ওয়ানডের অর্জন মানুষ দ্রুত ভুলে যাচ্ছে, এটা দুঃখজনক: তামিম
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে এবার অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা পেয়েছে বাংলাদেশ দল। পূর্ণ শক্তির প্রোটিয়াদেরকে প্রথমবারের মতো ওদের দেশে হারিয়ে জিতেছে ওয়ানডে সিরিজ। ঐতিহাসিক সেই জয় টেস্টে নেমেই পড়ে গেছে আড়ালে। প্রোটিয়া স্পিনে বিধ্বস্ত হয়ে বাংলাদেশ হয়েছে নাজেহাল। ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল ঘটনাবহুল সেই সিরিজ নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।
এক বছর পর টেস্টে ফিরলেন। ফেরাটা কেমন ছিল?
তামিম ইকবাল: ভালো তো অবশ্যই লাগছে। খেলার কথা তো প্রথমটাই ছিল, শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে খেলতে পারিনি। টেস্ট ক্রিকেট এমন একটা খেলা যেটাকে আমি অধিক মূল্য দেই। এখানে যদি আপনি রান করেন, সেঞ্চুরি করেন এটা যতটা নজর কাড়বে, অন্য সংস্করণে তা কাড়বে না।
ভালো লেগেছে আমি আবার টেস্ট খেলা শুরু করেছি। আর সন্তুষ্টির কথা যদি বলেন সবাই আমরা যেভাবে খেলেছি এরচেয়ে ভালো কিছু হলে জিনিসটা ভালো লাগত। দল হিসেবে আপ টু দ্য মার্ক ছিলাম না।
লম্বা সময় পর ফিরে দলের মধ্যে কোন বদল দেখতে পেয়েছেন?
তামিম: এক বছর শুনতে অনেকদিন লাগে। কিন্তু খুব সম্ভবত আমি ৫ বা ৬টা টেস্ট ম্যাচ মিস করেছি ইনজুরির কারণে। যখন ওয়ানডে সিরিজ শেষ করলাম আমরা জানতাম যে আমরা টেস্টেও ভাল কিছু করতে পারি। প্রথম চারদিন পর কিন্তু কেউ জানত না কে জিতবে। পঞ্চম দিনে গিয়ে আসলে আমরা খারাপ খেলেছি। সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। আমার মনে হয় আমরা ভাল বলও করিনি। যে উইকেটে খেলা হয়েছিল সেখানে সাড়ে চারশো রান হওয়ার কথা না। ওদিক থেকে সবাই হতাশ। শুধু আমি না দলের প্রত্যেকেই। আর পরিবর্তন যেটা বলছেন...আমরা ভাল করতে পারি এই বিশ্বাস ছিলই। কিন্তু যেটা বাড়তি যোগ হয়েছে নিউজিল্যান্ডে টেস্ট জেতা। দলের জন্য মোর্যাল বোস্টআপ ছিল।
ওয়ানডে সিরিজ জেতার পর মোমেন্টাম ছিল তারপরও কেন টেস্টে হলো না?
তামিম: আমার মনে হয় ওয়ানডে দল খুবই থিতু। যেটা আমরা অনেকদিন ধরেই। টেস্ট ম্যাচ যদি বলি আমরা এখনো আপ টু দ্য মার্ক না। আর সমস্যাটা হলো ওই জেতার পর (নিউজিল্যান্ডে) প্রত্যাশা অনেক উঁচুতে চলে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমরা ওই জয়ের আগেও যেমন ছিলাম তেমন দলই আছি। বিশ্বাসটা শুধু বেড়েছে। দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ যদি বলেন আমরা খারাপ খেলেছি। কিন্তু প্রথম টেস্টে চারদিন পর্যন্ত লড়াইয়ে ছিলাম। ২২ বছরের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় এমন লড়াই হলো প্রথমবার। বাস্তবতাটাও আপনার দেখতে হবে।
আপনারা অনেক আক্রমণ করে খেলেছেন বিশেষ করে দ্বিতীয় টেস্টে, এর পেছনে ভাবনাটা কি ছিল?
তামিম: অবশ্যই দলের একটা পরিকল্পনা থাকে। ব্যক্তি খেলোয়াড়েরও একটা পরিকল্পনা থাকে। আমি সাধারণত টেস্ট ক্রিকেটে আক্রমণ করে খেলি। এটা প্রথমবার নয়। অন্যদের কথা যদি বলি অবশ্যই আমরা কিছু ভুল করেছি। এটাতে আমি কোন ব্যাখ্যাও দিব না। আমরা অবশ্যই ভুল জিনিস (শট) বেছেছি। আর আক্রমণাত্মক থাকা না থাকা নিয়ে যেটা বলি, একটা জিনিস আপনার বুঝতে হবে বল টার্ন করছিল অনেক। আপনি যদি ঠেকাতেও যান বাউন্স টার্নে পরাস্ত হয়ে ক্যাচ যাবে। আমি বলছি না অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক হওয়া উচিত ছিল। আমরা যদি আক্রমণ-রক্ষণে একটা মিশেল রাখতে তাহলে হয়ত ভাল হত। এটা অনেকটা ব্যক্তির খেলার পরিকল্পনার উপর নির্ভর করে। যত কিছুই বলি না কেন আমরা ভাল খেলিনি এটাই সত্য।
স্পিনের বিপক্ষে কেন এতটা ভোগান্তির কারণ কি?
তামিম: কাজের কোন শেষ নাই। অনেক উন্নতির জায়গা আছে। দ্বিতীয় টেস্টে যে ধরণের বল করছিল ব্যাট করা ছিল কঠিন। আমাদের একটা উপায় বের করতে হবে। এই ধরনের পরিস্থিতি যদি আবার আসে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে আমরা কীভাবে আরও ভাল করতে পারি।
দ্বিতীয় টেস্টে তাসকিন-শরিফুলের না থাকার প্রভাব কতটা ছিল?
তামিম: টেস্ট ক্রিকেটে অনেকদিন পর এমন হয়েছে যে আমরা তিনটা পেসার নিয়ে খেলতে পারি। আমরা দেশে একটা পেসার নিয়ে খেলতাম, বিদেশেও দুইটার বেশি পেসার খেলাতাম না। এখন আমরা নিয়মিত তিন পেসার নিয়ে খেলি। এজন্য মুমিনুলকে কৃতিত্ব দিতে হয় কারণ সে এই জায়গাটা তৈরি করেছে। ওদের না থাকা একটা ধাক্কা ছিল। তবে আমরা সব বিভাগ মিলিয়ে ভাল খেলিনি তাই এরকম ফল হয়েছে।
টেস্টে পাঁচ বোলার নিয়ে খেলার সময় কি এসেছে?
তামিম: পাঁচ বোলার নিয়ে খেললে যেকোনো অধিনায়কের জন্যই বাড়তি অপশন থাকে। মিরাজ যেভাবে খেলছে (ব্যাটিংয়ে) ওটা যদি সে চালিয়ে যায়, তাহলে টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচক, অধিনায়করা বিবেচনা করবে যে সে একটা বাড়তি ব্যাটসম্যান।
আম্পায়ারের সঙ্গে প্রথম টেস্টে নেমে কথা বলছিলেন, আসলে ওই ম্যাচে কি হয়েছিল?
তামিম: সব কিছুতে তিলকে তাল বানালে তো সমস্যা। জিনিসটা হলো অনেক দলের সঙ্গে খেলেছি এরকম আমরাও বলেছি (স্লেজিং), ওরাও বলেছে। আমার আম্পায়ারকে বলা, এই বলা যতটা রটেছে ততটা না। মরিসের (এরাইসমাস) সঙ্গে আমার খুব ভাল সম্পর্ক। আমার যদি কিছু মনে হয় ওকে আমি বলতেই পারি, কারণ তার সঙ্গে আমার সেরকম সম্পর্ক আছে। যদি এমন কিছু বলতাম যেটা শৃঙ্খলা বিরোধী আমি তো একটা ওয়ার্নিং পেতাম। এটা আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেট। এখানে সীমা ছাড়ালে তো কেউ ছাড় পাবে না। যতটুকু ছড়ানো হয়েছে ততটুকু কিছু না।
একটা কথা রটেছে মুমিনুলের উপর সিনিয়রদের প্রভাব আছে। মুমিনুল স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।
তামিম: এটা হাস্যকর কথা। এটা একদম সত্য না। আমি যখন অধিনায়ক থাকি অনেকের থেকে পরামর্শ নেই। পরামর্শ নেওয়ার পরে ফলাফল যদি ওটা (খারাপ) আসে আমি তো কাউকে দোষ দিতে পারি না। আমার কাছে যদি মুমিনুল কোন পরামর্শের জন্য আসে দলের বেস্ট ইন্টারেস্ট দেখে আমার যা বলার আমি তা বলি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কোচ আর অধিনায়কের। মুমিনুল টেস্ট অনেকদিন যাবত খেলছে। আমাদের দারুণ সম্পর্ক আছে। মুমিনুল যদি বলে, 'তামিম ভাই, আমি ডানে যাব। আর আমি যদি বলি এই খবরদার ডানে যাবে না'। এভাবে করে তো ক্রিকেট হয় না। এভাবে তো মানুষও চলে না।
ওয়ানডে সিরিজে জয়টা কত প্রভাব রাখবে?
