পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও খাদ্য সংকট মোকাবিলায় বাজেটে করণীয়
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে সামনের মাসগুলোয় বৈশ্বিক খাদ্য সংকট হতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ।
সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, এই যুদ্ধের কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র দেশগুলোয় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এরমধ্যে ভয়াবহ পর্যায়ে চলে এসেছে।
খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মোকাবিলা প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক গত ১৯ মে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত তহবিল ঘোষণা করে। সেদিনই জাতিসংঘ মহাসচিব এই সতর্কবার্তা দেন।
ইউক্রেনের রপ্তানি যুদ্ধ-পূর্ব পর্যায়ে ফিরিয়ে নেওয়া না গেলে পুরো বিশ্ব দুর্ভিক্ষের মুখে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করেন গুতেরেস।
ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের সরবরাহ কমে গেছে। বেড়েছে বিকল্প খাদ্যপণ্যের দাম। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম গত বছরের এ সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের ২০২১ সালের জরিপে দেখা গেছে, উচ্চমাত্রায় সক্রিয় একজন মানুষের খাদ্যতালিকায় দৈনিক ৩৩৩ গ্রাম চাল, ৩৯ গ্রাম আটা, ৫০ গ্রাম আলু, ৬০ গ্রাম ডাল, ৪৫ গ্রাম ভোজ্যতেল ও ২৫ গ্রাম চিনি থাকা দরকার।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারির বাজারদরের তালিকা অনুসারে, তখন একজন শ্রমিকের এক দিনের খাদ্যের জন্য এসব পণ্য পরিমাণমতো কিনতে খরচ হতো ২৩ টাকার কিছু কম। এখন হয় ৩২ টাকার বেশি।
এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যমান সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়াতে আসন্ন বাজেটে সরকারের করণীয় প্রসঙ্গে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইনের সঙ্গে।
পণ্যমূল্য বৃদ্ধির যে প্রবণতা, তার পেছনে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাবের পাশাপাশি দেশের ব্যবসায়ীদের কারসাজিকেও দায়ী করছেন গোলাম মোয়াজ্জেম ও নাজের হোসাইন। এ অবস্থায় বাজার ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোতে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সেইসঙ্গে নিত্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কহার পুনর্বিন্যাস, করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয়ে নগদ প্রণোদনা বাড়ানো, কৃষিখাতে ভর্তুকি বাড়ানো এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আপৎকালীন মজুত বা 'বাফার স্টক' তৈরিতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের সুপারিশ এসেছে তাদের পক্ষ থেকে।
এ বিষয়ে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের ভাষ্য, 'এই ধরনের (যুদ্ধকালীন) পরিস্থিতিতে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে মূল্যস্ফীতি তৈরি হয়। তার কারণে যে ধরনের অভ্যন্তরীন অভিঘাতগুলো পড়ে সে বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়াটা জরুরি।
'সেদিক থেকে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, খাদ্য সরবরাহ যাতে স্থিতিশীল থাকে সে জায়গাটিতে সরকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।'
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এই গবেষক বলেন, 'কেননা সহসা মূল্য কমে যাবে এ ধরনের পরিস্থিতি হয়তো নেই। আরও বেশ কিছুকাল হয়তো মূল্যের ঊর্ধ্বগতি থাকবে। দেশের ভেতর অন্যান্য অনিয়ম যেই হোক বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মূল্যের এক ধরনের ঊর্ধ্বগতি বিরাজ করবে। বিশেষ করে আমদানি নির্ভর পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে।'
এ জন্য সরকারের ৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিয়ে গঠিত বাজার মনিটরিং কমিটিকে বাজার পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও এ সংক্রান্ত সুপরিশ প্রণয়নের পরামর্শ দেন তিনি। সেইসঙ্গে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথা দুস্থ, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধ মানুষকে সহায়তা করার জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো এবং ওএমএসের মতো খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিগুলোতে যাতে পণ্য সরবরাহ অব্যাহত থাকে, তার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দের সু্পারিশ করেন গোলাম মোয়োজ্জেম।
এ ছাড়া, সংকট উত্তরণে নিত্যপণ্য আমদানিতে সরকার বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করতে পারে বলেও মন্তব্য করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক। বলেন, 'অভ্যন্তরীণ চাহিদার নিরিখে এবং উৎপাদনের অবস্থা বিচার করে আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোতে শুল্ক কমাতে পারে সরকার। শুল্ক কমালে আমদানি ব্যয় কমবে। তাতে হয়তো কিছুটা স্বস্তিদায়ক মূল্যে পণ্যগুলো বাজারে পাওয়া যেতে পারে।'
এর বাইরে তুলনামূলক কম আয়ের মানুষদের স্বস্তি দেওয়ার জন্য করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ বা সাড়ে ৩ লাখ টাকা করার সুপারিশও করেন তিনি।
এর পাশাপাশি পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে ডলার সংকটকে 'আংশিক' দায়ী বলে মনে করেন গোলাম মোয়াজ্জেম। এ ক্ষেত্রে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আনার বিষয়টিকে উৎসাহিত করতে প্রবাসী আয়ে নগদ প্রণোদনার পরিমাণ আড়াই শতাংশ থেকে আরও বাড়ানোর পরামর্শ দেন এই গবেষক। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, 'এক্ষেত্রে কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়া রেমিটেন্স পাঠানোর যে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, আমরা মনে করি না যে এটা যথাযথ একটি উদ্যোগ। আমরা মনে করি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই এটি (রেমিটেন্স) আসা উচিত। ইনটেনসিভ বাড়ালে হয়তো রেমিটেন্স বাড়বে। আর ডলারের সরবরাহ বাড়লে হয়তো তা আমদানি পর্যায়ে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।'
একইসঙ্গে দেশের ভেতরে উৎপাদন নির্বিঘ্ন রাখতে কৃষিখাতে ভর্তুকির পরিমাণ বহুলাংশের বাড়ানোর প্রস্তাব দেন গোলাম মোয়াজ্জেম। বলেন, 'যেহেতু আমদানি পর্যায়ে সারের দাম বেড়েছে সেহেতু সারের আমদানি যাতে অব্যাহত থাকে এবং সেগুলো যাতে কৃষক পর্যায়ে সাবসিডাইজ প্রাইসে দেওয়া অব্যাহত থাকে সেটাও নিশ্চিত করা দরকার।'
এসবের পাশাপাশি এখনই সব পর্যায়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম না বাড়ানোর পক্ষে মত দেন তিনি। তার মতে, বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ালে তা উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয়ের ক্ষেত্রে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করবে। যার প্রভাব পড়বে সবখানে।
এদিকে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা তার পেছনে কেবল ইউক্রেন যুদ্ধই দায়ী—এমনটি মনে করেন না ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্যাবের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তার মতে, 'দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজিই মূল কারণ। এগুলোকে (যুদ্ধ) তারা অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। যুদ্ধের কারণে তো দেশি পণ্যের দাম বাড়ার কথা না।'
বিদ্যমান সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়াতে এখনই খাদ্যপণ্যের বাফার স্টক বা আপৎকালীন মজুত তৈরির ওপর জোর দেন নাজের হোসাইন। এ জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
এর বাইরে কৃষক পর্যায়ে এখন থেকেই কিছু কিছু প্রণোদনা দেওয়ার সুপারিশ করেন নাজের। বলেন, 'আগে থেকেই যদি এই ব্যবস্থাটা রাখা যায়, তাহলে কৃষকরা উৎপাদন বাড়াবে। যে কাজটি লাইভস্টক ডিপার্টমেন্টে করা হয়েছে। এক সময়ে কোরবানীর গরুর জন্য আমরা পার্শ্ববর্তী দেশের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। এখন কিন্তু গরু না আসলেও সমস্যা হয় না।'
তিনি আরও বলেন, 'বিভিন্ন ফসল চাষের ক্ষেত্রেও এমন কিছু উদ্যোগ সরকার নিতে পারে। যেটা পেঁয়াজের ক্ষেত্রে সরকার করেছে। ধান, চাল, গম কিংবা সরিষা চাষের ক্ষেত্রেও এটা করা যেতে পারে।'
Comments