মুখপাণ্ডিত্য: ফৌজদারি মশকরা, রাজকীয় আশকারা

নিত্যপণ্যের সঙ্গে কথার চাতুরী ও মুখপাণ্ডিত্যের বাজারও আবার গরম। চড়ছে তো চড়ছেই। অভিধানও পাল্টে যাওয়ার দশা। একই বিষয়ে আজ এক কথা, কাল আরেক কথার চাতুরী। এই চাতুরী এখন একটা স্মার্টনেস। মিথ্যাচারীর প্রতিশব্দ ‘সুবক্তা’। এদিকে-সেদিকে ঢু মারলে আগে বলা হতো ডিগবাজি। হাল আমলে তা চমক-ক্যারিশমা। এক একটি ঘটনায় মানুষের কলিজা ছিঁড়ে যাওয়ার মতো কথার তীর আসছে এই চমক ও স্মার্টনেসধারীদের কাছ থেকে। কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না তেল-চাল-ডালসহ নিত্যপণ্যের কষ্টের সময়টাতেও।

নিত্যপণ্যের সঙ্গে কথার চাতুরী ও মুখপাণ্ডিত্যের বাজারও আবার গরম। চড়ছে তো চড়ছেই। অভিধানও পাল্টে যাওয়ার দশা। একই বিষয়ে আজ এক কথা, কাল আরেক কথার চাতুরী। এই চাতুরী এখন একটা স্মার্টনেস। মিথ্যাচারীর প্রতিশব্দ 'সুবক্তা'। এদিকে-সেদিকে ঢু মারলে আগে বলা হতো ডিগবাজি। হাল আমলে তা চমক-ক্যারিশমা। এক একটি ঘটনায় মানুষের কলিজা ছিঁড়ে যাওয়ার মতো কথার তীর আসছে এই চমক ও স্মার্টনেসধারীদের কাছ থেকে। কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না তেল-চাল-ডালসহ নিত্যপণ্যের কষ্টের সময়টাতেও।

বারবার সিঙ্গাপুর-লন্ডন থেকে মেডিকেল চেকআপ করে ফিরে মাননীয়রা মানুষকে চিকিৎসার জন্য বাইরে না গিয়ে দেশপ্রেমের সাক্ষর রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। কোথাও থেকে প্রশ্ন আসছে না এ মশকরার বিষয়ে। মাননীয়দের জন্য কথার মাঠ ফাঁকা। তারা যেন এক একটা কথার মেশিন। বলা মাত্রই প্রচার। গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম হয়ে চলে আসছে গণমাধ্যমে।

মানুষের কাটা ঘায়ে কাঁটা বসানোর মতো অবারিত সুযোগ-অধিকার তাদের। গত প্রায় সোয়া এক যুগে এই মান্যবরদের বচনগুলো নিয়ে একটি বই সংকলন করলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুখপাঠ্য হতে পারে। তারা জানতে পারবে, এ দেশটিতে একদা কিছু রাজমান্যবর ছিলেন। যাদের ছিল অনেক কদর-আদর। রাজ্যের কেউ কখনো তাদের ভুল ধরার সাহস পায়নি। তাদেরকে সতর্ক করেননি তাদের সিনিয়ররা। সংশোধনের তাগিদ আসেনি হাইকমান্ড থেকেও।  বরং ধন্য ধন্য বলে সাহস-প্রণোদনা জোগানো হয়েছে। দেওয়া হয়েছে যোগ্য, দক্ষ, অভিজ্ঞ, স্মার্ট, লয়েল, করিৎকর্মা, একের মাল, অরিজিনাল, পিওর, পরীক্ষিত, সাহসী ইত্যাদি কতো অভিধা!

এমন রাজ-আশকারাতেই তারা এই সময়ে এসে বলে দিতে পারেন, সয়াবিন তেল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কেউ জানতেও চাইলো না, এতদিন এই ক্ষতিকর পণ্যটি খাওয়ালেন কেন জনাব? নানা বদনাম দিয়ে সরিষার তেলকে ধাওয়ালেন কেন? ড্রাইভারদের মানুষ চেনার দরকার নেই, গরু-ছাগল চিনলেই চলে—এমন কথা একজন মাননীয় কি বলতে পারেন? জ্বি পারেন। পারেন বলেই বলেছেন। বলে আসছেন। সমস্যা হয়েছে কখনো? কিংবা সমস্যা হবে?

যে কারণে সগর্বে কাউকে সেতু থেকে নদীতে ফেলে দেওয়ার মতো আকাঙ্ক্ষার মধ্যেও ফৌজদারি অপরাধ থাকে না, কাউকে ডুবানো-চুবানো, দিগম্বর করে দেওয়াও দোষের কিছু বলে বিবেচিত হয় না। দু-চারটা কথায় মানুষের মনে কষ্ট গেলেই বা কী? দেশে চালের কোনো সংকট নেই, মানুষ ভাত বেশি খায় বলে চালের দাম বাড়ছে, ডায়াবেটিসও বাড়ছে। গরুও এখন ভাত খায়, গরু কচুরিপানা খেতে পারলে মানুষ কেন তা খেতে পারবে না—ধরনের কথা কি এমনি এমনি বলছেন মহোদয়-মহাশয়রা? এমন বচনের যাবতীয় সমর্থন-বাস্তবতা আছে বলেই তো!

