এদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা হলো, 'তারা চা বিক্রেতা বারেককে মারধর, আহত করে ৪০ হাজার ৫০০ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে।'

অভিযুক্ত ৩ স্কুলশিক্ষার্থীর মধ্যে একজন 'গুমের' শিকার মোহন মিয়ার ১৫ বছর বয়সী কিশোর ছেলে। অন্যজন মোহনের ফুফাতো ভাই ও তৃতীয়জন ওই পাড়ার এক কিশোর।

এই ৩ জনের মধ্যে একজন মামলার দেড় মাস পর র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয় এবং জামিনে বেরিয়ে আসে। বাকি ২ কিশোর গ্রেপ্তার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।

জানা যায়, মোহন মিয়া ২০১৮ সালে 'গুম' হন। মিরপুর ২ নম্বর এলাকার একটি জমি নিয়ে স্থানীয় একজনের সঙ্গে মোহন মিয়ার বিরোধ চলছিল। মোহন মিয়ার বাবা জমশের আলী এবং স্থানীয় ব্যক্তিদের ভাষ্য, এ কারণেই 'নিখোঁজ' হন তিনি। তাদের ধারণা, জমি নিয়ে বিরোধের এই ঘটনায় র‌্যাবের কয়েকজন সদস্য তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।

জমশেরের বিরোধী পক্ষের প্ররোচনায় র‍্যাব মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই কিশোরদের 'শিক্ষা দিতেই' চাঁদাবাজির মামলা করা হয়েছে বলে তারা মনে করছেন।

দুর্ঘটনায় আহত বৃদ্ধ বারেকের ছেলে নাজমুল হোসেন বাপ্পী মামলার বাদী। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে চেয়েছিলাম।'

তার দাবি, তিনি নিজে মামলার এজাহার সম্পর্কে জানতেন না। র‌্যাবের লিখে দেওয়া মামলার বিবরণীতে তিনি কেবল সই করেছেন।

বাপ্পীর অভিযোগ, মামলার আগে ৮ জুলাই রাত থেকে র‌্যাব তাকে ও অভিযুক্তদের মধ্যে ৫ জনকে পাইকপাড়ার র‌্যাব- ৪ এর কার্যালয়ে প্রায় ২৪ ঘণ্টা আটকে রেখেছিল। সেখানে খসড়া করা মামলার কাগজে সইয়ের পর ৯ মার্চ রাতে তাদের সবাইকে পল্লবী থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে গিয়ে ৫ শিক্ষার্থীকে পুলিশে হস্তান্তর করে র‍্যাব।

১০ মার্চ পল্লবী থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়।

এদিকে মামলা দায়েরের কয়েক ঘন্টা পর ওইদিনই বাদী বাপ্পী নিজেই আদালতে একশ টাকার স্ট্যাম্পে একটি হলফনামা দাখিল করেন। সেখানে তিনি বলেন, 'এই মামলার আসামি ৫ শিক্ষার্থীর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির কারণে ওই মামলার উদ্ভব হয়। পরবর্তীতে বাদী-বিবাদীসহ এলাকার গণ্যমান্যদের মধ্যস্ততায় আপস-মীমাংসা হয়। এই মামলা থেকে আসামিরা জামিনে মুক্তি পেলে এবং পরবর্তীতে মামলা থেকে খালাস পেলে বাদীর কোনো আপত্তি থাকবে না।'

বাপ্পী জানান, ডেইলি স্টারে রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই র‍্যাবের পক্ষ থেকে তাকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, 'ইতোমধ্যে (র‌্যাব) আমার বাবার কাছ থেকে তাদের মত করে স্টেটমেন্ট নিয়েছে। র‍্যাব-৪ থেকে অফিসাররা সিভিল ড্রেসে আমাকে খুঁজতে আসে...'।

মামলার তদন্তভার র‍্যাবে যাওয়ার পর র‍্যাব-৪ নতুন করে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত আব্দুল বারেকের যে জবানবন্দি নিয়েছে। এতে বলা হয়েছে ৫ কলেজছাত্র ৭ মার্চ বেপোরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে তার গায়ের উপর তুলে দেয় এবং দেশি অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তার হাত ভেঙে দেয়।

র‍্যাব-৪ এই জবানবন্দি নিয়ে তা ১৬৪ ধারায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য গত ৩১ জুলাই আদালতে আবেদন জানিয়েছে।

মামলার বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা র‍্যাব-৪ এর উপপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাদী বা তার পরিবারের ওপর এ ধরনের চাপ প্রয়োগের অভিযোগ ভিত্তিহীন।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা মামলাটি তদন্ত করছি। সম্প্রতি, আমরা সিআরপিসির ১৬১ ধারায় বাদীর বাবার কাছ থেকে একটি জবানবন্দি নিয়েছি।'

এদিকে ডেইলি স্টারে প্রতিবেদন প্রকাশের পর র‌্যাবের বিরুদ্ধে মামলা 'সাজানোর' যে অভিযোগ এসেছে তা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে র‍্যাব সদরদপ্তর।

ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে মামলার বাদী, বাদীর বাবা, আসামি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন র‍্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের তদন্ত কর্মকর্তারা।

Comments

The Daily Star  | English

5 dead bodies recovered from launch in Meghna

The incident had occurred on the Meghna river under Chandpur Sadar upazila in an area adjacent to Shariatpur

33m ago