ধান-চাল আমদানির প্রস্তুতি নেই, খাদ্য নিরাপত্তায় শঙ্কা

খাদ্য নিরাপত্তা, খাদ্যশস্য, ধান-চাল

দেশে এ বছর বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে এবং সরকারও চেষ্টা করছে খাদ্যশস্যের মজুত বাড়াতে। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, শুধু স্থানীয় উৎপাদনের ওপর ভরসা করে সামনের দিনগুলোর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে বিশ্ব বাণিজ্যের সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলসহ খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাব অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পড়েছে।

জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে খাদ্যের দাম ফেব্রুয়ারিতে রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। এক বছর আগের তুলনায় ওই মাসে ২০ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছিল খাদ্য পণ্যের দাম। এরপর থেকে বিশ্ব বাজারে বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এর মধ্যে গত শুক্রবার গম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। এতে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও খাদ্য পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে বেশ চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে।

ইন্দোনেশিয়া উদ্ভিজ্জ তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাত্র ২ সপ্তাহ পর ভারত এ নিষেধাজ্ঞা দেয়। এতে বোঝা যায় যে আরও কিছু দেশও নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ অবস্থায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আরও বেড়ে যাবে।

তারা বলছেন, দেশে বোরো উৎপাদন ভালো হলেও, সামনের দিনগুলোতে চালের চাহিদা অনেক বাড়বে। কারণ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেশি হওয়ায়, মানুষ বিকল্প খাদ্যের চেয়ে ভাতের ওপর নির্ভর করবে বেশি। অথচ চালের দাম এখনই অনেক বেশি।

বৈশ্বিক বাজারের অস্থিরতা বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে সরকার যেন বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আলাদা করে রাখে ভবিষ্যতের প্রয়োজনে। ভবিষ্যতে কবে কোন পণ্য লাগতে পারে তা বিবেচনা করে নির্দিষ্ট সময়ে সেগুলো যেন পাওয়া যায়, সেই চুক্তি করে রাখে।

এদিকে সরকার এখন পর্যন্ত শুধু স্থানীয় বাজার থেকে বোরো ধান সংগ্রহ এবং বিভিন্ন দেশ থেকে গম আমদানির ব্যবস্থা নিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্থানীয় বাজার থেকে বোরো চাল ও ধান সংগ্রহ করায় আমরা এই মুহূর্তে চাল আমদানির কথা ভাবছি না। কিন্তু দাম বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় বাজার থেকে গম সংগ্রহ করতে না পারায়, আমরা ভারত থেকে ৩ লাখ টন গম আমদানি করছি।'

নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগেই ভারতের সঙ্গে এই ৩ লাখ টন গম আমদানির চুক্তি হয়েছিল।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৫ মে পর্যন্ত সরকারের কাছে ১১ লাখ ২৮ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। এর মধ্যে ১ লাখ ১২ হাজার টন আছে গম এবং চাল ও ধান আছে ১০ লাখ ১৫ হাজার টন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যশস্যের সরকারি মজুত ১০ লাখ টনের নিচে গেলে তা বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং দাম বাড়তে শুরু করে।

সরকার স্থানীয় বাজার থেকে ১৮ লাখ টন বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ১১ লাখ ৫০ হাজার টন চাল এবং ৬ লাখ ৫০ হাজার টন ধান।

খাদ্য সচিব বলেন, 'লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে আমরা চাল আমদানির বিষয়ে বিবেচনা করব।'

গত বছর সরকার ১১ লাখ ৫০ হাজার টন চালের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১০ লাখ ৬০ হাজার টন সংগ্রহ করতে পেরেছিল এবং সাড়ে ৬ লাখ টন ধানের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৩ লাখ টন সংগ্রহ করতে পেরেছিল। ধান ও চালের সংগ্রহ মূল্য ছিল যথাক্রমে ২৭ টাকা ও ৪০ টাকা কেজি।

চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল থেকে এ বছরের জন্য বোরো ক্রয় শুরু হয়েছে এবং দাম একই আছে।

