শিক্ষক: দোসরা মারের চেয়ে অস্বীকার উত্তম?

শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা অন্তহীন। উদাহরণ-উপমাও অনেক। এসবের মাঝে 'উচিত শিক্ষা' নামের শিক্ষাটির হাল প্রচলন রেকর্ড গড়ে চলছে। কান ধরে উঠবস করানো, গলায় জুতার মালা দিয়ে ঘোরানো, ঠাঁসা মার, জেলে ঢোকানোসহ নানা কিসিমের নজিরবিহীন শিক্ষার শিকার হয়ে চলছেন শিক্ষককুল। তার ওপর যোগ হয়েছে মার দিয়ে ওই মারের কথা অস্বীকার না করলে ফের মার দেওয়ার চরম শিক্ষাও। রীতিমত আচানক কাণ্ডকীর্তি।

ঘটনাগুলো মামুলি পর্যায়ে চলে যেতে আর তেমন বাকি নেই। শিক্ষক পিটিয়ে মেরে ফেলার রেকর্ডও আর বাকি রইলো না। নানা যুক্তি ও ঘটনার বানোয়াট বর্ণনায় প্রমাণ করে দেওয়া হচ্ছে, এগুলো কোনো ব্যাপারই না। এ ছাড়া এমনসব কাণ্ডকীর্তিতে তেমন ঝুঁকিও নেই। বরং এর বিরুদ্ধে কিছু বলা বা লেখায় মারাত্মক ঝুঁকি। মার খাওয়া শিক্ষকও বলে দিচ্ছেন, না, এমন কিছু ঘটেনি। কেউ মারেনি, নিজেদের মধ্যেই একটু-আধটু ধাক্কাধাক্কি হয়েছে মাত্র!

নিষ্ঠুর-কদাকার এ বাস্তবতায় এখন আর শিক্ষক মারার কাজটিতে তেমন অনিয়ম হচ্ছে না। প্রায় নিয়মিতই হচ্ছে। শিক্ষককে চড়-থাপ্পড়-লাথিসহ পিটুনি, নাজেহাল করে পানিতে ফেলে দেওয়ার সিরিজ চলছে নন-স্টপ। তা কি শিক্ষকরা নিরীহ বলেই? নাকি কোথাও কোথাও সেই উপযুক্ততা তৈরি হয়ে গেছে শিক্ষকদের? তাদের এত এত সংগঠন কোনো রাও করে না। মাঝেমধ্যে প্রতিবাদ আসে একবারে নিয়ন্ত্রিত ডাইসের মধ্যে।

এ মেগাসিরিয়ালে মাইলফলক আনলেন এমপির হাতে মার খাওয়া রাজশাহী গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজা। বেদম মার খাওয়ার পর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংসদ সদস্যের হাতে মারধরের শিকার হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি। কেবল অস্বীকারই নয়, সাংবাদিকদের দোষারোপও করেছেন। মারের কথা স্বীকার না করে আরেক পশলা মার খাওয়া থেকে বেঁচেছেন তিনি। ধরেছেন 'মারের চেয়ে অস্বীকার উত্তম' তত্ত্ব। তা অশিক্ষকের মতো করলেও অবুঝের মতো করেননি। বুঝে-শুনেই করেছেন। কারণ মারধরের বিচার হওয়ার মতো গ্যারান্টি তার কাছে ছিল না। অস্বীকারের বরকতে আরেক দফা মার থেকে তো রক্ষা!

এর আগে, নারায়ণগঞ্জে এমপির নির্দেশে কান ধরে উঠবস করা শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তও পরে বলেছিলেন, এমন ঘটনাই ঘটেনি। মাননীয় বড় ভালো মানুষ। তিনি টুকটাক শাসন করেছেন মাত্র। আর শাসন করা তো তারই সাজে সোহাগ করেন যে। এখনো ক্রিকেটার শাহাদাতের গৃহকর্মীর মতো শিক্ষাগুরুরা বলতে শুরু করেননি যে, এমপি সাহেব মারেননি, আদর করেছেন। চোখের নিচের দাগগুলো কনুইয়ের আদরের দাগ।

নতুন এ রীতি ও তত্ত্বের আওতায় এরপর কে বা কারা পড়বেন, অপেক্ষা করে দেখা ছাড়া আপাতত গতি নেই। তবে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই কত বছর আগে তার 'মেঘ ও রৌদ্র' গল্পে এই দুর্যোগের কথা লিখে গেছেন। গল্পের সেই ব্যক্তির নাম শশিভূষণ। 'মেঘ ও রৌদ্র' গল্পে শশিভূষণের  দুর্গতির সুনিপুণ বর্ণনার সঙ্গে আজকের শিক্ষকদের ঘটনার অনেকটাই মিল। তার মানে এরা যুগে যুগে ছিল, আছে, থাকবে?

ঘটনা কিন্তু মোটেই এমন নয় যে, আজকের শিক্ষকদের শিক্ষার ঘাটতি পড়েছে বা তারা ঠিকমতো শিক্ষা দিচ্ছেন না। শিক্ষকরা অনুচিত কোনো শিক্ষা দিচ্ছেন, তাও নয়। তারা নিষ্ঠুর অনিবার্যতার শিকার। এর অংশ হিসেবেই গলায় জুতার মালা, কান ধরে উঠবস, পিটিয়ে মেরে ফেলা, ফের মারের ভয় দেখিয়ে আগের মার অস্বীকার করানো। মূল্যবোধ ও শিক্ষকের মর্যাদার এসব দৃশ্যায়ন যে বড় ভয়ংকর বার্তা দিচ্ছে, তা বুঝতে মহাশিক্ষিত বা মহাবুঝদার হওয়া জরুরি নয়। সামান্য কাণ্ডজ্ঞানের মানুষের পক্ষেও তা বোধগম্য।

অধঃপতনের মাত্রাগত দিকটা সামনে আরও নানান কিছু ইঙ্গিত করছে। অথচ এগুলোকে সামনে আনা হচ্ছে কেবলই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে। বাস্তবতা হচ্ছে শিক্ষকরা দেশের বিচ্ছিন্ন কেউ নন। মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, নড়াইল, রাজশাহী বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো জায়গা নয়। যাদের হাতে শিক্ষকরা অবিরাম নাজেহাল-নিপীড়িত হচ্ছেন, তারাও দেশ-বিচ্ছিন্ন নন। বরং জাতীয় ও মাননীয় পর্যায়ের মহানরাও আছেন এই পালে।

শিক্ষকের মর্যাদা গোটা বিশ্বেই শত-শত বছরের চর্চা। এ নিয়ে দেশে শিক্ষামূলক কত গল্প-কবিতা, নাটক-সিনেমা! শিক্ষা দিবস, শিক্ষক দিবসসহ নিরন্তর আয়োজন! কিন্তু, কিছুদিন ধরে অবস্থাটা এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যেন শিক্ষকরা কেবল মারই খান। মার ছাড়া আর কিছু খান না তারা। কেন একের পর এক শিক্ষক অপমান, অপদস্থ, অমর্যাদার এ সিরিয়াল? জঘন্যতার বিচারে এসব ঘটনা একটিতে আরেকটি তলিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনার ঘনঘটার মধ্যে রাজশাহী-১ আসনের এমপি ওমর ফারুক তার কার্যালয়ে ডেকে এনে অধ্যক্ষকে ১৫ মিনিট ধরে আচ্ছামতো পেটালেন। গোপনে নয়, প্রকাশ্যে। আরও সাত-আটজন শিক্ষক, অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের সামনে।

কুশিক্ষিতের মতো সহকর্মীর মার খাওয়ার দর্শক থাকলেন শিক্ষকরা। কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড় ও একপর্যায়ে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়েছেন। মারধরের সময় অন্য অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষরা সবিনয়ে চুপচাপ ছিলেন। এখন বলা হচ্ছে তেমন কিছু হয়নি। শিক্ষকরা নিজেরা নিজেরা ধাক্কাধাক্কি করেছেন বলে তথ্য দেওয়ারও অপচেষ্টা চলছে। সেই ধাক্কাধাক্কিতে একজন অধ্যক্ষকে চিকিৎসা নেওয়ার মতো উচ্ছৃঙ্খলতাও কি বিচারের মতো ঘটনা নয়? উচ্ছৃঙ্খলতায় জড়িয়ে পড়া এই মানের ব্যক্তিদের কাছে কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা আশা করা যায়?

নারায়ণগঞ্জে স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে প্রকাশ্যে সবার সামনে কান ধরে উঠবস করানোর পরও অস্বীকারের কাণ্ড ঘটেছে বা ঘটানো হয়েছে। কদিন আগে মুন্সিগঞ্জে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে জেল খাটিয়ে 'উচিত শিক্ষা' দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশে তিনি কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছেন। নড়াইলে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে প্রকাশ্যে জুতার মালা পরিয়ে অপমানের ঘটনাও মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে দক্ষ হাতে। আশুলিয়ায় শিক্ষার্থীই পিটিয়ে মেরে ফেলেছে তার শিক্ষককে। কক্সবাজারের পেকুয়ায় মাদ্রাসায় ক্লাসে ঢুকে ইট দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে এক শিক্ষিকার। এভাবে ঘটনার পর ঘটনার তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে।

কেবল পাঠদান নয়; সত্য কথা বলতে শেখানো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী হওয়ার দীক্ষা দেওয়াও শিক্ষকতার অংশ। এর বিপরীতে 'উচিৎ শিক্ষা'র এই চরম শিক্ষাটা কদাকারের চূড়ান্তে চলে যাচ্ছে। গড়পড়তা ধারণায় মানুষ শিক্ষকদের এ দশা নিয়ে বেদনাহত হচ্ছে। বিপরীত কথাও আটকে থাকছে না। মেরুদণ্ডহীনের পাশে দাঁড়ানো কঠিন কাজ ঠেকছে কারো কারো কাছে। শিক্ষকের মর্যাদা নেতা বোঝেন না। তারা না বুঝলেও নিজের সমস্যা হচ্ছে না। তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিক-মহাজন হয়ে এমন কত শিক্ষকের রিজিক দেন। শিক্ষকরা কি নিজেও বুঝবেন না নিজেদের মান-মর্যাদা? শিক্ষকদের মেরুদণ্ড এভাবে নুয়ে পড়তে থাকলে পিটুনির প্রতিশব্দ 'সম্মান' হয়ে গেলে রুখবে কে?

মোস্তফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

9h ago