অর্থ কেন পাচার হয়?
বন্ধুপ্রতিম রাজীব আহসান একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। কয়েকদিন আগে আড্ডার সময় তিনি বলছিলেন কানাডা প্রবাসী তার এক পরিচিত মানুষের গল্প। উন্নত জীবনের আশায় যিনি কানাডায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। পৈতৃক জমি বিক্রি করে কিছু টাকা জোগাড় করেন এবং তাই নিয়ে যান।
সেই কানাডা প্রবাসীকে অসংখ্য দপ্তরের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এই টাকার উৎস কী? কেন টাকা আনা হয়েছে? কীভাবে আসছে? এমন আরও অনেক প্রশ্ন। অথচ আরেকজন কানাডায় শত কোটি টাকা নিয়ে গেছেন, যাকে কোনো প্রশ্নই করা হয়নি। সেই মানুষটিকে জানাতে হয়নি টাকার উৎস কী? কেন টাকা আনা হয়েছে?
প্রথম ব্যক্তি রাগে-দুঃখে বলছেন, এই দেশে ১ কোটি নিয়ে আসলে শত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। অথচ কানাডার বেগমপাড়ায় শত কোটি টাকা আনছে বাংলাদেশিরা, তাদের কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় না। এইটাই আসলে বাস্তবতা।
২০২০ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, কানাডায় অর্থ পাচারের ২৮টি ঘটনার তথ্য তারা পেয়েছেন, যেগুলোর মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি (বিবিসি বাংলা, ১৯ নভেম্বর ২০২০)।
এই ২৮টি ঘটনার সবার তথ্যই সরকারের কাছে আছে কিন্তু তাদের ধরা হয়নি। কেন ধরা হয়নি তা কি অজানা?
প্রশ্ন হলো, কেন অর্থপাচার হয়? প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে বলেন, অবৈধ উৎস বন্ধ না হলে অর্থপাচার চলতেই থাকবে (ঢাকা পোস্ট, ৯ জানুয়ারি ২০২১)। অর্থাৎ বাংলাদেশে অবৈধ অর্থের উৎস বেশি। তাই তারা তাদের অবৈধ অর্থ দেশে না রেখে বিদেশে পাচার করে দেন।
প্রশ্ন ওঠে, এ দেশে এত অবৈধ অর্থ কেন? কারণ এই দেশে দুর্নীতি বেশি, অনিয়ম বেশি। ব্যবসায়ী বা বিত্তশালীরা নিজেদের ইচ্ছায় সাধারণ মানুষের গলা কাটতে পারছে। তারা দুর্নীতি করে অল্প সময়ে অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে যাচ্ছেন। এরপর ভাবছেন, যেহেতু এই টাকা অবৈধ, তাই তাদের পরিবারের কেউই নিরাপদ নয়। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে বিভিন্ন কৌশলে তারা অর্থপাচার করে দেন।
সড়ক নির্মাণের খরচ বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি: বিশ্বব্যাংক (দ্য ডেইলি স্টার, ২১ জুন ২০১৭)। এক কিলোমিটার রাস্তায় ব্যয় ৮২ কোটি টাকা (প্রথম আলো, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০)। এই যে বেশি ব্যয়, তাই কিন্তু দুর্নীতি। সেই দুর্নীতির টাকা যারা আয় করেন, তারা দেশে টাকা রাখেন না।
ক্যাসিনো কাণ্ড ছিল আলোচিত ইস্যু। এই টাকা পুরোটাই অবৈধ। সাধারণ মানুষ থেকে বিত্তশালী অনেকেই ক্যাসিনোতে লাভের আশায় অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন। লাভ তো দূরের কথা, বরং হারিয়েছেন অনেক। যারা লাভবান হয়েছেন, অর্থাৎ ক্যাসিনো পরিচালনাকারীরা, তারা সেই টাকা দেশে রাখেননি। সব পাচার করে দিয়েছেন। সিআইডি বলছে, ক্যাসিনোর হোতারা পাচার করেছেন ১ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা (টিবিএস, ১৭ অক্টোবর ২০২১)।
খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। নামে-বেনামে তার ২১৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকার সম্পদ আছে (সমকাল, ১১ এপ্রিল ২০২২)। এখন খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ক্ষমতায়। তার বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত করা গেলে জানা যাবে এই টাকা আর দেশে নেই।
সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুলের কথা মনে আছে? যে পাপুল মানবপাচার করে অর্থের পাহাড় গড়েছিলেন। পাপুল ছিলেন লক্ষ্মীপুর–২ আসনের সংসদ সদস্য। তাকে মানুষ বিশ্বাস করতেন। সেই বিশ্বাসের আড়ালে তিনি অঢেল অর্থ-সম্পদ গড়েন এবং তা পাচার করে দেন। তার অপরাধ প্রমাণিত হয়।
পাপুলের ১৪৮টি ব্যাংক হিসাব, স্ত্রী সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলামের ৩৪৫টি ব্যাংক হিসাব, মেয়ে ওয়াফা ইসলামের ৭৬টি ব্যাংক হিসাব এবং শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের ৪৮টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছিল। ৪ জনের বিরুদ্ধে ২ কোটি ৩ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ ও ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (বিবিসি বাংলা, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০)।
অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত ১৪টি প্রতিষ্ঠান ও ২৯ জনের তালিকা আদালতে দাখিল করা হয়েছে। ২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ তালিকা দাখিল করে দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান। তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? হয়নি। কেন হয়নি? এই প্রশ্নটা বার বার মাথায় ঘুরছে।
দেশ থেকে এত টাকা পাচার হয়, অথচ কোনো টাকা ফেরত আনা যায় না। এমনকি অপরাধীদেরও ধরা হয় না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে ২৮টি ঘটনায় সম্পৃক্ত সরকারি কর্মচারীরা কিন্তু এখনো দেশেই আছেন। তারা এখনো কর্মরত। তাহলে কেন তাদের নাম উল্লেখ করা হচ্ছে না বা তাদের ধরা হচ্ছে না? তারাই কিন্তু কানাডায় বেগমপাড়া বানিয়েছেন। তারাই বিদেশের মাটিতে দেশকে দুর্নীতিপরায়ণ, অর্থপাচারকারী দেশ হিসেবে পরিচিত করছে। তারাই সুইস ব্যাংকে অঢেল টাকা জমাচ্ছেন।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের ৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা (প্রথম আলো, ১৮ জুন ২০২১)। এটা ২০২০ সালের হিসাব। প্রতি বছর সুইস ব্যাংকে টাকা যাচ্ছে। এই টাকা কাদের? বাংলাদেশের মানুষের টাকা, যা পাচারকারীরা অবৈধভাবে পাচার করেছে। যে টাকা তারা দেশের মানুষকে ঠকিয়ে আদায় করেছে। তাদের শাস্তি দেওয়া হয় না বলেই পি কে হালদাররা তৈরি হয়। আর দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান হয় ১৪৭তম।
পদ্মা সেতুর মোট নির্মাণ ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। সাধারণ হিসাবেই বলা যায়, সুইস ব্যাংকে পাচার হওয়া ৫ হাজার ২০৩ কোটি দিয়ে পদ্মা সেতুর ৬ ভাগের ১ ভাগ কাজ সম্পন্ন হতো। এই টাকা দেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র খাতে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
এত দুর্নীতি ও অর্থপাচারের ভিড়ে অটোরিকশা চালক নাজমুল কাজীকে (৩০) আত্মহত্যা করতে হয়। সাভারের রেডিও কলোনি থেকে হাইওয়ে পুলিশ অটোরিকশা আটক করে টাকা চায়। ওই টাকা দিতে না পেরে গত ৭ এপ্রিল রাতে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন নাজমুল।
রাজশাহীর গোদাগাড়িতে সেচের পানি না পেয়ে ২ আদিবাসী সাঁওতাল কৃষক রবি মারান্ডি (২৭) ও অভিনাথ মারান্ডিকে (৩৬) বিষপানে আত্মহত্যা করতে হয়। তারা আত্মহত্যা করেন গত ২২ মার্চ। দিনটি ছিল বিশ্ব পানি দিবস।
এত অর্থপাচার ও দুর্নীতির ভিড়ে এই দেশে গাইবান্ধার বিকাশ চন্দ্র দাসকে (১৮) মরতে হয় শুধু বকশিস কম দেওয়ার কারণে। ৫০ টাকার জন্য অক্সিজেন মাস্ক খুলে দেয় বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কর্মচারী মো. আসাদুল ইসলাম মীর ওরফে ধলু।
এসব ঘটনা তখনই ঘটে যখন দেশে অন্যায় বাড়ে, সুশাসন হারিয়ে যায়, হাজারো কোটি টাকা পাচার করে কারো শাস্তি হয় না, তখন। তখন সাধারণ মানুষও অন্যায় করার সাহস পায়।
লেখার শুরুতে যে ঘটনার অবতারণা করেছিলাম, আবার সেই ঘটনায় ফিরে যাই। নাজমুল কাজী বা রবি মারান্ডি ও অভিনাথ মারান্ডি বা বিকাশ চন্দ্র দাসের মৃত্যু হয় অল্প টাকার জন্য। যাপিত জীবনে বেঁচে থাকার জন্য তাদের এই লড়াই। অথচ এই দেশের দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচারকারীরা বীরদর্পে বেঁচে থাকে দুর্নীতি আর অর্থপাচার করে।
আমাদের প্রশাসন নাজমুল কাজী বা রবি মারান্ডি ও অভিনাথ মারান্ডি বা বিকাশ চন্দ্র দাসদের বাঁচাতে না পারলেও দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচারকারীদের ঠিকই বাঁচিয়ে রাখে। তবে কি ধরে নেব এই দেশে দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচারকারীরাই আজীবন আধিপত্য বিস্তার করবে? খন্দকার এনায়েত উল্যাহ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েও শাস্তি পাবে না? পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন কানাডায় অর্থ পাচারের ২৮টি ঘটনায় সম্পৃক্ত সরকারি কর্মকর্তার নাম বলতে ভয় পাবেন?
বিনয় দত্ত, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
benoydutta.writer@gmail.com
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments