ইলন মাস্ক টুইটার কেনায় কেন এত আলোড়ন

ছবি: রয়টার্স

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন ইলন মাস্ক। এই খবরে সারা বিশ্বের মানুষ যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাতে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন এই অধিগ্রহণের ফলে সার্বিকভাবে ইন্টারনেটের গতিপ্রকৃতি বদলে যেতে পারে।

সিএনএনের এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাগজে-কলমে মনে হতে পারে টুইটার খুবই সাধারণ একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এই প্লাটফর্মে গ্রাহক সংখ্যা ও বাজার মূল্য ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার ১০ ভাগের ১ ভাগ। কিছুদিন আগেও টুইটারের শেয়ারের মূল্য প্রতিষ্ঠানটি ৮ বছর আগে পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরুর সময়ের মূল্যের সমান ছিল।

তবে মাস্ক টুইটার কিনে নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করার পর থেকেই মার্কিন আইনপ্রণেতারা নড়েচড়ে বসেছেন। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এর প্রভাব কী হতে পারে, সেটা নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল জল্পনা-কল্পনা।

এ পর্যন্ত টুইটারের মূলমন্ত্র ছিল 'ইতিবাচক আলোচনাকে' উদ্বুদ্ধ করা। তবে ইলন মাস্ক এতে পরিবর্তন আনতে পারেন।

সবাই কেন টুইটার বিক্রির বিষয়টিকে এত বড় করে দেখছেন?

এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় জনমতের গঠনে টুইটারের বড় প্রভাবকে। যখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এই অসম্ভব জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী প্ল্যাটফর্মকে কিনে নিচ্ছেন এবং এর ওপর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন, তখন স্বভাবতই তা অনেকের মাথা ব্যথার কারণ হবে।

ফেসবুকের তুলনায় টুইটারের দৈনিক সক্রিয় গ্রাহক অনেক কম হলেও এর ব্যবহারকারীদের মাঝে রয়েছেন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, বিনোদন কর্মী, আন্দোলনকারী ও বুদ্ধিজীবীরা। তাদের রয়েছে অসংখ্য ফলোয়ার। এই মানুষগুলোর একটি টুইট রাজনীতি, গণমাধ্যম, অর্থায়ন ও প্রযুক্তি সম্পর্কে জনমত বদলে দিতে পারে নিমিষেই।

এক গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে, মার্কিন টুইটার ব্যবহারকারীদের ৬৬ দশমিক ৭ শতাংশই মনে করে, সংবাদের জন্য টুইটার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

মাস্কের টুইটার কেনার সিদ্ধান্ত বেশ কিছু চলমান সামাজিক বিতর্ককে উস্কে দিয়েছে। যার মাঝে রয়েছে কোটিপতিদের ক্ষমতা ও প্রভাব, অনলাইনে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের প্রভাব এবং গ্রাহক ও সার্বিকভাবে সমাজের প্রতি প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোর দায়বদ্ধতা।

অনেক বিশ্লেষক আশংকা প্রকাশ করেছেন, মাস্ক টুইটার কেনার পর প্ল্যাটফর্মটির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আরও কমে যেতে পারে।

সাবেক ফেসবুক কর্মকর্তা ও সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেসের প্রযুক্তি নীতিমালা সংক্রান্ত বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যাডাম কনর জানান, অল্প কয়েকজন কোটিপতির হাতে সব অনলাইন প্ল্যাটফর্মের নিয়ন্ত্রণ থাকা এক ধরনের অশনি সংকেত ও বিপজ্জনক।

মাস্কের ডিজিটাল নগরকেন্দ্র

একজন খেয়ালি কোটিপতি হিসেবে বিবেচিত মাস্কের রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার ইতিহাস। তিনি দাবি করেন, মানব সভ্যতার ভবিষ্যতের জন্য তার টুইটার কিনে নেওয়ার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হিসেবে তিনি জানান, বিশ্বের এমন একটি ডিজিটাল নগরকেন্দ্র প্রয়োজন, যেখানে সবার প্রবেশাধিকার রয়েছে এবং যেটি বাকস্বাধীনতার নীতিমালা মেনে চলে।

নিয়মিত ব্যবহারকারী হয়েও মাস্ক টুইটারের একজন কড়া সমালোচক। তিনি জানান, এই প্ল্যাটফর্মটিতে অনেক বেশি প্রতিবন্ধকতা। তার মালিকানায় গেলে টুইটারে কন্টেন্ট প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বাড়বে এবং কন্টেন্ট মডারেশন ও অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ করার মতো বিষয়গুলো কমে আসবে। এমনকি, তিনি জনসাধারণের জন্য টুইটারের অ্যালগোরিদম প্রকাশ করার পক্ষেও মত দেন।

তার মতে, এতে গ্রাহকরা বুঝতে পারবেন কীভাবে এই প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

নতুন মালিকানায় যাওয়ার পর টুইটারের দৈনন্দিন কার্যক্রমে কী পরিবর্তন আসবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। মাস্ক এখনো এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। কন্টেন্ট মডারেশন নিয়ে তার আপত্তি মূলত এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। কন্টেন্ট মডারেশন নিয়ে তার কোনো আপত্তি নেই।

এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের মনে আসা একটি বড় প্রশ্ন হচ্ছে, টুইটারের নীতিমালা লঙ্ঘনের জন্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পসহ আরও অনেকের অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তে কোনো পরিবর্তন আসবে কি না। অনেকেই ভাবছেন মাস্ক সব নিষিদ্ধ অ্যাকাউন্ট আবারও চালু করে দেবেন। টুইটার বিক্রির ঘোষণায় বিতর্কিত মার্কিন রাজনীতিবিদ মারজোরি টেলর গ্রিনসহ অনেকে উল্লাস প্রকাশ করেন।

তবে ট্রাম্প জানান, ইলন মাস্ক টুইটার কিনে নেওয়ার পর তার অ্যাকাউন্ট আবার খুলে দেওয়া হলেও তিনি আর সেখানে ফিরবেন না।

তিনি বলেন, 'আমি টুইটারে যাচ্ছি না। আমি ট্রুথের (ট্রুথ সোশ্যাল) সঙ্গে থাকবো।'

এমন সময় মাস্ক টুইটার কিনেছেন, যখন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনপ্রণেতারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে কন্টেন্ট মডারেশনের আরও কঠোর নীতিমালা অনুসরণের পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে আরও নমনীয় মনোভাব রক্ষা করতে চান মাস্ক।

বিশ্লেষকদের মত, টুইটারের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্মে কন্টেন্ট মডারেশনের ক্ষেত্রে শিথিলতা আনলে তা সব ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতায় পরিবর্তন আনবে। বিশেষ করে, নারী, এলজিবিটি সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র ণৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের জন্য এ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। এই প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আলোচনার যে রীতি, সেখানেও আসতে পারে পরিবর্তন, যা সারা বিশ্বকে প্রভাবিত করবে।

মাস্কের ব্যক্তিগত অর্জন

টুইটার কেনায় ইলন মাস্কের ব্যক্তিগত সম্পদের সাম্রাজ্য আরও অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। টেসলা ও স্পেস এক্সের পর তার মুকুটে যোগ হয়েছে নতুন একটি পালক।

এই মুহূর্তে বলা যায়, ইলন মাস্ক আমেরিকার সবচেয়ে মূল্যবান গাড়ি নির্মাতা, একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ প্রতিষ্ঠান, একটি ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যমানের সুড়ঙ্গ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, একটি মস্তিষ্কে বসানোর উপযোগী বৈদ্যুতিক চিপ নির্মাণকারী স্টার্টআপ ও হাজার কোটি গ্রাহক সমৃদ্ধ একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মালিক।

টুইটারের ওপর মাস্কের প্রভাব নিশ্চিত করবে যে, তিনি পছন্দ মতো টুইট করতে পারবেন এবং সঙ্গে তিনি যথেষ্ট পরিমাণ রাজনৈতিক ক্ষমতারও মালিক হচ্ছেন। যে ক্ষমতার ভার শুধুমাত্র তার মতো একজন কোটিপতির পক্ষেই বহন করা সম্ভব। সব মিলিয়ে, টুইটার অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত তার অন্যান্য ব্যবসাগুলোর জন্যেও ইতিবাচক একটি বিষয়।

তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন না মাস্ক টুইটারের মালিকানার বিষয়টিকে ব্যবহার করে অন্যদের কাছ থেকে অন্যায় সুযোগ সুবিধা আদায় করবেন।

মাস্ক টুইটে জানান, 'আমি আশা করবো আমার সবচেয়ে কড়া সমালোচকরাও টুইটারে থাকবেন, কারণ সেটাই বাক স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ।'

তবে মাস্ক এর আগেও রাতারাতি তার মনোভাব পরিবর্তন করেছেন। এই টুইটকে কোনো ধরনের প্রতিশ্রুতি হিসেবে ধরে না নেওয়াই ভালো হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

1h ago