মিতব্যয়িতার বাজেট, উদারতার বাজেট

budget_2022-23

মিতব্যয়িতা ও উদারতা একসঙ্গে চলতে পারে না। কিন্তু, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আজ বৃহস্পতিবার আগামী অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময় একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন, যেখানে তাকে একইসঙ্গে মিতব্যয়ী ও উদার—২টিই হতে হবে।

মিতব্যয়িতা এখন সময়ের প্রয়োজন। অস্বাভাবিক আমদানি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অর্থ হচ্ছে, বিদেশি রিজার্ভ হ্রাস ও রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির মধ্যে অর্থমন্ত্রীকে এখন প্রতিটি পয়সা বাঁচাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।

একইসঙ্গে আবার উদারও হতে হবে তাকে। কারণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা পেতে দেশের মানুষ সরকারের দিকে যেভাবে মরিয়া হয়ে তাকিয়ে আছে, সাম্প্রতিক সময়ে তা দেখা যায়নি।

সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন এক জটিল পর্যায়ে আছে।

বাংলাদেশ করোনা মহামারির ক্ষয়ক্ষতি বেশ দ্রুত কাটিয়ে উঠেছিল। উচ্চ মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি সত্ত্বেও বেশ নিরাপদেই ছিল। কিন্তু, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে গেছে।

এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে গেছে এবং বেশিরভাগ দেশে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে।

বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের এত ঊর্ধ্বগতি অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও নজিরবিহীন পণ্য পরিবহন ব্যয়। তাই দ্রব্যমূল্যের ওপর সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই।

এ অবস্থায় উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব কমাতে নিজেদের নাগালে থাকা কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনাই সরকারের করণীয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এম আকাশ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে হবে। সরাসরি নগদ স্থানান্তর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং দরিদ্র ও নিম্ন-আয়ের মানুষকে মূল্যস্ফীতির প্রভাব থেকে রক্ষা করতে রেশন দিতে হবে।'

বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তবে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এককভাবে শুধু আর্থিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করলেই হবে না। পরবর্তী উদ্যোগে মুদ্রানীতি কৌশলগুলোকেও যুক্ত করতে হবে, যেগুলো সরকার এখন পর্যন্ত ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেনি।

এটি সত্য যে, এসব মুদ্রানীতি কৌশল যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হলে তারল্য সরবরাহ ধীর হয়ে যাবে। এ ছাড়া, বিনিয়োগ-আমদানি এমনকি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কমে যেতে পারে। শুধু তা-ই নয়, মূল্যস্ফীতিতে পড়ার ঝুঁকিও থাকবে বাংলাদেশের।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এবং জনগণকে কষ্ট থেকে রক্ষা করার জন্য আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জায়গায় কিছুটা ছাড় দিতে হতে পারে।'

অর্থবহ সংস্কার আনার ক্ষেত্রে সরকারের অর্জন প্রত্যাশার চেয়ে কম। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সংস্কারের কাজটি শেষ মুহূর্তের জন্য ফেলে রাখে সরকার। যতক্ষণ না কোনো দুর্যোগ আঘাত হানে বা এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যখন কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া বিকল্প থাকে না—তখনই শুধু তাদের টনক নড়ে।

কিন্তু, সাম্প্রতিক বিনিময় হারের অস্থিরতা থেকে এই দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে টাকার মান ধীরে ধীরে কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন। এতদিন এ কথায় কান না দিলেও এখন সরকার ঠিকই কাজটি করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ বৈদেশিক রিজার্ভ হ্রাসের কারণে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে বাংলাদেশ—এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

থিংক-ট্যাঙ্ক সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশকে সুবিধা দেবে—এমন পরিবর্তন বাধ্য হয়ে আনার চেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের অবস্থানে থাকা অবস্থাতেই আনা ভালো।'

বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকার কয়েক দশক ধরেই কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর বিষয়টিকে অবহেলা করে আসছে।

২০১২ সালের ডিসেম্বরে মূল্য সংযোজন কর এবং সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২ প্রণীত হয়। কিন্তু, ব্যবসায়ীদের তীব্র বিরোধিতার কারণে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তা কার্যকর করা হয়নি।

একইভাবে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভ্যাট সংগ্রহের ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোকে জনপ্রিয় করতে পারেনি।

সম্প্রতি পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের ভাইস-চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ লিখেছেন, 'দুর্ভাগ্যবশত, করের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য সংস্কার হয়নি। শক্তিশালী রাজনৈতিক সংকেত ছাড়া তা সম্ভব হবে না।'

