‘আদিম’ নিয়ে যুবরাজ যাচ্ছেন মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে
সিনেমা বানাতে গিয়ে পরিচালককে আটক হতে হয়েছে পুলিশের হাতে, ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে শুনতে হয়েছে 'ডিজিটাল ধান্দাবাজি' শুরু করেছেন। শেষ পর্যন্ত সেই সিনেমাটিই যাচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মূল আসরে প্রতিযোগিতা করতে।
বাংলাদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতা যুবরাজ শামীমের প্রথম চলচ্চিত্র 'আদিম' নির্বাচিত হয়েছে ৪৪তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'প্রাগৈতিহাসিক' উপন্যাসের ভিখু চরিত্রের অনুপ্রেরণা নিয়ে টঙ্গীর ব্যাংকের মাঠ বস্তির বাসিন্দাদের জীবনের গল্প থেকে তৈরি হয় আদিম সিনেমার চিত্রনাট্য। সিনেমাটিতে অভিনয়ও করেছেন বস্তির বাসিন্দারাই। তাদের মধ্যে কেউই পেশাদার অভিনয়শিল্পী নন।
যুবরাজ শামীম বলেন, 'সিনেমার প্রয়োজনেই বস্তির বাসিন্দাদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছি। অভিনয় করার জন্য তাদের রাজি করা বেশি কঠিন ব্যাপার ছিল। সিনেমার কাজ যখন শুরু হলো তখনও নানা ধরনের সমস্যায় পরতে হয়েছে তাদের নিয়ে।'
শুটিং শুরুর আগে হয় রিহার্সাল। কিন্তু শুটিংয়ের সময় অনেকে অভিনয় করতে অপারগতা প্রকাশ করেন, অনেকে আবার এমন পারিশ্রমিক চান যা তার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। আলোচনা করে অনেক বুঝিয়ে শেষ করা হয় সব দৃশ্যায়ন।
এমনকি কলাকুশলীদের ব্যক্তিগত সমস্যার কারণেও ভুগতে হয়েছে যুবরাজকে। পারিবারিক অশান্তির কারণে সিনেমার একটি চরিত্রে অভিনয় করা সোহাগী খাতুন একবার আত্মহত্যাও করতে গিয়েছিলেন।
শুধু কলাকুশলী নয়, যুবরাজকে সমস্যায় পড়তে হয়েছে পোস্ট প্রডাকশন পর্যন্ত সিনেমা বানানোর প্রতিটি ধাপেই। আর্থিক সমস্যা তার মধ্যে অন্যতম।
২০১৭ সালে মাঝামাঝি সময়ে সিনেমার কাজ শুরু করেন যুবরাজ। সিনেমাটি অর্থায়নের জন্য ফেসবুকে পোস্ট দেন এর শেয়ার বিক্রি করতে। শুটিং শুরু হয় ২০১৮ সালে।
ফেসবুকে সিনেমার শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেওয়ার পর যুবরাজকে শুনতে হয়েছে তিনি শুরু করেছেন 'ডিজিটাল ধান্দাবাজি'। অর্থ সংকটের পাশাপাশি এমন মন্তব্য তাকে হতাশ করেছে, মানসিক চাপে ফেলেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিছপা হননি তিনি।
যুবরাজ বলেন, 'কেউ শেয়ার কিনলেই সেই টাকা দিয়ে শুটিং করতাম। ফারুকী ভাই শেয়ার কিনেছেন। অপরিচিতদের মধ্যে অশোক দত্ত নামের একজন ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তার ইচ্ছে ছিল সিনেমা নির্মাণের, কিন্তু পারেননি। তাই এই সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হলেন। এভাবেই সবার সহযোগিতায় সিনেমাটি নির্মাণ হয়েছে।'
অর্থায়নকারী সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'প্রায় ৫০ জন সিনেমাটির শেয়ার কিনেছেন। চুক্তি অনুযায়ী সবার টাকা ফেরত দেবো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। এই মানুষগুলোর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।'
শুটিংয়ের সময় বস্তির কিছু মানুষের অসহযোগিতার কথা জানিয়ে যুবরাজ বলেন, 'মোবারক মাস্টার নামে একজন আমাকে প্রচণ্ড সহযোগিতা করেছেন। তিনি না থাকলে আমার পক্ষে কাজটা শেষ করা সম্ভব হতো কি না জানি না। একবার তো আমাকে পুলিশ আটক করে মাদক চোরাকারবারি মনে করে। কেউ নিশ্চই সেভাবেই পুলিশকে জানিয়েছিল। তখন সেখানকার কিছু মানুষ পুলিশের কাছ থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নেন। তারা বলেন যে আমি মাদক চোরাকারবারি নই, সিনেমা বানাচ্ছি। আমাকে সাংবাদিক মনে করে সেখানকার মাদক চোরাকারবারিরা খুব সমস্যা করেছে। তারা মনে করেছে, তাদের গোপন তথ্য মনে হয় ফাঁস হয়ে গেল।'
'সিনেমায় মাদক সেবনের দৃশ্য আছে এটা কোনোভাবে জানতে পেরে অনেকেই বলতে থাকেন আমি মাদক বিক্রেতা। পরে ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পেরেছেন, আমরা একটা ভালো কাজ করছি, তারা আমাদের বিশ্বাস করতে শুরু করেন,' যোগ করেন তিনি।
আদিম সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাদশা মিয়া। এ ছাড়াও, সোহাগী, দুলাল মিয়া, সাদেকসহ অনেকেই রয়েছেন সিনেমাটিতে।
এই সিনেমার টিম ছিল ৩ জনের। তাদের মধ্যে ক্যামেরায় ছিলেন আমির হামজা, ক্যামেরা সহকারী আনন্দ সরকার এবং পরিচালক যুবরাজ।
গত ৯ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব কর্তৃপক্ষ জানায় মূল প্রতিযোগিতায় আদিম সিনেমা থাকার বিষয়টি।
যুবরাজ জানান, চলতি বছরের ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবেও শর্টলিস্টে ছিল 'আদিম'। তবে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় জায়গা হয়নি। এ ছাড়াও আরও কয়েকটি উৎসব থেকে আমন্ত্রণ পাচ্ছে 'আদিম'।
২৬ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব। যুবরাজ ছাড়াও সিনেমাটির নির্বাহী প্রযোজক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান অংশ নেবেন এই আসরে। আগামী ২৭ আগস্ট মস্কো যাওয়ার কথা রয়েছে তাদের।
Comments