টোলে-ট্রেনে দুষ্টের ঢোলে বাড়ি

বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে কিছুটা কবিগুরুর 'সামান্য ক্ষতি' কবিতার ধাঁচে রেলের টিটিই শফিকের ল্যাঠা মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার নসিবে কী আছে, তা ভবিষ্যৎ। তবে বর্তমান হচ্ছে, ফ্যাসাদে ফেলা হয়েছে রেলের পাকশীর ডিসিও নাসির উদ্দিনকে। রেলমন্ত্রী মহাশয় এবং মহোদয়া আছেন আমানে-আছানেই।

তারপরও নুরুল ইসলাম সুজনের মতো একজন মন্ত্রী যে বিব্রত হয়েছেন, এটি যা-তা বিষয় নয়। বাংলাদেশের জন্য অনেক কিছু। সব সম্ভবের দেশ বলা হলেও বাংলাদেশে মন্ত্রী বা ওই পর্যায়ের কারও বিব্রত হওয়ার কথা জানানোর সম্ভাবনা অপ্রচলিত ঘটনা। বরং কেউ তাদের বিব্রত হওয়ার মতো কিছু করলে জনমের শিক্ষা পেতে হয়।

কিঞ্চিত ব্যতিক্রম হয়েছিল সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বেলায়। নানান ঘটনার প্যাঁচে শিক্ষা দিতে পারেননি তিনি। আর সোজা হয়েই দাঁড়াতে পারেননি। পরে শয্যাশায়ী এবং ইহলোক ত্যাগ। তার পরের জন মুজিবুল হককে বার্ধক্যে মহা আয়োজনে বিয়ে, যমজ বাচ্চা জন্ম দিয়ে মিডিয়ায় শিরোনাম হলেও নানান ঘটনা বিশেষ করে তরুণী বধূর কিছু ক্রিয়াকর্মের জেরে নেতিয়ে পড়তে হয়। পরে আর মন্ত্রিত্ব পাননি। আছেন সংসদ সদস্য হিসেবে।

সুজনের বিব্রত হওয়া বা টিটিই'র বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারের ঘটনা শেষ হয়ে যায়নি। সামনে তদন্ত বাকি। ততদিন পর্যন্ত সামনে অন্য কোনো ঘটনা আসবে না বা আনা হবে না, বলা যায় না। পরের ইস্যুর চাপে টিস্যুর মতো মিলিয়ে যাবে আগের ইস্যু। গত কয়েক বছর ধরে চলে আসছে এভাবেই। রেলমন্ত্রীর দ্বিতীয় স্ত্রীর স্বজনদের বিনা টিকেটে ট্রেন ভ্রমণে বাধা দেওয়ার অপরাধে টিটিই'র বরখাস্ত কাণ্ডের তেজে একই সময়ে ঘটা সেতুর টোল চাওয়ায় এমপি পুত্রের মারধর কাণ্ডের খবরটা মিডিয়ায় নিউজভ্যালু আদায় করতে পারেনি। রেলের মতো টোলমন্ত্রণালয় না থাকলেও কাণ্ড-কীর্তি বিচারে ঘটনা ছোট নয়। পটুয়াখালীর সংরক্ষিত আসনের এমপি কাজী কানিজ সুলতানা হেলেনের ছেলে মাহিন তালুকদার জয়ও দেখিয়ে দিয়েছেন ক্ষমতা কী জিনিস! পায়রা সেতুতে বিনা টোলে চলে যেতে চেয়েছিলেন তিনি।

এতে বাধা দেওয়ায় টোল আদায়কারীদের উত্তম-মধ্যম শিক্ষা দিয়েছেন জয় ও সঙ্গীরা। তাও পরপর ২ দফায়। প্রথম দফায় শিক্ষা নিতে না পারায় দ্বিতীয় দফায় শিক্ষা মুখস্থ করে ছাড়া হয়েছে। ট্রেনে মন্ত্রীর শ্বশুরকুলের লোকদের বিনা টিকেট কাণ্ডের তেজে অনেকটা ঢাকা পড়ে যায় এমপি পুত্রের বিনা টোলকাণ্ড।

শহর-বন্দর-জনপদে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ভাই-ভাতিজা মিলিয়ে মাননীয়দের স্বজনকাণ্ডের তালিকা দিনকে দিন কেবল দীর্ঘ হচ্ছে। তারা যে যেখানে যা পারছেন ঘটিয়ে দিচ্ছেন। সর্দি-কাশি, হাই-হাঁচির মতো মামুলি উপসর্গের আকারে তা হজম করতে হচ্ছে মানুষকে। অবিরাম এতো ঘটনার তোড়ে মানুষ ভুলেও যাচ্ছেন। কোনটা বা কয়টা মনে রাখা যায়?

রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে আরেক মাননীয়া পিনু খানের পুত্র রনির এলোপাতাড়ি গুলিতে নিরীহ ২ ব্যক্তি নিহতের ঘটনাও বিস্মৃত হয়ে গেছে অনেকের। সাফাই গাইতে গিয়ে বলা হয়েছিল, দোষ রনির নয়। দোষটা ছিল মদের। মদ খাওয়া অবস্থায় রনির মেজাজ ঠিক ছিল না। রিকশার জটে বিরক্ত হয়ে তিনি কালো রঙের আলিশান প্রাডো গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলোপাতাড়ি গুড়ি চালান। তাও মানুষের ওপর নয়, রিকশার জটের ওপর। কিন্তু মরে গেছে মানুষ।