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, 'সমস্যা হলো, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির যে উচ্চ স্তর, সেখানে অন্তত আরও দেড় বছর থাকতে হবে আমাদের।'

সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। আর অভ্যন্তরীণ চাহিদা সংযত করতে হলে বাজেট ঘাটতি খুবই সীমিত রাখতে হবে।

তার মতে, 'তবে বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ৬২ শতাংশ বেশি হবে।'

'এটি ব্যয় নিয়ন্ত্রণের প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়,' যোগ করেন তিনি।

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেও নিয়ন্ত্রিত মূল্য ব্যবস্থার কারণে দেশের বাজারে পেট্রোলিয়াম ও সারের দাম বাড়েনি। তবে গ্যাসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে।

এটি সরকারের কাছে একটি অপ্রতিরোধ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ যে পথই বেছে নেওয়া হোক, সমস্যা সৃষ্টি হবেই।

জাহিদ হোসেন বলেন, 'দাম যদি ওপরের দিকে সামঞ্জস্য করা না হয়, তাহলে ভর্তুকি ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হবে। আবার দাম সমন্বয় করা হলে মূল্যস্ফীতি ছড়িয়ে পড়বে। কাজেই ব্যবহারিক উপায়টি হচ্ছে, ধীরে ধীরে দামের সমন্বয় করা।'

মনজুর হোসেন বলেন, 'সরকারের উচিত আপাতত আমদানি-নির্ভর উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়া এবং অর্থনৈতিকভাবে আরও কার্যকরী গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করা।'

তিনি ব্যক্তিগত আয়করসীমা বাড়ানোর পরামর্শ দেন।

বিআইডিএস'র এই গবেষণা পরিচালক জ্বালানি ও কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের বিপক্ষে মত দেন।

'আমরা আগামীতে খাদ্য সংকটেরও সম্মুখীন হতে পারি। সুতরাং ৬ মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত এসব খাতের জন্য সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে', মত দেন তিনি।

যারা ট্রেড আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ নিয়ে গেছেন, তারা জরিমানা হিসেবে ৭ শতাংশ কর দিয়ে তা ফিরিয়ে আনার সুযোগ পেতে পারেন বলে যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, অধ্যাপক এম এম আকাশ এর তীব্র বিরোধিতা করেছেন।

সামষ্টিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে কর্মসংস্থান একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। সমস্যাটি প্রায় এক দশক ধরে চলছে।

'এই সময়ের মধ্যে, কখনও কখনও আমাদের কম কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে,' উল্লেখ করে থিংক-ট্যাঙ্ক সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, 'আমাদের দেখতে হবে কীভাবে আমরা বেসরকারি খাতের ঋণ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ সহজতর করতে পারি।'

বাংলাদেশে ব্যবসা করার খরচও বেশি বলে জানান তিনি। বলেন, 'বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনিয়োগ সহজ করার পদ্ধতিগুলো সহজ করতে হবে এবং বাধা দূর করতে হবে।'

নিরাপত্তা ভাতা নির্ধারণ করার বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে উল্লেখ করে অধ্যাপক রায়হান আরও বলেন, 'জীবনযাত্রার ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ায় প্রতি মাসে ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা ভাতায় খুব একটা উপকার হয় না।'

বর্তমান পরিমাণ থেকে ভাতা ২ গুণ বা ৩ গুণ করার এবং সামাজিক নিরাপত্তার আওতা সম্প্রসারণের আহ্বান জানান তিনি।

শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক নিউএজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস-চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম এই অঞ্চলের দেশগুলোর হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর্পোরেট করের হার নির্ধারণের সুপারিশ করেছেন৷

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশি-বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সংস্কার আনতে হবে।'

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি রিজওয়ান রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। বড় ব্যবসারও কর্পোরেট কর ও উৎস কর কমানো প্রয়োজন।'

মার্কিন কবি এডগার অ্যালবার্ট গেস্ট এক কবিতায় লিখেছিলেন, একদিন অনিশ্চয়তার সময়ে একজন সাহসী মানুষের প্রয়োজন হবে বিশ্বের।

বাংলাদেশের জন্য এই অনিশ্চয়তার সময়ে সম্ভবত কামালই সেই মানুষ।

Comments

The Daily Star  | English

Leading univs withdrawing from cluster system

Session delays, irregularities, and lack of central planning cited as reasons

10h ago