বিশ্ববিদ্যালয়ে ধনীর সন্তানদের আলাদা বেতন-ফি’র উদ্ভট প্রস্তাব প্রত্যাহার করুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বাড়াতে ধনী পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা টিউশন ফি নির্ধারণের প্রস্তাব এসেছে সিনেট অধিবেশনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বার্ষিক বাজেট পেশের সময় এ প্রস্তাব করেন।

তিনি বলেন, 'ভর্তুকিমূলক উচ্চশিক্ষার সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকা উচিৎ নয়। এই দেশে প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ আয়কর প্রদান করেন। পরোক্ষ করই সরকারের রাজস্বের প্রধান উৎস। এই পরোক্ষ কর ধনী বা দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই দিয়ে থাকেন। দরিদ্রদের প্রদেয় পরোক্ষ করের টাকায় ধনী পরিবারের সন্তানদের প্রায় বিনামূল্যে উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রদান অযৌক্তিক।'

তাই 'অ্যাবিলিটি টু পে' নীতির ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের সব ধরনের ফি নির্ধারণের প্রস্তাব করেন তিনি।

এখানে ২টি বিষয়। প্রথমটি হচ্ছে, ধনী ও গরীবের সন্তানদের জন্য শিক্ষার বেতন-ফি হবে ভিন্ন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, উচ্চশিক্ষার সুযোগ সবার জন্য অবারিত থাকবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এমন প্রস্তাব নতুন নয়। প্রায় ৩ দশক ধরে ঘুরে-ফিরে এই আলোচনা আসছে। শিক্ষার্থীদের চাপ ও রাজনৈতিক কারণে তা পুরোটা কার্যকর হতে পারেনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট, আয় বাড়ানো দরকার—সেটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু সেই আয় বাড়ানোর পথ-পদ্ধতি-নীতি কী হবে সে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। এই আলাপের প্রধান উদ্দেশ্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধি ও নিজস্ব আয়ের উৎস তৈরির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাজমান আর্থিক সংকট দূর করা।

তার আগে জানা দরকার বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টা কী? বিশ্ববিদ্যালয় কি সেবামূলক নাকি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান? যদি এটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হয় তাহলে সেখানে কোনো বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সমীচীন নয়। সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব থাকবে সেবা কার্যক্রমের দৃষ্টিভঙ্গিতেই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা। তবে, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ২০ বছর মেয়াদি (২০০৬-২০২৬) কৌশলপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধি করতে ও সরকারি বরাদ্দ কমাতে চাপ প্রয়োগ করে আসছে। তথাকথিত নয়া উদারনৈতিক ভাবনায় উচ্চশিক্ষাকে সংকুচিত করতেই এই উদ্যোগ। যে কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ কোনো রাখঢাক ছাড়াই বলেছেন। সুতরাং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দরিদ্র-মেধাবীদের পর্যায়ক্রমে ছেঁটে ফেলতেই এই পরিকল্পনা।

সমাজে এমনিতে নানা ধরণের দৃশ্যমান উৎকট বৈষম্য বিদ্যমান। শিক্ষার ক্ষেত্রেও তা আছে। ধনী-গরীবের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কথিত ভালো শিক্ষার্থী-খারাপ শিক্ষার্থীর  প্রতিষ্ঠান, গ্রাম-শহর-নগরের শিক্ষায় নানামাত্রিক ব্যবধান-বৈষম্য বিদ্যমান। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো মেধার ভিত্তিতে (?) ধনী-গরীব-মধ্যবিত্ত সকল শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে। সেখানে এভাবে ধনীর সন্তানদের কাছ থেকে অধিক অর্থ নিলে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুপিরিয়রটি ও ইনফিরিওরটির চর্চা হবে। সেটা কি শোভন, গ্রহণযোগ্য? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনোভাবেই বৈসাদৃশ্যের পরিস্থিতি সৃষ্টি কাম্য নয়। সেটা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা ও দর্শনই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব, জাতি গঠন ও উন্নয়নের মূলক্ষেত্র। তাকে অবজ্ঞা করে দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। একে দুর্বল ও গুরুত্বহীন করা হবে জাতিকে মেধা ও নেতৃত্বহীন করা।

শিক্ষার মান বাড়াতে হলে সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বর্তমানে যে বরাদ্দ হচ্ছে তা দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা সম্ভব নয়। শিক্ষায় কেন অধিক বিনিয়োগ দরকার, এর গুরুত্ব কি, এর ফলাফল কি—আমরা সবাই জানি। এটা নিয়ে নতুন করে কিছু বলছি না এবং এটা নিয়ে কোনো বিতর্কও নেই। বিতর্ক আছে শিক্ষার ব্যয় ও দায় নিয়ে।

উচ্চশিক্ষার দায় সরকারের। শিক্ষা এখনো মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। শিক্ষানীতি ও সংবিধানে এ কথা স্পষ্ট বলা আছে। সরকার অনেক অগুরুত্বপূর্ণ খাতে হাজারো কোটি টাকা ব্যয় করছে। বিদেশে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-ভ্রমণের নামে অপচয় হচ্ছে, সরকারি কেনাকাটায় অপচয় হচ্ছে, বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। এগুলোর চেয়ে উচ্চশিক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষায় বিনিয়োগ কখনোই অলাভজনক নয়, এ কথা নানাভাবে প্রমাণিত। তাহলে কেন এ ক্ষেত্রে সরকারের অনীহা ও উদাসীনতা?

২০২২-২৩ অর্থ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৯২২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এই বাজেটের ৮৪ ভাগ আসবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা সরকার থেকে। তার মানে তাদের প্রয়োজন বাকি ১৬ ভাগ অর্থ। এর পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ১৪৭ কোটি টাকা। জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানের জন্য এ অংক খুব বড় বিষয় নয়। এই অর্থের সংস্থান করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ঐতিহ্য-মর্যাদা-মূল্যবোধের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু করতে পারে না।

বিশ্ববিদ্যালয় কোনো পাটকল বা শিল্প কারখানা নয়, সিস্টেম লসের কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান নয়। তাদের দিয়ে আয়-মুনাফার চিন্তা পরিহার করুণ। শিক্ষার মান বাড়াতে অর্থ দেবেন না, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং নিয়ে হৈচৈ করবেন—তা হয় না। ব্যাংকে বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ রেখে অর্থের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংস করবেন, তা হয় না। কি হবে সেই অর্থে যদি উপযুক্ত মানবসম্পদই গড়ে তোলা না যায়?

তারপরও যদি শিক্ষা প্রশাসকরা মনে করেন, তাদের নিজস্ব আয়ের উৎস অনুসন্ধান করতেই হবে, সেক্ষেত্রে তারা এই বিকল্পগুলো ভাবতে পারেন।

১. ধনী ব্যক্তি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ক্ষেত্রে সহায়তা করবেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভবন নির্মাণ-রক্ষণাবেক্ষণ-উন্নয়ন (তাদের নামে চুক্তিভিত্তিক স্পন্সরশীপ) করতে পারেন। উন্নত বিশ্বে এটা একটি স্বাভাবিক বিষয়।

২. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ প্রজেক্ট-প্রকল্পে অংশ নেওয়া। জ্ঞান, মানবসম্পদ উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, উন্নয়ন ও উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ড, জরিপ-গবেষণায় প্রভৃতি ক্ষেত্রে তা হতে পারে। যেক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক এগিয়ে গেছে এবং এ ক্ষেত্রে তারা অনেক ধরণের সনদ প্রদান করে থাকে।