গুলশানের ব্যস্ত সড়কে ডা. ইকবালের ভাতিজা ফারহানের কার রেসিংয়ে মেতে ৪ জনকে আধমরা করে ফেলার ঘটনাও তামাদি হয়ে গেছে সেই কবেই। কক্সবাজারের টেকনাফে আবদুর রহমান বদির ৫ ভাইয়ের সিনেম্যাটিক কাণ্ড-কীর্তিও সেই তামাদি খাতায়।

হাজি সেলিম, ঠাকুরগাঁওয়ে দবিরুল ইসলাম বা কুষ্টিয়ায় আফাজ উদ্দীনের পুত্র বা টাঙ্গাইলে আমানুর রহমান খান রানার ভাইদের উৎপাতও বাসি ঘটনা। নতুন গজিয়েছে আরও অনেক। কোনো কোনোটি ঘটনার প্যাঁচে বা বেশি আনকমন হলে প্রচার পায়। বাঁশের চেয়ে বড় হয়ে যাওয়া কঞ্চিগুলোর কর্মকাণ্ড বেজায়গায় না হলে বা আইন প্রয়োগ করার অপরাধে সরকারি কর্মচারীর মতো ঘটনা ভাইরাল না হলে সমস্যা হয় না। মন্ত্রী-এমপি, তাদের পত্নী, পুত্র-কন্যা, ভাই-ভাতিজা, শালা-সম্বন্ধী, আক্রান্ত কর্মকর্তা বা ঘটনার শিকার সবার মধ্যে ড্র হয়ে যায়। আলোচনায়ও আসে না। ঘটনা খুঁজে বের করে এগুলোকে ক্ষমতার অপব্যবহারের 'নির্লজ্জ ও নিকৃষ্টতম' উদাহরণ মনে করার দরকারই বা কী?

প্রাইভেটকার চাপা দিয়ে পথচারী সেলিম মোল্লার মৃত্যু ঘটিয়ে এমপি পুত্রের গাড়ি নিয়ে ন্যাম ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লে কারও কিছু বলার থাকে না। আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে না ঘটলে জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর দাপুটে পুত্র শারুন চৌধুরীর একে-৪৭ দিয়ে গুলিবর্ষণের ভিডিও বা সামনে দামি মদের বোতল ছড়িয়ে রেখে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়ার ঘটনা সংবাদমূল্য পেতো?  বা জুয়ার ১৮০ কোটি টাকা আয়ের অভিযোগ তোলা পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের খবর দাম্ভিকতার সঙ্গে ছড়ানোর সাহস হতো? এসব প্রশ্নের জবাব তোলাই থেকে যাচ্ছে।

গোলমালটা বাঁধছে ভিন্ন জায়গায়। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপি বা নেতার সন্তান, স্ত্রী বা স্বজনদের ক্ষমতার দাপটের বিরুদ্ধে কঠোর অ্যাকশন আসছে, এদের খুন-খারাবি থেকে শুরু করে সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যসহ নানা অপরাধের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে, শিগগিরই কঠোর পদক্ষেপ আসছে- ধরনের কিছু সংবাদে ফ্যাঁকড়া বাধাচ্ছে। কিছু গণমাধ্যমের এ ধরনের সংবাদে পুলকিত হয়ে মাঠে বোল দেওয়া ব্যক্তিরা পড়ছেন বিপদে। তাদের কারও চলে যেতে হয় খরচের খাতায়ও। তারা বুঝে উঠতে পারেন না দস্যুতার পদ্ধতিতে জনপ্রতিনিধি হয়ে যাওয়াদের পক্ষে দুনিয়ার হেন কোনো কাজ নেই, যা করা অসম্ভব?

নইলে পুলিশকে সামনে রেখে প্রকাশ্য সভায় কীভাবে একজন জনপ্রতিনিধি বলতে পারেন- 'আমি হুকুম দিয়া দিচ্ছি, এই দুষ্কৃতকারীদের গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেললে কিছু হবে না। আপনারা যদি পারেন, গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলেন। যদি কেউ আসামি করে, আমি মামলার এক নম্বর আসামি হব যে, আমি হুকুম দিয়ে গেছি'। ট্রেন-টোলকাণ্ডের সময়ই নোয়াখালীর এমপি এইচ এম ইব্রাহিম দুষ্কৃতকারীদের গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার নির্দেশটি দিয়েছেন।

সোনাইমুড়ী উপজেলার দেওটি ইউনিয়নের মুহুরীগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের স্মরণে আয়োজিত শোকসভায় দেওয়া তার বক্তব্যের ৫৩ সেকেন্ডের ভিডিওটি ওই রাতেই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বক্তব্যের সময় সভাস্থলে উপস্থিত ছিলেন সোনাইমুড়ী থানার ওসি হারুন অর রশিদ। ঘটনা পাশ কাটাতে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, তিনি সভার শেষ মুহূর্তে সেখানে গেছেন। এ কারণে এমপির বক্তব্য তিনি শোনেননি। ভিডিওটি এখনো তিনি দেখেননি। আর পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম বলেছেন, 'এমপি মহোদয় কোন প্রেক্ষাপটে ওই বক্তব্য রেখেছেন, তার পুরো বক্তব্যের ভিডিও না দেখে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে না'।

যত বড় মাননীয় বা মহাশয়ই হোন, গণপিটুনি দিয়ে কাউকে মেরে ফেলার নির্দেশের মধ্যে পুলিশের অস্তিত্বও অস্বীকারের মানসিকতা নিহিত। এই পুলিশ বা সরকার কর্তৃক দেশ আর চলছে না- এমন ঔদ্ধত্য লুকানো হুমকিটির মধ্যে। অথচ সেখানেও পুলিশের পাশ কাটানোর চাতুরী। আনুগত্যের এই কদর্যরূপ শিষ্টের দমন আর দুষ্টের পালনকে বেগবান না করে পারে?

মোস্তফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

1h ago