‘মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের বহু আনন্দময়, স্বপ্নময়, গৌরবময় স্মৃতি’

মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ওয়াশিংটন ডিসিতে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এটা রেডিওতে শুনে আমরা ন্যাশভিলের ৬ জন বাঙ্গালি তাৎক্ষণিকভাবে একত্র হয়ে বাংলাদেশ সিটিজেনস কমিটি গঠন করলাম। প্রত্যেকে এক হাজার ডলার জমা করে একটা তহবিল বানালাম।

আমি ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় উচ্চতম ব্যক্তি এনায়েত করিমকে ফোন করলাম। বললাম, আমি ওয়াশিংটন রওনা হচ্ছি। সবার সঙ্গে আলাপ করে কর্মসূচি তৈরি করতে হবে। তিনি আমাকে উৎসাহ দিলেন চলে আসার জন্য। ৬ হাজার ডলারের তহবিল সঙ্গে নিয়ে পরদিন ওয়াশিংটনে গিয়ে সোজা উঠলাম এনায়েত করিমের বাসায়, যার সঙ্গে কোনো দিন আমার পরিচয় ছিল না।

এরপর ওয়াশিংটনে প্রায় রাতে মুহিত ভাইয়ের বাসায় সবাইকে নিয়ে বসা আমাদের নিয়মিত কাজ হয়ে দাঁড়ালো। নানা সংবাদ আদান-প্রদান করা, নানা উত্তেজনাপূর্ণ বিতর্ক, হাতাহাতি—সব কিছুই এই বৈঠকের অংশ হয়ে দাঁড়ালো। যারা ওয়াশিংটনের লোক তারা সারাদিন অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আমরা কয়েকজন যারা অন্য শহর থেকে এসেছি তারা সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে কাজ করতে থাকলাম।

একদিন মুহিত ভাই বললেন, একটা ওয়্যারলেস সেটের জন্য কিছু টাকার দরকার। আমি ন্যাশভিলের ৬ হাজার ডলার তার হাতে দিয়ে দিলাম।

আমরা কয়েকজন আরেকটা দায়িত্ব নিলাম। সেটা হলো, বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অনুরোধ জানানো। মুহিত ভাই আমাদের সঙ্গে দূতাবাসগুলোর পরিচয় করিয়ে দিতেন এবং আমাদের ব্রিফ দিতেন, কার কাছে কীভাবে আমাদের প্রস্তাবটি উত্থাপন করতে হবে।

দেশে ফিরে আসার পর আবার মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হলো তারই উদ্যোগে। তিনি আমার কর্মসূচি সম্বন্ধে জানতে চান। তিনি সরকারি চাকরিতে বিরক্ত হয়ে গেছেন। বললেন, তিনি আমার কর্মকাণ্ড চাক্ষুষ দেখতে চান। আমি সানন্দে ব্যবস্থা করলাম। তাকে নিয়ে পুরো একটা দিন টাংগাইলের হাঁটুভাংগা শাখায় কাটালাম। তার হাজারো প্রশ্নের জবাব দিলাম। ঢাকা ফেরার পথে অনেক কথা বললেন। তিনি চাকরি ছেড়ে দেবেন। আমার সঙ্গে গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করবেন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা স্থাপন করবেন সিলেটে।

পরবর্তীতে শুনলাম তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তারপর বোধ হয় বিদেশ চলে গেছেন। আবার দেখা হলো ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে। কুমিল্লা একাডেমীতে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। আমরা ২ জনেই সম্মেলনের বক্তা। আগের দিন সন্ধ্যায় অনেক আলাপ হলো। বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এ নিয়ে আমি একটা কনসেপ্ট পেপার লিখেছিলাম। সেটা তাকে দিলাম এবং মুখে সবিস্তারে বুঝালাম।

সম্মেলনের পরের দিন সকাল বেলা আমাদের সবার ঢাকায় ফেরার কথা। কিন্তু হঠাৎ সারা দেশে কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে। জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন জারি করেছেন।

আমরা কুমিল্লায় আটকে গেলাম। ২ জনে আরও বহু কথা বলার সুযোগ পেলাম। কারফিউ প্রত্যাহারের পর সন্ধ্যায় ঢাকা ফিরলাম। পরদিন ঘোষণা শুনলাম মুহিত ভাই নতুন সরকারে অর্থমন্ত্রী হিসেবে যোগ দিয়েছেন। আমি অভিনন্দন জানালাম। তিনি দেখা করার জন্য খবর পাঠালেন। মনে মনে খুশি হলাম এই ভেবে যে, এবার গ্রামীণ ব্যাংককে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সুযোগ পাবো।

দেখা করলাম। তারপর ঘটনা এগুতে থাকলো। এক পর্যায়ে এসে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ হলো। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হলো, নতুন ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে। আমরা অনুষ্ঠানের জন্য এক পায়ে খাড়া, কিন্তু মন্ত্রণালয় চায় এটা ঢাকায় করতে। আমরা বেঁকে বসলাম।

আমরা বললাম, গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান গ্রামে হবে। মন্ত্রণালয় কিছুতেই এতে রাজি না। আমি মুহিত ভাইকে ফোন করলাম। তিনি সোৎসাহে বললেন, অবশ্যই এটা গ্রামে হবে এবং আমি সেখানে যাবো।

১৯৮৩ সালের ৩ অক্টোবর টাংগাইলের জামুর্কী গ্রামে ভূমিহীন নারীদের এক বিরাট সমাবেশের মাধ্যমে মুহিত ভাইয়ের উপস্থিতিতে গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হলো।

তার সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের বহু আনন্দময়, স্বপ্নময়, গৌরবময় স্মৃতি স্মরণ করে মুহিত ভাইকে বিদায় জানাচ্ছি। আল্লাহ তার রূহের মাগফেরাত দান করুন।

Comments

The Daily Star  | English

S Alam threatens int'l legal action against govt over asset freezing: FT

Alam says his family's bank accounts were frozen, they were subjected to travel bans, and they lost control of their companies, all while facing investigations for alleged money laundering without formal notification.

53m ago