‘শিক্ষা হত্যা হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সকলেই নিহত হন’

'শিক্ষা হত্যা হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সকলেই নিহত হন। কেউ মরে, কেউ মেরে।' আমার শিক্ষিকা অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীনের এই ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ লাইনটি সারাদিন ধরে মনে গেঁথে আছে। সত্যিইতো আমরা নানাভাবে শিক্ষাকেই হত্যা করছি, টুঁটি চিপে ধরছি, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করছি। তাতে করে একদিকে যেমন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দিন দিন দুর্বলতর হচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষক সমাজের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।

আশুলিয়ার ঘটনাটা ভীষণ ভয়াবহ। একজন শিক্ষককে যখন দশম শ্রেণির ছাত্র প্রকাশ্যে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে ফেলতে পারে, তখন বুঝতে হবে কিশোরদের মনোজগত নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে। নিহত শিক্ষক উৎপল গত ১০ বছর ধরে আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের কলেজ শাখার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ছিলেন এবং শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

অন্যদিকে একজন শিক্ষকের গলায় জুতার মালা দেওয়া মানে সমগ্র শিক্ষক সমাজের গলায় জুতার মালা পরানোর লজ্জা। একজন শিক্ষককে যখন ছাত্রদের তৈরি মিথ্যা অজুহাতে কারাগারে যেতে হয়, তখন বুঝতে হবে যেকোনো সময়, যেকোনো শিক্ষকের হাতকড়া পরতে হতে পারে। যেকোনো দুর্বিনীত ছাত্র বা ছাত্রী শিক্ষকের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনতে পারে।

নড়াইল মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস বলেছেন, একজন শিক্ষক হিসেবে লজ্জায় তার মাথা নুয়ে আসছে। ৩০ বছর ধরে এই কলেজে শিক্ষকতা করছেন। হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দান করেছেন। কিন্তু এরপরেও তাকে হেনস্থা হতে হয়েছে। তিনি বলেছেন, 'পুলিশ আমাকে কলেজ কক্ষ থেকে বের করে আনে। তখন দুই পাশে অনেক পুলিশ ছিল। এরমধ্যেই স্থানীয়রা আমাকে পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরিয়ে দিল। আমার সঙ্গে যা ঘটে গেল, এখন এই মুখ নিয়ে কি করে আমি কলেজে যাব?'- দোষীদের কোনো শাস্তি হয়নি ঠিকই কিন্তু ঘটনার পর থেকে শিক্ষক স্বপন কুমার পালিয়ে আছেন।

ঘটনাগুলো খুব দুঃখজনক, অনভিপ্রেত ও আশঙ্কার। একটা পরিবার যতই ধনী হোক না কেন, যতই প্রাচুর্য থাকুক না কেন, সেই পরিবারের সন্তান বা অন্য সদস্যরা যদি অশিক্ষিত, অসভ্য, চরিত্রহীন ও লম্পট হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে সেই পরিবার আসলে শূন্য, গৌরব করার মতো তাদের কিচ্ছু নেই। অভিভাবকও দায়িত্বপালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ঠিক তেমনি একটা দেশ কতটা সভ্য সেটা কখনোই অর্থনীতি বা টাকার হিসাবের ওপর নির্ভর করে না, করে তার মানবিক মূল্যবোধের ওপর, ন্যায়সঙ্গত বিচার ব্যবস্থার ওপর।

একজন শিক্ষককে সবার সামনে পিটিয়ে মেওে ফেলা হলো, তখন বাকিরা কী করছিল? নড়াইলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় নির্বিবাদে জুতার মালা পরানো হয়েছে সবার সামনে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে গলায় জুতার মালা পরিয়ে তাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে। পুলিশ-প্রশাসনের উপস্থিতিতে একজন অধ্যক্ষকে জুতার মালা গলায় পরিয়ে ভিডিও করা হলো, এ কেমন ধৃষ্টতা?

এর আগে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মুন্সিগঞ্জের একটি স্কুলে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে। স্যারের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কয়েকজনের পক্ষে-বিপক্ষ কথোপকথনকে এক শিক্ষার্থী রেকর্ড করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল। শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তারের ঘটনা, তাকে জামিন না দেওয়া ও টিপ পরায় কলেজ শিক্ষক লতা সমাদ্দারকে লাঞ্ছনার ঘটনা আমাদেরকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।

ধর্ম বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষ এতটাই স্পর্শকাতর যে কারো বিরুদ্ধে বিশেষ করে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কারো বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনলে মানুষকে সহজে বিশ্বাস করানো যায়। তখন শিক্ষককে জুতার মালা পরানো বা কারাগারে পাঠানো খুব সহজ হয়। সহজ হয় তাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে ফেলা এবং কাজ থেকে এমনকি দেশ থেকে বিতাড়ন করে দেওয়া।

আমরা একবারও ভাবছি না যে, এইসব ঘটনার মাধ্যমে শিক্ষককে মর্যাদাহীন করে ফেলা হচ্ছে। অন্যদিকে ছাত্র নামের গুণ্ডারা সাহস পাচ্ছে শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলার। যে নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ, সুবিধাভোগীরা মনে করছেন এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তাদের বলব এরা একদিন আপনাদের গায়েও হাত তুলতে দ্বিধা করবে না। কারণ 'তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে' এ কথাতো মিথ্যা নয়। যারা অন্যের উস্কানিতে শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলে, অপদস্থ করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এরা কাউকেই ছেড়ে কথা বলবে না।

ধর্ম অবমাননার নামে ভিন্নধর্মের মানুষের গলায় জুতার মালা দেওয়া মানে হচ্ছে সেইসব ধর্মান্ধ অমানুষদেরই সমর্থন করা, যারা ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার মনে করে। আমরা বিজেপির রাজনীতির সমালোচনা করি। কিন্তু ভিন্ন ধর্মের মানুষকে হেনস্থা করা মানে বিজেপির মৌলবাদী মতকেই সমর্থন করা। ভুলে গেলে চলবে না যে ভারতে প্রায় ২০ কেটি মুসলমানের বাস। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যদি সেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ক্ষেপে ওঠে, তাহলে কিন্তু ক্ষতি সবারই।

আমরা ছোটবেলা থেকে শিখেছি বাবা মায়ের পরেই শিক্ষকের স্থান। কোনো শিক্ষক যদি অসদাচরণ করেন, দুর্নীতি করেন, তাহলে নিয়মমাফিক তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ, কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীরা নয়। গলায় জুতোর মালা, শিক্ষককে জেলহাজতে পাঠানো, মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া রীতিমত অন্যায় ও পাপ।

মনে রাখতে হবে জুতোর মালা পরিয়ে বা অন্যকে আঘাত করায় ইসলাম সুরক্ষিত হয় না, মুসলমানের গৌরব বাড়ে না। আমাদের নবীজি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী পড়লে জানা যায় মক্কা বিজয়ের পর উনি কীভাবে অমুসলিমদের ক্ষমা করেছিলেন এবং কাছে টেনে নিয়েছিলেন। মদিনায় হিজরত করার পর উনি দেখেছিলেন সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইহুদী। উনি কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনো বাহাসে যান নাই। শুধু ভালবাসা ও উদারতা দিয়েই ধর্ম প্রচার করেছেন। বিদায় হজের বাণীতেও বারবার বলেছেন অন্য ধর্মের কোন মানুষ যেন একজন মুসলমানের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তার অধিকার যেন ক্ষুণ্ণ না হয়, তাকে তার ধর্মপালনে যেন বাধা দেওয়া না হয়। তাদের ধর্ম তাদের কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে। এমনকি কারো দেব-দেবী সম্পর্কে কুমন্তব্য করাও ইসলামে নিষিদ্ধ।

সেই ইসলামের ঝান্ডা তুলে ধরে ভিন্ন মতের মানুষকে অপদস্থ করা পাপ। ধর্ম অবমাননার কথা বলে এখন যা হচ্ছে তা হলো অপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় আইনকানুনের চরম লঙ্ঘন। সাংবিধানিক অধিকারকে অস্বীকার এবং ইসলামের প্রদত্ত নির্দেশনারও লঙ্ঘন করা হচ্ছে। প্রশাসন এই অপরাধীদের বিষয়ে নির্বিকার থাকতে পারে না।

আল্লাহর শক্তি অসীম। উনি চাইলে মানুষকে ওনার মতো করেই চালানোর ক্ষমতা রাখেন। এরজন্য তুচ্ছ মানুষকে ময়দানে নেমে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরাতে হবে না। ধর্ম সুরক্ষার নামে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা বলে ভিন্ন ধর্মের শিক্ষকদের উপর অত্যাচার করা মেনে নেওয়া যায় না। শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণেই শিক্ষকদের এভাবে অপমানিত হতে হচ্ছে, এ অভিযোগ মেনে নেওয়াই কষ্টের।

বেশ কিছু সাম্প্রতিক ঘটনা খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে দিন রাত যারা মানুষকে উঠতে বসতে নীতিকথা শেখান, দোজখের ভয় দেখান, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ ও বিদেশিদের মদখোর জিনাকারী হিসাবে নিয়মিত গালাগালি করেন, তাদের নিজেদের চরিত্র নিয়ে কিন্তু তারা ভাবেন না। তারা যে কতটা নোংরা, কলুষিত, মিথ্যা ও বিপথগামিতায় নিমজ্জিত তা দেখেন না।

বাংলাদেশে বর্তমানে রাষ্ট্রযন্ত্রের একটা অংশ মনে করে যেহেতু তারা একটা অপরাধ এড়িয়ে যাচ্ছে তাই এটা কোনো অপরাধ নয় বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কারণ এইবারই প্রথম নয় এর আগেও বিভিন্ন ঘটনায় মানুষকে জুতার মালা পরানো হয়েছে, তখনও দোষী ব্যক্তিরা পার পেয়ে গেছে। ফলে কেউকে শায়েস্তা করার জন্য এই পদ্ধতিকে একটি উপায় হিসেবে মনে করছে অপরাধী চক্র।

বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জে মাদ্রাসার শিক্ষক ও মসজিদের ঈমামকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করা হয়েছিল। নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাকে বেধে বিবস্ত্র করে মারধর করা হয়। শিক্ষক সমাজ তখনও বিচার দাবি করেছিল। পিরোজপুরের কাউখালিতে ২০০৯ সালে উপ শিক্ষা কর্মকর্তাকে জুতার মালা পরানোর কাহিনীও আছে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার একটি গ্রামে এক দম্পতিকে মাথা ন্যাড়া করে মারধর ও জুতার মালা পরিয়ে শাস্তি দিয়েছিল গ্রামের মাতব্বররা। গত এপ্রিলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক মারধর ও হেনস্থার শিকার হয়েছেন। আমরা বলতে চাইছি শিক্ষক দোষী হলেও তার গায়ে হাত তোলার অধিকার কোনো শিক্ষার্থীর নেই।

একটি সত্য গল্প দিয়ে শেষ করতে চাই। আমার বড় আব্বা অর্থাৎ দাদার বাবা মৌলভী কাচু বসুনিয়া ছিলেন কয়েকটি তালুকের মালিক। তিনি নিজে পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি বলে তার প্রতিটি সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করেছেন। দাদারা যখন গ্রামের স্কুলে পড়তেন, তখন এলাকার সবচেয়ে দুঁদে যে পণ্ডিত মশাই ছিলেন, তিনি মুসলমানদের ঘরে এসে পড়াতে চাইতেন না।

সেইসময় হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা ছিলেন জাতপাত মানা মানুষ। কিন্তু পণ্ডিত মশাইকে কাচু বসুনিয়া যখন তার সন্তানদের পড়ানোর জন্য আমন্ত্রণ জানালেন, তখন তিনি না বলতে পারেননি। বড় আব্বা তাকে বলেছিলেন, পণ্ডিতজি ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনি শুধু আপনার শিক্ষার আলো দিয়ে আমার সন্তানদের আলোকিত করবেন। আমি আপনার সব দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। কয়েকটি তালুকের মালিক মৌলভী কাচু বসুনিয়া নিজ হাতে পণ্ডিতজীর গ্লাস, বাসন পরিষ্কার করে ওনাকে খেতে দিতেন, যাতে শিক্ষকের সম্মানহানি না হয়।

তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাবেরী গায়েনের এর সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, 'নড়াইলের শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানোকে যদি আমরা নিজেদের গলায় জুতার মালা পরানো মনে না করি, তাহলে আমি শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখি না। আমাদের শিক্ষক সমিতি, শিক্ষক ফেডারেশন, স্কুল ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, শিক্ষামন্ত্রী-উপমন্ত্রীদের কাজটা আসলে কী? এ রকম করে কি এক এক করে শিক্ষকের অপমান চলতেই থাকবে?'

শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Specific laws needed to combat cyber harassment

There is an absence of a clear legal framework and proper definitions when it comes to cyber violence against women, speakers said at an event yesterday.They urged for specific legislation to combat such crimes..The roundtable, titled “Scanning the Horizon: Addressing Cyber Violence agains

2h ago