দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছিলেন ‘মাসকাটালপুত্র’

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

বরিশালের বিচ্ছিন্ন উপজেলা মেহেন্দীগঞ্জের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা একটি নদীর নাম মাসকাটাল। খরস্রোতা এই নদীর তীরবর্তী উলানিয়া গ্রামে জন্মেছিলেন একুশের গানের রচয়িতা, সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। এই নদীর নামে তার লেখা একটি গল্পও আছে।

গত বৃহস্পতিবার লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মৃত্যু হয় গাফ্‌ফার চৌধুরীর। মৃত্যুর আগে গত ১৩ মে হাসপাতাল থেকে ভিডিও কলে তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তখন তিনি দেশে ফিরে আসার আকুতি জানান। তার শুভেচ্ছা পৌঁছে দিতে বলেন দেশের মানুষের কাছে।

গাফ্‌ফার চৌধুরী জন্ম নিয়েছিলেন অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে। তার বাবা ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী ভূস্বামী হয়েও ছিলেন ব্রিটিশশাসিত ভারতের একজন মুক্তিসৈনিক ও অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। তিনি তৎকালীন কংগ্রেসনেতা মতিলাল নেহেরুর সেক্রেটারি হিসেবেও কাজ করেন।

বাবার এই রাজনৈতিক উত্তরাধিকার গাফ্‌ফার চৌধুরীও বয়ে চলেছেন আজীবন। আজীবন তিনি সাধারণ মানুষের জন্য কলম ধরেছেন। ছাত্র অবস্থাতেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে তার ছিল সগর্ব উপস্থিতি।

পাকিস্তান আমলে পিআইএ'র বিমান পরিষেবা উদ্বোধনের সময়ে এক ঝাঁক মেধাবী সাংবাদিককে ঢাকা থেকে নিযে যাওয়া হয়, যাদের মধ্যে খোন্দকার মোজাম্মেল হকসহ অনেকে ছিলেন। এরা সবাই ছিলেন গাফ্‌ফার চৌধুরীর অত্যন্ত কাছের। সে সময় বিমান দুর্ঘটনায় তাদের সবার মৃত্যু হয়।

গাফ্‌ফার চৌধুরীর লেখা অনেক কলামে এই বিমান দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ এসেছে। এ দুর্ঘটনার সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রের বিষয়টি তিনি খোলাখুলিভাবে বলেছেন তার লেখায়।

গাফ্‌ফার চৌধুরী নির্ভয়ে লিখতেন। সমসাময়িক যেকোনো বিষয় নিয়ে সাবলীলভাবে লিখে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল তার। লেখালেখিই ছিল তার প্রধান পেশা। তার লেখা কলামের সঙ্গে পরিচিত নন, এমন রাজনীতি সচেতন পাঠক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনা, চরিত্র দিন-তারিখ মনে রেখে বর্ণনার অসামান্য গুণের অধিকারী ছিলেন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। রচনা করেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, স্মৃতিকথা ও প্রবন্ধ।

সব ছাপিয়ে বাঙালি জাতি তাকে মনে রাখবে অন্য একটি কারণে। তার লেখা 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' গানটির জন্য তিনি বিশ্বের প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে অমর হয়ে থাকবেন।

বায়ন্নর ২১ শে ফেব্রুয়ারি পুলিশ মায়ের ভাষার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়। তিনি সেদিন হতাহতদের দেখেতে ঢাকা মেডিকেলের বহির্ভিভাগে যান। সেখানে ভাষাসংগ্রামী রফিকের খুলি উড়ে যাওয়া নিথর দেহ দেখে তার মনে জাগে ভাই হারানোর বেদনা। পরে পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হয়ে বিছানায় শুয়ে থেকেই তিনি লিখে ফেলেন অবিনাশী কবিতাটি।

কাছাকাছি সময়ে রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় গোপন এক সভা থেকে প্রকাশিত ইশতেহারে ঠাঁই পায় কবিতাটি। শুরুতে ১৯৫৩ সালে কবিতাটিতে সুরারোপ করেন আবদুল লতিফ। সে বছর গুলিস্তানের ব্রিটেনিয়া হলে ঢাকা কলেজের নব-নির্বাচিত ছাত্র সংসদের অভিষেকে গানটি প্রথম গাওয়া হয়।

একই বছরের মার্চে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় 'একুশে ফেব্রুয়ারী' নামের ঐতিহাসিক সংকলনে প্রকাশিত হয় কবিতাটি। পরে এতে সুরারোপ করেন আলতাফ মাহমুদ। সেই সুরেই ১৯৫৪ সালের প্রভাতফেরিতে গানটি প্রথম গাওয়া হয়।

গাফফার চৌধুরী বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে গত শতকের পঞ্চাশের দশকের লেখালেখির সাথে যুক্ত হন। দৈনিক ইনসাফ, ইত্তেফাক, আজাদ, জেহাদ, পূর্বদেশ, মাসিক সওগাতসহ পত্র পত্রিকায় কাজ করেছেন তিনি। তিনি লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক 'জয়বাংলা'র প্রতিষ্ঠাতিা নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন তিনি। ভারতের যুগান্তর ও আনন্দবাজার পত্রিকাতেও তিনি লিখেছেন।

গুরুতর অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৭৪ সালে পাড়ি জমান লন্ডনে। তখন থেকে প্রবাস জীবন শুরু হলেও একুশের অবিনাশী গানের রচয়িতার মন মন বাংলাদেশেই পড়ে ছিল।

Comments

The Daily Star  | English
Major trade bodies miss election deadline

Major trade bodies miss election deadline as reforms take centre stage

Elections at major trade bodies have missed the 90-day deadline as new administrators of the business organisations seek amendments to the governing rules.

18h ago