কন্যাশিশু কি মসজিদে নিষিদ্ধ?
প্রায় ২৪-২৫ বছর আগে সিলেটে হজরত শাহজালাল (র.) এর মাজার জিয়ারত করতে গিয়েছিলাম। নারীদের হজরত শাহজালালের মাজার শরিফের বা কবরস্থানের কাছে যেতে দেওয়া হয় না। নারীরা নিচ থেকে দোয়া পড়ে চলে আসবেন, এটাই ছিল নিয়ম। এখন কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা আমি জানি না।
হঠাৎ দেখলাম একজন ভদ্রলোক তার একবছরের কন্যা সন্তানকে কোলে নিয়ে মাজারে ওঠার চেষ্টা করলে ষণ্ডা ধরনের একজন ওই ভদ্রলোককে উপরে উঠতে বাধা দিলেন। বললেন, মেয়েদের উপরে ওঠার অনুমতি নেই। এই কথা শুনে ভদ্রলোক চরম বিরক্ত হলেন, বললেন, এক বছরের শিশুর আবার ছেলে-মেয়ে ভেদাভেদ কী? আমার সঙ্গে এসেছে, ও-তো আমার সঙ্গেই যাবে। কিন্তু না, সেই লোক কিছুতেই মানতে চাইলো না। শেষপর্যন্ত ভদ্রলোক তার শিশুটিকে নিয়ে আর উঠতে পারেননি।
এতদিন পরে নরসিংদীর রায়পুরায় বাবার সঙ্গে এক কন্যাশিশুর মসজিদে যাওয়াকে কেন্দ্র করে সংঘাতের জেরে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা দেখে মনে হলো, সেদিনের ওই ভদ্রলোক মেয়েশিশুকে নিয়ে শাহজালাল (রা.) এর দরগায় ওঠার জন্য বেশি বাহাস করলে, হয়তো তাকেও প্রাণ দিতে হতো। তবে একথা সত্য যে, দুই যুগ আগে আমাদের মনোজগতে হিংস্র আচরণ সেভাবে বাসা বাঁধতে পারেনি, যতোটা এখন পেরেছে।
কিছু কূপমণ্ডূক মানুষ নিজেরাই ধর্মগুরু সেজে বা মাজারের দেখভালের দায়িত্ব নিয়ে সেখানে বিভিন্ন ধরণের নিয়ম কায়েম করে যাচ্ছে। তুরস্ক থেকে আসা হজরত শাহজালাল (রা.) একজন বড় আউলিয়া ও সুফি সাধক ছিলেন। ৬৯ বছর বয়সে উনি চিরকুমার অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সম্ভবত সেখান থেকেই ধারণা করা হয়েছিল ওনার মাজারে নারীদের প্রবেশ একটা অংশ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেরকম একটা নিয়ম তারা করতেই পারে, কিন্তু তাই বলে একবছরের শিশুকেও যেতে দেওয়া হবে না তার বাবার সঙ্গে? যতদূর দেখেছি মক্কা-মদিনা, তুরস্ক, মিশর, ভারত, পাকিস্তানের মাজার ও দরগাহগুলোতে নারী ও কন্যাশিশুদের প্রবেশে কোনো বাধা নেই।
প্রসঙ্গে ফিরে আসি, বাহাদুরপুর গ্রামের নুরুল ইসলাম তার ৪ বছরের মেয়ে নুসরাতকে নিয়ে মাগরিবের ওয়াক্তে বাড়ির পাশের মসজিদে যান। জামাত শুরু হলে মেয়েকে নিয়ে ইমামের পেছনের সারিতে দাঁড়ান। এ নিয়ে আপত্তি তোলেন প্রতিবেশী আলাউদ্দিনসহ আরও কয়েকজন। এরই জেরে নামাজের পর দুজনের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। একপর্যায়ে আলাউদ্দিনকে মারধর করেন নুরুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা।
মামা আহত হওয়ার সংবাদ শুনে রাতে তাকে দেখতে আসেন ভাগনে লাল চাঁন। তিনি বাড়ি ফেরার পথে নুরুল ও তার দলবল লাল চাঁনকে কুপিয়ে জখম করেন।
এখানে যে দুটি বিষয় আলোচনার দাবি রাখে তা হলো, আমরা সহিংস হয়ে উঠছি। কোনো বিষয়ে কথা কাটাকাটি বা ঝগড়া হলে প্রতিপক্ষকে কুপিয়ে মারতে হবে কেন? এ এক অস্থির মানসিকতার লক্ষণ। খুন, জখম খুব স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের মধ্যে।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, লাল চাঁন কোনোকিছুর সঙ্গে জড়িতই ছিলেন না। তাহলে তাকে কেন মারা হলো? অহেতুক একজন মানুষকে হত্যা করতেও এখন আর আমাদের হাত কাঁপে না। এই শিশুকে হয়তো এরকম একটা ট্রমা নিয়ে বড় হতে হবে যে, তার জন্য মারামারি হয়েছে এবং একজন মানুষকে তার বাবা হয়তো দলবল নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। ছোট একটা হাতাহাতি থেকে হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটে গেল।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গ হচ্ছে, মসজিদে ৪ বছরের একটি মেয়ের প্রবেশ নিয়ে কেন খুন-খারাবি হয়ে গেল? এটা কি আদতে কোনো অপরাধ? ধর্মীয় বিধানের অমর্যাদা? ইমামের পেছনে যদি একজন তার ৪ বছরের মেয়েকে নিয়ে নামাজ আদায় করেন, তাহলে অসুবিধাটা কোথায়? কেন অন্য একজনকে এটা নিয়ে কথা বলতে হলো এবং হাতাহাতি থেকে একজন খুন হয়ে গেলেন।
আসুন তাহলে জানি, মসজিদে নারী বা কন্যা শিশুর প্রবেশ কি নিষিদ্ধ? একদম না। অজ্ঞতার থেকে কিছু মানুষ শিশুদের মসজিদে যেতে নিষেধ করেন। অথচ এ ধরনের কাজ অনুচিত। নবী করিম হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিশুদের মসজিদে আনতে বলেছেন। তবে খুব ছোট শিশুদের আনতে নিষেধ করেছেন। কারণ তারা নামাজ চলাকালীন কান্নাকাটিসহ নানা ধরনের ঝামেলা তৈরি করতে পারে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য নামাজিদের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি হতেই পারে।
এক হাদিসে আবু কাতাদা আল আনসারি (রা.) বর্ণনা করেছেন, 'রাসুল (সা.) তার নাতনী উমামাহকে কাঁধে নিয়ে নামাজ আদায় করছিলেন। উমামাহ হলো আবুল আস বিন রাবি ইবনে আবদে শামসের ঔরসে রাসুল (সা.) এর মেয়ে জয়নব (রা.) এর সন্তান। রাসুল (সা.) সিজদায় যাওয়ার সময় উমামাহকে নামিয়ে রাখতেন এবং উঠে দাঁড়ানোর সময় আবার কাঁধে উঠিয়ে নিতেন। (বুখারি, হাদিস: ১/১০৯) (সূত্র: মুফতি আসিম নাজিব, 'শিশুদের মসজিদে নেওয়া যাবে কি?') এর পরও কি আমরা মনে করব, কেউ মেয়েশিশুদের মসজিদে নিয়ে গেলে তাকে মারধর করা উচিত?
আর এক হাদিসে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) ছোটবেলার স্মৃতি বর্ণনা করে বলেন, 'এক রাতে আমি নবী (সা.) এর পেছনে বাম পাশে নামাজে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তিনি নামাজরত অবস্থায় আমাকে টেনে নিজের ডান পাশে দাঁড় করিয়ে দেন।' (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১/২৫৫) শিশুরা মসজিদে আসুক এটা নবিজি চাইতেন। কারণ মসজিদ হচ্ছে নামাজ শেখার উত্তম স্থান। শিশু বলতে মেয়ে শিশু ও ছেলে শিশু দুই বোঝায়। কোথাও আলাদা করে শুধু ছেলে শিশুর কথা বলা হয়নি।
শুধু তাই নয় নবিজি শিশুদের এতটাই ভালবাসতেন যে তাদের কথা মনেরেখে নামাজ কতটা দীর্ঘ করবেন সেটাও ভেবে নিতেন। যেমন রাসুল (সা.) বলেছেন, 'আমি নামাজে দাঁড়ানোর পর তা দীর্ঘায়িত করার ইচ্ছা করি। কিন্তু কোনো শিশুর কান্না শোনার পর নামাজ সংক্ষিপ্ত করে ফেলি, এই ভয়ে যে, শিশুটির মা হয়তো কষ্ট পাচ্ছে। (বুখারি, হাদিস: ১/১৪৩)
অন্য একটি বর্ণনায় আরও এসেছে, একদিন সিজদায় থাকা অবস্থায় রাসুলের (সা.) নাতি হাসান ও হোসাইন এসে তার পিঠে চড়ে বসে। কিন্তু তারা নেমে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি নিজে সরাননি। ফলে দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত তিনি সেজদারত থাকেন। নামাজ শেষে তার কাছে দীর্ঘক্ষণ সেজদায় থাকার কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি জবাব দিলেন, 'আমার নাতিরা আমার পিঠে চড়ে বসেছিল। আমি তাদের বিরক্ত করতে চাইনি।' (সুনানে নাসায়ি, হাদিস: ১১৪১)