১৫ মে পর্যন্ত খাদ্য অধিদপ্তর ৪ হাজার ৯০৯ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করেছে, যেখানে সারা দেশের সরকারি খাদ্য গুদামে মোট ১৯ লাখ ৩০ হাজার টন খাদ্যশস্য সংরক্ষণের সক্ষমতা আছে।

তবে মনে রাখতে হবে যে এটি শুধু সরকারি মজুত যা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিতে ব্যবহার করা হয়। বেশি মজুত হয় কৃষক এবং ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে।

ধান-চালের ওপরই বেশি চাপ

বোরোর বাম্পার ফলন কয়েক মাসের জন্য আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও, খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে এ বছর পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে।

ইতোমধ্যে ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশের বাজারে গমের দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়া ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে গম আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে।

এদিকে কয়েক মাস ধরে জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল এবং খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির চাপে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। এ অবস্থায় তারা অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের জন্য খুব বেশি অর্থ ব্যয় করবে না।

সুতরাং, সামনের দিনগুলোতে ধান-চালের ওপরই মূল চাপ পড়বে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভোক্তারা তাদের খাদ্য বাজেটের বেশিরভাগই ভাতের পেছনে ব্যয় করবে। তাই আগামী দিনে চালের চাহিদা আরও বাড়বে এবং সরকারের এটি মাথায় রাখা উচিত।'

গম রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'অন্যান্য দেশ থেকে এ ধরনের আরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। আগামী জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের খাদ্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে প্রয়োজন হলে খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত ফিউচার মার্কেটে বিনিয়োগ করা।'

'আমদানি করা খাদ্য পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে টাকার সঙ্গে ডলারের মূল্য সমন্বয় করাও জরুরি,' যোগ করেন তিনি।

সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে বোরো ধান কাটা হয়। দেশে সারা বছর যে ধান উৎপাদন হয় তার অর্ধেকই বোরো। বৃষ্টিনির্ভর আমন ধানের মৌসুমে ৩৮ শতাংশ ধান উৎপাদন হয় এবং বাকিটা আউশ।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষক ড. আসাদুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বোরো এখন কাটা হচ্ছে বলে আগামী ৩ মাস চালের কোনো ঘাটতি থাকবে না।'

তিনি বলেন, 'কৃষক যেন আমন চাষে কোনো সমস্যায় না পড়ে সেজন্য সরকারের এখন আমন উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়া উচিত। কৃষক যেন ন্যায্যমূল্যে সার পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।'

দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমনের ভালো উৎপাদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে হেক্টর প্রতি ধানের ফলন কম। আমাদের হেক্টর প্রতি ধানের উৎপাদন বাড়াতে হবে যেন আমরা অন্যান্য জমিতে গম, তেল ও মসুরের মতো অন্যান্য খাদ্য পণ্য উৎপাদন করতে পারি।'

বিআইডিএস এর সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিশ্ব বাজারে খাদ্য পণ্যের দামের ব্যাপক ওঠানামার কারণে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় উত্স ব্যবহার করে দেশের চাহিদা অনুযায়ী সরকারের খাদ্যের মজুদ রাখা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রাথমিকভাবে দেশীয় উৎসকে কাজে লাগানো যেত।'

তিনি বলেন, 'এ ছাড়া, খাদ্যশস্য ও অন্যান্য খাদ্য পণ্য এবং তেলবীজের ভবিষ্যৎ উৎপাদনের দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার।'

'পাশাপাশি আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভও অল্প পরিমাণে ব্যবহার করা উচিত, যেন খাদ্য বা জ্বালানি ঘাটতি মেটাতে আমরা তা কাজে লাগাতে পারি। আমাদের খেয়াল রাখা উচিত যেন, বৈশ্বিক যে সংকট শুরু হয়েছে তাতে আমাদের যেন ডুবতে না হয়,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

BNP not in favour of banning any political party: Fakhrul

'Who are we to ban a political party? The people will decide,' says the BNP leader

37m ago