শিক্ষকদের ওপর আক্রমণ বন্ধের দাবি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের

শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার (বামে) ও নড়াইলের অধ্যক্ষ। ছবি: সংগৃহীত

সাভারে শিক্ষককে হত্যা ও নড়াইলে কলেজ অধ্যক্ষকে মানহানির ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে শিক্ষকদের ওপর আক্রমণ বন্ধসহ তিনটি দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।

আজ বুধবার দেওয়া এক বিবৃতিতে তারা এ দাবি জানায়।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধন-উৎসবের ডামাডোলে ঢাকা পড়ে গেছে অন্তত দুটি ঘটনা, যা শিক্ষাঙ্গনের জন্য স্পষ্টতই অশনিসংকেত। এই দুটি ঘটনায় শিক্ষক হিসেবে আমরা যারপরনাই ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। নড়াইলে এক কলেজ অধ্যক্ষের গলায় পরানো হয়েছে জুতার মালা। আর সাভারে এক স্কুলশিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে তারই এক ছাত্রের বিরুদ্ধে।

হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিবিদ নূপুর শর্মার বিদ্বেষপ্রসূত সাম্প্রতিক এক মন্তব্যকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয় ভারতে, যার ঢেউ বাংলাদেশেও লাগে। নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক ছাত্র নূপুর শর্মার সমর্থনে ফেসবুকে পোস্ট দেয়। তাতে ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের কাছে ছাত্র রাহুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানায়। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন পরিস্থিতি বুঝে অভিযুক্ত ছাত্রকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু রটে যায় যে তিনি ছাত্রের পক্ষে কাজ করছেন। কলেজের আশপাশের স্থানীয় অধিবাসীরা জড়ো হয় এবং পুলিশের সঙ্গে কিছু সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে থাকে এবং সিদ্ধান্ত হয় অধ্যক্ষ ও ছাত্র উভয়কেই জুতার মালা পরানো হবে এবং তারা হাতজোড় করে ক্ষমা চাইবেন। ১৮ জুন পুলিশের উপস্থিতিতে ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ে এভাবেই অপমানিত হন। ছাত্র এখন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মামলায় কারাগারে আর অধ্যক্ষ নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না, এ-বাড়ি ও-বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে রক্ষা করছেন। এও জানা যাচ্ছে তাকে পদচ্যুত করে আরেকজন শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।

২৫ জুন সাভারের আশুলিয়ার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক উৎপল কুমার সরকারকে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে আহত করে দশম শ্রেণির এক ছাত্র। সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, স্কুলের মেয়েদের ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালে ছাত্রটি হঠাৎ শিক্ষককে স্টাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে। আহত উৎপল কুমার পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, ১৬ বছর বয়সী ছাত্রটি এক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ও স্কুল কমিটির সভাপতির নাতি, অর্থাৎ ধনী ও প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য। পুলিশ তাকে ধরে, জিজ্ঞাসাবাদ করে, ছেড়েও দিয়েছে। অথচ বিষয়টি হত্যাকাণ্ড! এক ছাত্র হত্যা করেছে এক শিক্ষককে।

অধ্যক্ষ স্বপন কুমারের আচরণটি শিক্ষক বা নাগরিকসুলভই ছিল। তিনি ছাত্রকে জনতার হাতে ছেড়ে না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। যদি সে কোনো অপরাধ করে থাকে প্রচলিত আইনে বিচার হবে। কিন্তু তিনি ছাত্রর পক্ষ নিয়েছেন, এই রটনার কারণে তাকে এমন অপমানিত হতে হলো। প্রভাষক উৎপল কুমার স্কুল ও কলেজের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ছিলেন, দায়িত্বের অংশ হিসেবেই উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রদের তার শাসন করতে হতো, তাদের অন্যায়-অপকর্মের জন্য বিচারের মুখোমুখি করতে হতো। বিভিন্ন সূত্র বলছে, ছাত্রটির বিরুদ্ধে শিক্ষক উৎপল কুমারের শৃঙ্খলাজনিত কোনো উদ্যোগ নেওয়ার কারণেই সে বিক্ষুব্ধ ছিল।

দেখা যাচ্ছে শিক্ষকরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনো উচ্ছৃঙ্খল জনতার বা কখনো বিক্ষুব্ধ ছাত্র দ্বারা আক্রান্ত-অপমানিত হচ্ছেন, মৃত্যুবরণ করছেন। শিক্ষকদের যে সম্মান এই সমাজ দিতো একসময়, আজকাল তা তো অপসৃতই সঙ্গে জুটছে সহিংসতা এমনকি মৃত্যুও। আজ এমন এক সমাজ-রাষ্ট্র দেখা দিয়েছে, শিক্ষাব্যবস্থাকে যেনতেন রকমে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তা দিয়ে কেরানি-আমলা হবে, কিন্তু শিক্ষার যে মূল লক্ষ্য, জ্ঞানচর্চা ও মানবিক মূল্যবোধের লালন, সেসবের অস্তিত্ব যেন নেই সেখানে। শিক্ষকদের প্রাপ্য মূল্য-মর্যাদা দিচ্ছে না আজকের সমাজ।

বিবৃতিতে তারা আরও বলেন, আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, আক্রান্ত শিক্ষকরা হিন্দু সম্প্রদায়ের। অন্তত প্রথম ঘটনাটিকে আক্রমণকারী 'সংখ্যাগরিষ্ঠ'রা দেখেছে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে। এর আগে এ বছরের এপ্রিলে মুন্সিগঞ্জের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের ক্লাসের আলোচনাকে গোপনে ধারণ করে অনলাইনে ছড়িয়ে দিয়েছিল তারই ছাত্র। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি ইসলাম অবমাননা করেছেন। ফলে ওই শিক্ষককে কারাবাস করতে হয়। তারও আগে ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে সবার সামনে কান ধরে ওঠবস করান স্থানীয় সংসদ সদস্য।

স্পষ্টভাবে বলা ভালো, সারা দেশেই 'সংখ্যাগরিষ্ঠ' মুসলমানদের অনুভূতি নিয়ে কতিপয় গোষ্ঠীর অসহিষ্ণুতা বিস্তারের অপচেষ্টা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে। এর মাধ্যমে ক্লাসরুম থেকে পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। অল্পতেই তাদের অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু অনুভূতি যতই নাজুক হোক, তার প্রতিক্রিয়া খুবই আগ্রাসী। প্রতি পূজায় এবং সারা বছর ধরে নানান সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে বাংলাদেশে। সামান্য এক ব্যক্তির ফেসবুকের কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় একটি পুরো এলাকায় সাম্প্রদায়িক হামলা করা হয়ে থাকে। সংখ্যাগুরুর দাপটে 'সংখ্যালঘু' জনগোষ্ঠী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে না। তারা যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে। দেশের সংবিধান-আইন-কানুনে যাই লেখা থাক, প্রশাসন ও রাজনীতিবিদরা  'সংখ্যাগরিষ্ঠের' পক্ষেই কাজ করে চলেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের দাবিগুলো হলো—প্রভাষক উৎপল কুমারের হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুততম সময়ে করতে হবে। তার পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং অপরাধীকে গ্রেপ্তার ও বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। জানা গেছে, বাদী এজাহারে আক্রমণকারী ছাত্রের বয়স ১৬ উল্লেখ করলেও তার প্রকৃত বয়স ১৯; অধ্যক্ষ স্বপন কুমারকে সসম্মানে স্বপদে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনকে তার হৃত সম্মান ফিরিয়ে দিতে হবে। যারা ওই অধ্যক্ষকে অপমানের আয়োজন করেছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সারাদেশে ভিন্ন ধর্ম ও জাতিগত পরিচয়ের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আইনকে নিজের গতিতে চলতে দিতে হবে। আর ধর্মের নামে ক্ষমতাবান গোষ্ঠী, রাজনীতিবিদ বা স্থানীয় উন্মত্ত মানুষদের দাবিকে অগ্রাহ্য করে প্রচলিত আইন, মানবিক অধিকার, কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করতে হবে এবং দেশে সব ধর্ম ও মতের মানুষদের জন্য উদার অনুকূল সহনশীল পরিবেশ তৈরিতে সরকার-প্রশাসনসহ সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

4 years could be maximum one can go before election: Yunus tells Al Jazeera

Says govt's intention is to hold election as early as possible

44m ago