৩. বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুবাদ ও প্রকাশনা সংস্থা, ভাষা শিক্ষা, গবেষণা প্রকল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, বিভিন্ন ধরণের মেলার আয়োজন করা। এ ছাড়া জিম, সুইমিংপুল, কারাতেসহ বিভিন্ন ধরণের খেলাধুলার শিক্ষা-প্রশিক্ষণের বিষয়ে ভাবা যেতে পারে।

৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিকালীন সময়ে এর ভবন-স্থাপনা নানা কাজে ভাড়া দিয়ে, ব্যবহার করে আয় করতে পারে।

৫. বিশ্ববিদ্যালয় নৈশকালীন শিফট-ক্লাস চালু করেছে। এটা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সেটা একটা আয়ের উৎস হতে পারে।

৬. বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করা। প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী আকৃষ্ট করতে পারলে সেখান থেকে একটা ভালো আয় হতে পারে। পাশাপাশি বিদেশি সংস্কৃতির সঙ্গে শিক্ষার্থীরা পরিচিত হতে পারবে।

বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীদের খরচ এক নয়। দেশি শিক্ষার্থীরা যে বেতন-ফি দেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা দেন তার দ্বিগুণ বা তারও বেশি। বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া এই অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের অন্যতম একটি উৎস।

৭. শিক্ষকদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, কনসালটেন্সি প্রভৃতি থেকে আয়ের অংশ নেওয়া।

৮. বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবহৃত জায়গা-জমি পরিকল্পিতভাবে উৎপাদনমূলক কাজে ব্যবহার করা।

ধনীর সন্তানদের কাছ থেকে অধিক বেতন-ফি নেওয়ার চিন্তা না করে বরং ধনীদের কাছ থেকে 'শিক্ষা কর' আদায়ের ব্যবস্থা করুণ। এ ব্যবস্থা করা গেলে ধনীর সন্তানদের গরীবের পরোক্ষ করের অর্থে বিনামূল্যে লেখাপড়ার বিষয়টি থাকবে না।

অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ কি এই প্রস্তাবটি তুলবেন? সেই আয় দিয়ে এই সমস্যার সহজেই সমাধান হবে। এ কথা অতীতেও বলেছি। আবারো বলছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে এই অদ্ভুত-উদ্ভট-অনৈতিক-বৈষম্যমূলক পদ্ধতি চালুর কথা ভাববেন না।

এসব পরামর্শ মেনে চলা সম্ভব না হলে সরকারকে চাপ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য। নিজেদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধার জন্য আন্দোলন করতে পারলে এ ক্ষেত্রে কেন পারবেন না? নিজের সুবিধায় ও সরকার বিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে, প্রতিষ্ঠান রক্ষায় কেন সে দায় বোধ করবেন না? শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক-জনগণকে নিয়ে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করুণ।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। ৫ কোটির ওপরে ছেলে-মেয়ে স্কুলে ভর্তি হলেও তার ১ শতাংশেরও কম এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসতে পারে। সরকার তাদেরই উচ্চশিক্ষার খরচ মেটাতে পারে না। তাহলে এর বেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে এলে কি করুন অবস্থা হতো, সেটাই ভাবছি।

যদিও সেই সুযোগ বা অবস্থা তৈরি করা হয়নি। ৫১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ বছরের বাজেট ১০ হাজার ৫১৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। পি কে হালদার একাই আত্মসাৎ করেছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এমন অপকর্ম আরও অনেকে করেছেন। দেশের আর্থিক খাতে অনেক দুর্নীতি-অন্যায়-অনিয়ম-অপচয়-অপকর্ম-অব্যবস্থাপনা আছে। সেখানে নজর দিলে এ সমস্যার সহজেই সমাধান সম্ভব।

ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক, শিক্ষা উন্নয়ন গবেষক ও সাবেক ছাত্রনেতা

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

5 Edn institutions: Academic life of 40,000 in disarray

Academic activities in five major educational institutions in Dhaka remain suspended for the past week amid multiple incidents of clashes, affecting at least 40,000 students.

2h ago