নামাজ শেষ করে তিনি নাতিদের কোলে তুলে নেন। (আবু ইয়ালা মাওসিলির আজ-জাওয়াইদ গ্রন্থে আনাস (রা) এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন। উপর্যুক্ত দুটি সূত্র থেকে একই ধরনের বর্ণনা বুখারি ও মুসলিমেও রয়েছে)। মসজিদে শিশুদের সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর আচরণ এমনই ছিল।
তাই আমাদের ওলামা মাশায়েখ ও ইমামদের কাছে অনুরোধ করছি ওয়াজে ও খুৎবা পাঠকালে নারীবিদ্বেষী কথা না বলে, এইসব বিষয়ে সাধারণ মানুষকে জ্ঞান দান করুন, যাতে সবাই জানতে পারেন মসজিদে শিশুদের সঙ্গে রাসুল (সা.) কেমন ব্যবহার করতেন। তাহলেই হয়তো ধর্ম নিয়ে এই ধরনের মারামারি ও হত্যাকাণ্ড ঘটবে না। আপনারা ধর্ম নিয়ে জনমত প্রভাবিত করেন, আপনারা ধর্ম বিষয়ে পড়াশোনা করেন, আপনাদের কথাই মানুষ বিশ্বাস করে। কাজেই ধর্ম নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের।
নরসিংদীর সেই মসজিদের ইমামের উচিত ছিল হাদিস উল্লেখ করে বক্তব্য দেওয়া, তাহলে হয়তো নুরুল ও আলাউদ্দীনের মধ্যে হাতাহাতি এবং লাল চাঁনকেও হত্যা করা হতো না। কিন্তু তা না করে তিনি বলেছেন, বিষয়টি লক্ষ্য করেননি।
ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব টরন্টোর সিনিয়র লেকচারার ও ইসলাম বিষয়ক পণ্ডিত শেখ আহমেদ কাট্টি (Sheikh Ahmad Kutty) এর কাছে মসজিদে শিশু নিয়ে প্রবেশ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, নবিজি বলেছেন, যখন কেউ মসজিদে নামাজ পড়বেন এবং কোরআন পড়বেন, তখন তাকে বিরক্ত করা উচিত নয়। নবিজি এটাও বলেছেন, মসজিদে শিশুদের প্রবেশে কেউ বাধা দিতেও পারবেন না। বরং আমরা তাদের মসজিদে আসার ব্যাপারে উৎসাহিত করব। তবে বাবা মায়ের দায়িত্ব শিশুকে শান্ত রাখা।
নামাজে শিশুরা কোথায় দাঁড়াবে, এ প্রসঙ্গেও বিভিন্ন গ্রন্থে ও লেখায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, শিশু যদি একজন হয়, তাহলে তাকে বড়দের কাতারেই একসঙ্গে দাঁড় করাবে। এতে বড়দের নামাজের কোনো অসুবিধা হবে না। যেমনটা দাঁড় করিয়েছিলেন ৪ বছরের কন্যা শিশুটির বাবা।
আর শিশু একাধিক হলে, প্রাপ্তবয়স্কদের পেছনে আলাদা কাতারে দাঁড় করানো সুন্নত। তবে হারিয়ে যাওয়া বা দুষ্টুমি করার আশঙ্কা থাকলে, বড়দের কাতারেও দাঁড় করানো যাবে। (আলবাহরুর রায়েক: ১/৬১৮, আদ্দুররুল মুখতার: ১/৫৭১)। অনেকের ধারণা শিশুদের বড়দের কাতারের মধ্যে দাঁড় করালে পেছনের মুসল্লিদের নামাজ হয় না বা নামাজ ত্রুটিযুক্ত হয়। আসলে ব্যাপারটি তা নয়।
মক্কা, মদিনায় যারা হজ ও ওমরা করতে গেছেন, তারা দেখেছেন পবিত্র কাবা ঘরে বাবা মায়েরা তাদের শিশু সন্তানসহ তওয়াফ করছেন, নামাজ পড়ছেন, মসজিদ প্রাঙ্গণে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন, এমনকি হালকা খাওয়া-দাওয়াও করছেন। সেখানে নামাজ পড়ার সময় দেখা যায় শিশুরা দৌড়াদৌড়ি করছে, খেলাধুলা করছে। কেউ কিছু বলছে না।
আল্লাহর গৃহে ও নবিজির রওজায় যদি নারী-পুরুষ এবং ছেলে ও মেয়েশিশুর সমান অধিকার থাকে তাহলে, আমাদের মসজিদে নয় কেন? ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উচিত দেশ-বিদেশের আধুনিক ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ইসলামি পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানানো এবং কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া, যেন তারা ধর্ম নিয়ে আমাদের অজ্ঞতার আঁধার থেকে রক্ষা করতে পারেন।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments