ভৈরব কাপড়ের হাট: রাত যত গভীর বেচাকেনা ততই জমজমাট

ভৈরব কাপড়ের হাট। ছবি: সনদ সাহা/ স্টার

সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী রাত ৮টার পর যখন মার্কেট ও দোকানের বৈদ্যুতিক বাতির আলো নিভতে শুরু করে, তখনই একটি দুটি করে বাতি জ্বলতে শুরু করে ভৈরবের মেঘনা নদীর তীরে। সেখানে শুরু হয় ক্রেতা-বিক্রেতাদের আনাগোনা। রাত যত গভীর হয় ততই জমে উঠে বেচাকেনা। এভাবেই ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে ভৈরব লঞ্চঘাট এলাকার সাপ্তাহিক কাপড়ের হাট।
মঙ্গলবার রাত ১০টায় কিশোরগঞ্জের ভৈরব বাজারের লঞ্চঘাট এলাকায় এ হাট শুরু হয়। আর তা চলে বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত।

ভৈরব কাপড়ের হাট। ছবি: সনদ সাহা/ স্টার

সরেজমিনে সাপ্তাহিক রাতের এ হাটে ঘুরে দেখা যায়, ভৈরব বাজারের জিল্লুর রহমান শহর রক্ষা বাঁধ রোড, ভৈরবপুর, বাগানবাড়ি, বাদামপট্টি, নদীরপাড়, ছবিঘর শপিংমল রোড, জামে মসজিদ রোড ও কাচারি রোড জুড়ে এই হাটের ব্যাপ্তি।
টি-শার্ট, জিন্স, শার্ট, জার্সি, লুঙ্গি, গামছা, গেঞ্জি, বোরকা, ওড়না, ছোটদের জামা, পায়জামা-পাঞ্জাবিসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক নিয়ে রাস্তার পাশের ফুটপাত দখল করে বসে এই হাট।
এখানে এসব পোশাকের অন্তত ৫ শতাধিক দোকান আছে। পাইকারি ও খুচরা এসব পণ্যের দাম সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ টাকার মধ্যে। এ কারণে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রেতার সংখ্যাই এখানে বেশি।
ব্যবসায়ীরা জানান, সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জসহ হাওর এলাকার দোকানদাররা পাইকারি দরে কাপড় কিনে এখানে খুচরা দোকানে বিক্রি করেন। এর পাশাপাশি খুচরা ক্রেতারাও আসেন পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় কাপড় কিনতে।

ভৈরব কাপড়ের হাট। ছবি: সনদ সাহা/ স্টার

স্থানীয় বাসিন্দা মো. সাগর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই হাট ৫০ বছরের পুরোনো। আমি তখন অনেক ছোট। তাই এর শুরুটা বলতে পারব না। তবে বাপ-দাদার মুখে শুনেছি যে প্রথমে স্থানীয় কয়েকজন নিজেদের ঘরে বানানো জামা-কাপড় নিয়ে ভোর ৫টা পর্যন্ত বসে বিক্রি করতেন। পরে ধীরে ধীরে পরিচিতি পেতে শুরু করলে এখন এখানে প্রায় ৫০০টির বেশি দোকান নিয়ে হাট বসে।'
'আগে ভোরে হাট জমলেও এখন রাত ৯টা থেকেই হাট জমতে শুরু করে এবং সকাল ১০টা পর্যন্ত বেচাকেনা হয়,' বলেন তিনি।
হাটে শিশুদের জামা বিক্রি করতে আসা কাউছার মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বয়স এখন ৩৮। কিন্তু আমি ছোটবেলা থেকে দাদার হাত ধরে হাটে আসি। দাদা তখন হাটে গামছা বিক্রি করতেন। পরে বাবা করতেন। এখন আমি করছি।'
তিনি বলেন, 'আমার বাসায় ছোট একটা কারখানা আছে। ঢাকা থেকে কাপড় এনে ৬ দিন বাসায় শিশুদের শার্ট তৈরি করি। আর প্রতি মঙ্গলবার রাতে হাটে সেই সেলাই করা শিশুদের শার্ট বিক্রি করি। ৫-১২ বছরের শিশুদের প্রতিটি শার্ট বিক্রি হয় ১২০-১৫০ টাকার মধ্যে। এর লাভের টাকা দিয়ে আমার সংসার চলে।'
তিনি জানান, গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকার বিভিন্ন ছোট ছোট গার্মেন্টসে তৈরি এসব কাপড় ভৈরবের এই হাটে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করা হয়।

ভৈরব কাপড়ের হাট। ছবি: সনদ সাহা/ স্টার

এখানে বেচাকেনা ভালো হওয়ায় ওইসব ছোট কারখানার মালিকরা তাদের উৎপাদিত কাপড় বিক্রির জন্য আসেন বলে জানান তিনি।
নারায়ণপুর থেকে তৈরি করা শিশুদের প্যান্ট নিয়ে হাটে এসেছেন মধ্যবয়সী আসমা বেগম। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতি সপ্তাহে হাটে আসি। ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার বেচাকেনা হয়। তবে আসন্ন কোরবানির ঈদ উপলক্ষে ৬০ হাজার টাকার মতো বিক্রি হয়েছে। আমার মাল কম ছিল। তা না হলে আরও বেশি বিক্রি করতে পারতাম।'
তবে, এখানে প্রতি হাটে কোটি টাকার বাণিজ্য হলেও ইজারাদারদের অতিরিক্ত খাজনা আদায়ে অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিক্রেতা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক রাতের জন্য হাটের ইজারাদাররা খাজনা নেয় ৫০০ টাকা। যাদের দোকান বড়, তাদের কাছ থেকে আরো বেশি। অনেকের কাছ থেকে ১ হাজার টাকাও নেয়।'
'খাজনা কম নিলে আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীদের ভালো হতো। কারণ সব সপ্তাহে বেচাকেনা ভালো হয় না। কোরবানির ঈদ উপলক্ষে এবার বেচাকেনা ভালো হয়েছে। কিন্তু পরের হাটে তেমন বেচাকেনা থাকবে না। তখন পণ্য নিয়ে আসা যাওয়ার খরচই উঠবে না। আমাদের লোকসান হয়,' বলেন তিনি।
ইজারাদারদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত খাজনা নেওয়ার অভিযোগ করেন আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী।
তাদের দাবি, দোকান অনুযায়ী সর্বনিম্ন ৩০০-১০০০ টাকা খাজনা নেয় ইজারাদাররা। তাদের চাহিদা অনুযায়ী খাজনা না দিলে দোকান বসাতে বাধা দেয়।
অনেক সময় ব্যবসায়ীদের মালামাল ফেলে দেওয়া হয় কিংবা মারধরও করা হয় বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।

ভৈরব কাপড়ের হাট। ছবি: সনদ সাহা/ স্টার

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল এলাকা থেকে হাটে আসা মোহাম্মদ আকাশ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানে অনেক কম দামে কিনতে পারি, তাই এই হাটে আসি। কারণ আমি নিজেও স্থানীয় বাজারে ফুটপাতে বসে বিক্রি করি।'
নরসিংদী মনোহরদি থেকে আসা ক্রেতা মো. সানাউল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাতের বাজারে অনেক সময় পণ্য চুরি হয়। তাছাড়া বড় কোনো সমস্যা নেই।'
মাধবপুর থেকে আসা ক্রেতা দুদু মিয়া বলেন, 'এখানে কাপড়ের গুণগত মান নিম্নমানের। এটা আমরা জানি। তাই কম দামে কিনতে পারি। আর এখান থেকে নিয়ে আমরাও অল্প লাভে বিক্রি করি। তাই এই হাটই আমাদের জন্য ভালো।'
জানতে চাইলে ভৈরব চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভৈরবে মঙ্গলবার রাতে কাপড় ও বুধবার সকাল থেকে নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে হরেক রকম পণ্যের দোকান নিয়ে হাট বসে। এই দুই হাটে আড়াই হাজারের বেশি দোকান বসে। এর মধ্যে রাতে কাপড়ের দোকান প্রায় ৫ শতাধিক। সেখানে ১-২ কোটি টাকার পণ্য বেচাকেনা হয়। তাছাড়া দুই হাটে গড়ে ৮-১০ কোটি টাকার বেচাকেনা হয়।'
তিনি বলেন, 'ব্যবসায়ীদের থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করার অভিযোগ আমরা পেয়েছি। তবে সেটা ৩০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু হাটের ইজারা দেয় পৌরসভা। তাই আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না।'
হাটের ইজারাদার আবু বক্কর সিদ্দিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পৌরসভা থেকে দোকান প্রতি ১০০ টাকা খাজনা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা সেটাই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়ে থাকি। কারো কাছ থেকে বেশি নেওয়া হয় না। তবে কেউ যদি দোকান বড় নেয় সেজন্য বেশি নেওয়া হয়। তবে ৫০০-১০০০ টাকা না। এটা যে বলেছে মিথ্যা বলেছে।'
ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মোস্তফা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভৈরব বাজারে পুলিশের ৪টি টিম রাত জেগে টহল দেয়। হাটের দিনও তারা টহল দেয়। আলাদা কিছু থাকে না।'
পণ্য চুরি যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, 'যদি কেউ অভিযোগ দেয় তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এখন পর্যন্ত কোন অভিযোগ পাইনি।'
হাটের ইজারার বিষয়ে জানতে ভৈরব পৌরসভার মেয়র মো. ইফতেখার হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল ও দ্য ডেইলি স্টার পরিচয়ে টেক্সট পাঠানো হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি এবং এসএমএসেরও জবাব দেননি।

Comments

The Daily Star  | English

Mindless mayhem

The clashes between students of three colleges continued yesterday, leaving over 100 injured in the capital’s Jatrabari.

6h ago