তামিম: আমার মনে হয় এটা বিশাল অর্জন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটা সবাই ভুলে যাচ্ছে এটা হচ্ছে দুঃখজনক ব্যাপার। এটা ছিল আমাদের সেরা অর্জন। এমন একটা দলকে হারিয়েছি যারা পুরো শক্তির ছিল। যারা কদিন আগেই ঘরের মাঠে বিশ্বের সেরা এক দল ভারকে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ হারিয়েছে। এটা খুব দুঃখজনক মানুষ দ্রুত ভুলে যাচ্ছে।
ওয়ানডেতে আমরা থিতু দল। সেটা ৮ বছর ধরে। আমাদের একটা সমস্যা ছিল আমরা বিদেশে জিততে পারছিলাম না। এই জয়টা আমাদের সেই বিশ্বাস দিয়েছে যে বিদেশেও জিততে পারি।
২০২৩ সালের বিশ্বকাপ নিয়ে স্বপ্ন কি?
তামিম: আমরা যেভাবে খেলছি তাতে স্বপ্ন না দেখার তো কারণ আমি দেখি না।
সে স্বপ্ন কতটা বড়?
তামিম: অল দ্য ওয়ে
এই খেলাটাই ধরে রাখতে চান নাকি উন্নতির জায়গা আছে?
তামিম: আমাদের কিছু স্পট আছে যেগুলো এখনো পাকাপোক্ত হয়নি। এই বক্সগুলো যদি টিক মার্ক হয়ে যায় অধিনায়ক হিসেবে আমি খুবই সন্তুষ্ট হব।
টি-টোয়েন্টি নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কি?
তামিম: টি-টোয়েন্টি নিয়ে আমার পরিকল্পনা আপনারা কমবেশি জানেন। আমি যদি কখনো কোন কিছু না খেলি, কোন ফরম্যাট না খেলি সেটা হুট করে জানাই না। অনেক আগেই জানিয়ে দেই। আমি খুবই পরিষ্কার এই ব্যাপারে। শেষ মুহূর্তে জানাই না। যেহতু ক্রিকেট বোর্ড আমার গভর্নিং বডি। আমি আমার পরিকল্পনা তাদের জানাব। কিছুদিনের মধ্যে আপনারাও জানতে পারবেন এই ব্যাপার, তবে এরমধ্যে ক্রিকেট বোর্ড জানে।
ক্রিকেট বোর্ড থেকে অভিযোগ আছে সিনিয়ররা তাদের পরিকল্পনা আগে থেকে জানায় না
তামিম: আমার ব্যাপারে মনে হয় না এই অভিযোগ আছে। আমি সব সময় এই ব্যাপারে পরিষ্কার। সিরিজে ছুটি নিয়েছি এক-দুই সিরিজে। এর বেশি না। মিস করেছি অনেক ইনজুরির কারণে। ক্রিকেট বোর্ডের আমার ব্যাপারে এই অভিযোগ আছে বলে মনে হয় না।
এখানে দুটো পরিস্থিতি আছে। কেউ যদি আগে থেকে কিছু ঠিক করে আগেই জানিয়ে দেওয়া উচিত। আবার কিছু জরুরি পরিস্থিতিও চলে আসে যেটা আগে কেউ বলতে পারে না।
ক্রিকেট জীবনে তামিম ইকবালের পরবর্তী স্বপ্ন কি?
তামিম: আমার এখন একটাই স্বপ্ন, ব্যক্তিগত কোন স্বপ্ন না। দেশের জন্য একটা ট্রফি জেতা।
Comments