আইনের শাসনের বদলে শাসনের আইন কায়েম হলে মহোদয়রা যা ইচ্ছা করতে পারেন। বলতে তো পারেনই। পারছেন বলেই তো এই কঠিন দিনেও বলে চলছেন—উন্নয়ন হলে দুর্নীতি হবেই। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে গেছে।  সকালে ঘুম থকে উঠেই মানুষ দেখে তার মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে। ঢাকার টয়লেটগুলো ফাইভ স্টার হোটেলের মতো। হাতিরঝিল গেলে মনে হয় প্যারিস শহর, আকাশ থেকে ঢাকা শহরকে মনে হয় লস অ্যাঞ্জেলস। আগামীতে টেমস নদী দেখতে লন্ডন নয়, বুড়িগঙ্গা গেলেই হবে।

বহু দেশের মানুষেরই উড়োজাহাজে চড়ার সামর্থ্য নেই, সেখানে আমরা প্লেনে করে পেঁয়াজ নিয়ে আসি—এমন কথা বলতেও ছাড়েননি একজন আলোচিত মাননীয়। বিদেশের মন্ত্রীরা এখন বাংলাদেশের মন্ত্রীদের অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য বসে থাকে—এই গর্ব পর্যন্ত জানান দিয়েছেন একজন মন্ত্রী।

অবিরাম এ ধরনের বচন সরবরাহ করা মান্যবররা কি একা? তাদের এ ধরনের কথায় সরকারের বা দলের কোনো পর্যায়ের কেউ আপত্তি করছেন? নাকি সমর্থন দিচ্ছেন? দৃশ্যত এর বাইরেও প্রচুর সমর্থক তাদের। বলার সঙ্গে সঙ্গে হাজারে হাজার ঝাঁপিয়ে পড়ছেন বাহ্-বাহ্ দিয়ে। শামিল হচ্ছেন এসব বচনকে প্রতিষ্ঠিত করতে আয়োজিত সেমিনার-গোলটেবিলে।

গোটা আবহটিই মুখপাণ্ডিত্য এবং নোংরা বচনের বাম্পার ফলনের অনুকূলে। এ কর্মে যে যতো পারঙ্গম ও সাহসের সাক্ষর রাখছেন তার প্রাপ্তি ততো বেশি। মুখ জোরের এ কার্যকারিতার সঙ্গে চাতুরীর গুণ যোগে আগুয়ানকে আর পেছনে তাকাতে হচ্ছে না। সরকারে, দলে, পদ-পদবিতে সাফল্যের নিশ্চয়তা মিলছে।

মেধা-শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা, সততার কোনো প্রশ্ন নেই। সিনিয়র-জুনিয়রও বিষয় নয়। রাষ্ট্রীয় বা দলীয় সিনিয়ররাও জুনিয়রদের সঙ্গে পেরে উঠতে নামছেন এ প্রতিযোগিতায়। সুফলও পাচ্ছেন। এক এক ঘটনায় হাতেনাতে প্রমাণ হচ্ছে মুখের জোরের বরকত। ব্যক্তিত্ব বা শিক্ষার বদলে নিম্নমানের কথার বিষে কেউ কষ্ট পাচ্ছে বা পাবে, এটি মোটেই এখন আর ভাবনার বিষয় নয়। বিষয়-আসয় অন্যখানে।

মুখ বা থোঁতার জোরের এই সংস্কৃতি রাজনীতির মাঠ গড়িয়ে এখন অন্যদেরও পেয়ে বসেছে। অবস্থাটা দিনে দিনে এমন জায়গায় ধেয়ে চলছে, ফুটপাথের ফেরিওয়ালা-দোকানদার থেকে শুরু করে শিক্ষক, সাংবাদিক, মসজিদের ইমাম-খতিব পর্যন্ত কাজের চেয়ে মুখপাণ্ডিত্য রপ্ত করতে মনোযোগী। যে যেখানে যা পারছেন করে ছাড়ছেন। সত্য-মিথ্যা, ভদ্রতা-চাতুরী, বিনয়-অসভ্যতা, মমতা-নিষ্ঠুরতাসহ প্রায় সবই এখন আপেক্ষিকতায় ঠাসা। মুখের সঙ্গে তাদের শরীরী ভাষাও সেই বার্তাই দিচ্ছে।

তারা বিশেষ আদর-সমাদর, আদাব-সালাম, তোয়াজ-কুর্নিশ, যত্ন-আত্তি আদায় করে নিচ্ছেন। ঘুষকে স্পিড মানি, দুর্নীতির সঙ্গে যানজটকে উন্নয়নের প্রমাণ, জনভোগান্তিকে উন্নয়নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মতো বচনে জায়েজ করার আর বাকি রাখেননি। কাউকে সেতু থেকে টুপপুস করে ফেলে দেওয়া বা পানিতে চুবানোর অভিপ্রায়ের মধ্যে স্মার্টনেস, সুবক্তা প্রমাণের নানা যুক্তি ও কথামালার বিবিধ রতনও আছে তাদের ভাণ্ডারে।

বাঙালিকে কথার বদলে কাজে বড় হওয়ার সবক দিয়েছিলেন কবি জীবনানন্দ দাসের মা কবি কুসুম কুমারী দাশ। তিনি লিখেছিলেন, 'আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে… কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে'। কিন্তু আমরা পড়ে গেছি 'কাজে না বড় হয়ে কথায় বড় হওয়া'র রাজরোগে। নিয়তি না কর্মফল?—প্রশ্নটা আপাতত উহ্যই থাক।

মোস্তফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments