ভাতে মারবো না, সেন্সরে মারবো

অদ্ভুত এক উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। কিসের উট? ভাবমূর্তির উট। উট তো মরুভূমি ছাড়া চলতে পারে না। আমাদের নাতিশীতোষ্ণ সুজলা-সুফলা সাংস্কৃতিক অঙ্গনও তাই এখন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে এই উটকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য।

নানান মহলের চাপে এখানে আর জন্ম নিতে পারে না সবুজ কোনো গাছ। ভুলে যদি দুয়েকটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, সেন্সর বোর্ডের খড়গহস্তে সেটাকেও আর বাড়তে দেওয়া হয় না। ঠিক এমনই ভাগ্য বরণ করতে হচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা আমাদেরই সিনেমা 'শনিবার বিকেল'কে। যার লেখক, পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

এই মুহূর্তে বিশ্বের চলচ্চিত্র মানচিত্রে মননে তরুণ যে কয়জন দেশি চলচ্চিত্র নির্মাতা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, দেশের নাম উজ্জ্বল করছেন তাদের মধ্যে সম্ভবত অগ্রগণ্যই থাকবেন ফারুকী। ইতোপূর্বে তার নির্মিত কোনো চলচ্চিত্র দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তাকে কোনো রকম ঝুঁকিতে ফেলেছে—এই কথা তার শত্রুও বলার ধৃষ্টতা দেখাবেন না। বরং এইসব ভিন্ন ন্যারেটিভের সিনেমার কারণে বিশ্ব বাংলাদেশকে চিনেছে নতুন আলোয়। বিশ্বের বড় বড় শিল্পী তার সিনেমায় যুক্ত হয়েছেন সাগ্রহে।

কিন্তু তার ছবিকে প্রায় প্রতিবারই এরকম সেন্সরের দীর্ঘসূত্রিতা পার করতে হয়। কেন? বোধ করি এটা এক ধরণের শিক্ষা দেওয়া। ফারুকীর ছবি আটকে বাকি সবাইকে এই শিক্ষা দেওয়া, যেন কেউ অন্যভাবে ভাবতে না পারে। যেন কেউ অন্য বয়ান হাজির করতে না পারে সিনেমার মধ্য দিয়ে। যেন নতুন কোনো স্বর দিয়ে বের না হয় নতুন কোনো স্লোগান। 'শনিবার বিকেল'কে প্রায় সাড়ে ৩ বছর সেন্সর বোর্ডের ওয়েটিং রুমে দাঁড় করিয়ে রাখাও সেই কারণেই।

আমরা সিনা উঁচু করে বলি, দেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। অথচ ডিজিটাল যুগে যে সেন্সর বোর্ড নামক এই গুহা যুগের প্রতিষ্ঠানকে কবেই পেছনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, সেই খবর আমরা রাখি না। বিশ্ব এখন ফিল্ম সার্টিফিকেশন প্রথায় চলে। ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ড বয়স অনুযায়ী ফিল্মের সার্টিফিকেট দেয় এবং দর্শক সেই অনুযায়ী ঠিক করে কোন ছবি সে একা দেখবে, কোনটা বান্ধবীকে নিয়ে দেখবে আর কোনটা পরিবার নিয়ে দেখবে। কারণ শিল্পে সেন্সরশিপ চলে না। শিল্প সবসময় বাঁধভাঙা, উন্মুক্ত জোয়ারের মতো। সেই জোয়ারে গা ভেজাবেন, নাকি তীরে দাঁড়িয়ে বাদাম খাবেন—সেই সিদ্ধান্ত একান্তই একজন দর্শকের।

সেন্সর বোর্ড শিল্পীর স্বাধীনতাকে যতটা ক্ষুণ্ণ করে, ঠিক ততটাই দর্শকের স্বাধীনতাকেও ক্ষুণ্ণ করে। শিল্পীকে তো বটেই, একজন দর্শকের বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর আস্থা না রেখে তাকে অপমান করা হয় যখন কোনো ছবি সেন্সর বোর্ডের কতিপয় সদস্য নিজেদের বিবেচনায় ঠিক করেন পাশ করাবেন বা ফেল করাবেন কি না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের অস্ত্র হলো 'ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়া'। আর সেই অস্ত্রের প্রয়োগ এবারো হয়েছে 'শনিবার বিকেলে'র বেলায়।

বিদেশে লাখো কোটি টাকা পাচার হলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় না, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় না, ধরে নিয়ে মুচলেকা নেওয়ার খবর প্রকাশ হলে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় না। কিন্তু সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণায় বানানো দেশি-বিদেশি শিল্পী আর প্রযোজকদের ছবি মুক্তি পেলে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়ে যাবে?

'শনিবার বিকেল' সিনেমার সঙ্গে যে অন্যায় করা হচ্ছে তা নজিরবিহীন। কোনো সিনেমা সেন্সর বোর্ডে জমা দিলে ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে হয়। সেই রিপোর্ট প্রযোজক ও পরিচালকের মনপুত না হলে তারা সেন্সর বোর্ডে আপিল করতে পারেন। আপিলের রায়ও যদি পক্ষে না যায় তাহলে তারা আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু সেন্সর বোর্ডের জন্য ১৫ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও আপিল বোর্ডের জন্য কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া নেই।

এই সুযোগটাই নেওয়া হয়েছে এই সিনেমাকে সাড়ে ৩ বছর ধরে আটকে রাখার জন্য। হাকিম নড়ে, তবু হুকুম নড়ে না। সচিবও বদল হয়েছে এই সাড়ে ৩ বছরে, কিন্তু ছবির ভাগ্য এখনো বদল হয়নি। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯(১) ধারায় পরিষ্কার বলা আছে, চিন্তা আর বিবেকের স্বাধীনতা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সরকারের দায়িত্ব; কোনোভাবেই এর খর্ব করা নয়। নির্মাণের স্বাধীনতা যেমন নির্মাতার অধিকার, তাকে গ্রহণ বা বর্জন করাও দর্শকের অধিকার। এর মাঝামাঝি রাষ্ট্র, সরকার, পুলিশ, সেন্সর বোর্ড কেউই থাকতে পারে না। থাকাটাই অসাংবিধানিক। কিন্তু নানান বাস্তবতায় আমাদের এটাই এখন মেনে নিতে হচ্ছে।

আমরা পাহাড় নিয়ে ছবি বানাতে পারি না, আমরা সরকারি-বেসরকারি দুর্নীতি নিয়ে ছবি বানাতে পারি না, আমরা সাধারণ মানুষের ওপর হরহামেশা ঘটে যাওয়া অন্যায় নিয়ে মানবিক ছবি বানাতে পারি না। কেন? কারণ সেন্সর বোর্ডে বসে কেউ হয়ত ভাবছে 'তোকে ভাতে মারব না, পানিতে মারব না, তোকে সেন্সরে মারবো'। এটা অন্যায়। স্বাধীন দেশে সেন্সরশিপ আরোপ করা শিল্পচর্চার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান'গুলো যতই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার দায়ে অভিযুক্ত করুক না কেন, সেইসব গান এখন আমাদের জাতীয় সম্পদ। এখন আমরা স্বাধীন দেশ, স্বাধীন জাতি। আমরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারি। আমরা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছি কত দ্রুত আমরা আমাদের জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশ হওয়ার অগ্রযাত্রায় ছুটছি।

'শনিবার বিকেল' সিনেমা দেখে আমরা হাসবো নাকি কাঁদবো নাকি ভাববো সেই সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে দেন। ভাবমূর্তি নাকি অভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, সেটা আমাদের বুঝতে দেন। জোর-জবরদস্তি করে আর কাউকে হোক না হোক, এই জাতিকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না, এটা ইতিহাসেই প্রমাণিত। কাজেই অবিলম্বে 'শনিবার বিকেল' ছবির মুক্তি চাই এবং শিল্পে সেন্সরশিপ প্রথা বাতিল চাই।

আশফাক নিপুণ, চলচ্চিত্র নির্মাতা

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Mindless mayhem

The clashes between students of three colleges continued yesterday, leaving over 100 injured in the capital’s Jatrabari.

4h ago