দিন দ্য ডে: ১০০ কোটি গেল কোন চ্যানেলে?

‘দিন দ্য ডে’ সিনেমার পোস্টার।

'দিন দ্য ডে' সিনেমার পরিচালক ও সহ-প্রযোজক মুর্তজা অতাশ জমজম সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে যেটুকু জানা গেল, তিনি মূলত প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের জন্য নিয়মিত কাজ করেন। ২০১৬ সালে তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা 'মেলাংকোলি' দুয়েকটা অনুল্লেখযোগ্য ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়।

'দিন দ্য ডে'র আগে তিনি নির্মাণ করেন 'সিমিন' ও "জুলেখা'স লিভার" নামের আরও দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা। 'সিমিন' দুয়েকটা ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয়। মূলত তিনি একজন স্বাধীন ধারার নির্মাতা। প্রকৃত অর্থে সিনেমায় বিনিয়োগকারী বলতে যা বোঝায়, তিনি তা নন। বড় বাজেটের সিনেমায় বিনিয়োগের মতো আর্থিক সক্ষমতা তার আছে কি না, ইরানের অন্যান্য নির্মাতাদের কাছেও প্রশ্ন রয়েছে। আর্থিক সক্ষমতা থাকলেও পেশাদার অভিনেতা নন এমন দম্পতির ব্যক্তিগত ও বাংলা ভাষার ছবিতে তিনি কেনই বা এত বড় বিনিয়োগের ঝুঁকি নিবেন, পাল্টা প্রশ্ন রয়েছে ইরানের অন্যান্য নির্মাতাদেরও।

এ বছরের জুনে 'দিন দ্য ডে' চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশে সেন্সর সার্টিফিকেট পায়। বিগত দুই-তিন বছর ধরে সংবাদমাধ্যমে এই সিনেমা নির্মাণ নিয়ে আলোচনা ছিল। সেন্সর সার্টিফিকেটের জন্য জমা দেওয়া আবেদনে প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে মুর্তজা অতাশ জমজম এবং এম এ জলিল অনন্তের যৌথ নাম উল্লেখ করা হয়। সেন্সর সার্টিফিকেট হাতে পেয়ে অনন্ত জলিল সংবাদ সম্মেলন করেন ও সিনেমাটি নির্মাণে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ের তথ্যটি প্রকাশ করেন।

অনন্ত জলিলের ঘোষণাটি অনেকের কাছে সিনেমার প্রচারণার অংশ মনে হলেও বাস্তবে ছবিটি যে বড় বাজেটের, তা মুক্তির পর হলের পর্দায় স্পষ্ট হয়েছে। তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে সিনেমাটির শুটিং হয়েছে।

যেহেতু সিনেমাটি সেন্সর সার্টিফিকেট পেয়েছে, যৌথ প্রযোজনা হিসেবে ধরেই নেওয়া যায় নিয়ম মেনেই এটির বাংলাদেশ অংশের খরচ মিটিয়েছেন এই অংশের প্রযোজক অনন্ত জলিল।

কিন্তু, সিনেমার পর্দায় দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে সিনেমার কাজ হয়েছে যৎসামান্যই। এখানে ছবির বাজেটের ১০ ভাগও খরচ হয়নি, নির্মাণ সংশ্লিষ্টদের  এমন ধারণাই হয়েছে সিনেমাটি দেখে। স্পষ্ট হয়েছে বাজেটের ৯০ শতাংশই খরচ হয়েছে বিদেশে। এমনকি ছবির পোস্ট প্রোডাকশনও বাংলাদেশে হয়নি। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠতেই পারে ছবির দৃশ্যমান ও অদৃশ্য খরচ কীভাবে নির্বাহ হলো?

যৌথ প্রযোজনার নিয়ম অনুযায়ী বিদেশে সিনেমার নির্মাণ ব্যয়ের সমুদয় খরচ বিদেশি প্রযোজক ও বিনিয়োগকারীর। সে হিসেবে নির্মাণ ব্যয়ের ৯০ শতাংশ সহ-প্রযোজক মুর্তজা অতাশই বিনিয়োগ করার কথা। আর তা হয়ে থাকলে সিনেমাটির ৯০ শতাংশের মালিক কি সহ-প্রযোজক মুর্তজা বা তার প্রতিষ্ঠান? বিষয়টি নিশ্চয়ই যৌথ প্রযোজনার চুক্তিতে উল্লেখ আছে? কাগজে যৌথ প্রযোজনার নামে অতীতে এ দেশে অনেক অনিয়মের উদাহরণ আছে বলেই প্রশ্নটির উত্তর গুরুত্বপূর্ণ।

দুই পক্ষের বিনিয়োগের সুরক্ষা করতে সাধারণত যৌথ প্রযোজনার সিনেমা একযোগে মুক্তি দেওয়া হয় নির্মাণ সংশ্লিষ্ট দেশসহ অন্যান্য দেশে। এই সিনেমার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটেছে। এটি এখনো ইরান বা অন্য কোনো দেশে মুক্তি দেওয়া হয়নি। সংবাদমাধ্যমকে অনন্ত জলিল জানিয়েছেন, তিনি দেশের মানুষকে সিনেমাটি দেখাতে চান বলে একক সিদ্ধান্তে শুধু বাংলাদেশে এটি মুক্তি দিয়েছেন। আর এতেই সিনেমা পাড়ায় ধারণা পোক্ত হয়েছে যে, ছবির শতভাগ মালিকানা ব্যবসায়ী থেকে অভিনেতা হওয়া অনন্ত জলিলেরই। মুর্তজা অতাশকে কেবল যৌথ প্রযোজনার নিয়ম রক্ষার জন্য সহ-প্রযোজক বা বিনিয়োগকারী দেখানো হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আরও ভয়ংকর যে প্রশ্নটি সামনে আসছে, তার সঙ্গে জড়িত দেশের স্বার্থ ও প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন।

অনন্ত জলিল দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী। তিনি ১০০ কোটি কেন, এক হাজার কোটি টাকা সিনেমায় বিনিয়োগ করতেই পারেন। এতে দেশের সিনেমা শিল্পের উন্নতি হবে। রুগ্ন-প্রায় চলচ্চিত্র শিল্প বড় বাজেটের ছবি পেয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি করবে। দেশি সিনেমায় এরকম বড় বিনিয়োগ আসলে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।

বাংলাদেশে আইনের বিধান সাপেক্ষে ব্যবসা পরিচালনা ও বিনিয়োগের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। এই সিনেমাতেও যদি তিনি ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে থাকেন, নিশ্চয়ই তিনি তার আয়কর ফাইলে দেখিয়েছেন বা দেখাবেন?

তার ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ের ঘোষণা সত্যি হলে প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলার বিগত ২ বা ৩ বছরে তিনি তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তানে খরচ করেছেন। টাকাগুলো নিশ্চয়ই বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তর করে বৈধ পথে অর্থাৎ ব্যাংকিং চ্যানেলে নিয়েছেন? বাংলাদেশ থেকে না নিয়ে থাকলে তৃতীয় কোনো দেশ থেকেও তিনি নিতে পারেন, যদি সেই দেশে তার ঘোষিত আয় থাকে।

অবশ্য রপ্তানিকারক হিসেবে অনন্ত জলিলের কোম্পানির ইআরকিউ (এক্সপোর্টার রিটেনশন কোটা) অ্যাকাউন্ট থাকার কথা এবং সেই অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট পরিমাণ ডলার রক্ষিত থাকা অস্বাভাবিক নয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইআরকিউ অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত বৈদেশিক মুদ্রা কেবল বিজনেস প্রমোশন ও ট্রাভেল এক্সপেন্স হিসেবে খরচ করার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে ইদানিং কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণেও ইআরকিউয়ে গচ্ছিত মুদ্রা বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দিচ্ছে। সম্প্রতি বিদেশে বিনিয়োগে অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিগুলোর নাম দিয়ে তালিকাও প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তাহলে কি অনন্ত জলিল ইআরকিউ অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত বৈদেশিক মুদ্রা সিনেমায় বিনিয়োগ করেছেন? এতে কি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছিল? যদি টাকগুলো তিনি দেশ থেকে না নিয়ে থাকেন, তাহলে বিদেশের কোন সোর্স থেকে পেয়েছেন, তাও তার এনবিআরকে জানাতে হবে আইনানুযায়ী। আর যদি তিনি এই ১২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ না করে থাকেন, তাহলে নৈতিকতার প্রশ্নে তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে তার সহ-প্রযোজক মুর্তজা টাকাগুলো বিনিয়োগ করেছেন। মুর্তজা নিশ্চয়ই তার ট্যাক্স ফাইলে এই বিনিয়োগ তার দেশে দেখিয়েছেন, যদি তিনি প্রকৃত বিনিয়োগকারী হন।

বাংলাদেশে ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট নামের একটা টিম আছে। যে কারো ব্যাংক অ্যাকাউন্টের গতিবিধি ও যাবতীয় তথ্য তাদের আয়ত্তের মধ্যে। এই ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়েছে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মাধ্যমে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা তাদের এখতিয়ার ও কর্ম পরিধির মধ্যেই পড়ে। তার আগে একজন সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে অনন্ত জলিল নিজেই সব প্রশ্নের সুরাহা করবেন বলে বিশ্বাস রাখি। তা না হলে নানা মহত কাজের সঙ্গে জড়িত এবং আর ১০ জন ব্যবসায়ী থেকে আলাদা অনন্ত জলিলের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

জসিম আহমেদ: চলচ্চিত্র নির্মাতা

jahmed@glbangladesh.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Tarique Rahman on preventing dictatorship

Election only way to promptly implement state reforms: Tarique

Urging the government not to take too much time in holding polls in the name of reforms, BNP Acting Chairman Tarique Rahman has said election is the only way to promptly implement the state-overhauling proposals by elected representatives

2h ago