নওগাঁয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক অভিযোগের নেপথ্যে দুর্নীতি: তদন্ত প্রতিবেদন

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তোলা সাম্প্রদায়িক বিতর্কের পেছনে ছিল স্কুল কর্তৃপক্ষের একটি অংশের দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা।
Naogaon MAP_DS
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তোলা সাম্প্রদায়িক বিতর্কের পেছনে ছিল স্কুল কর্তৃপক্ষের একটি অংশের দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা।

স্কুলের পোশাক না পরে আসায় শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের ঘটনার বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের তদন্তের পর এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

মহাদেবপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মিজানুর রহমান সোমবার রাতে দ্য ডেইলি স্টারকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, ওই বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের  অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক আমোদিনী পালকে 'পরিকল্পিতভাবে' বিতর্কিত করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটি এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সোমবার রাতে উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে গঠন করা ৩ সদস্যের তদন্ত দল ইউএনওর কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।

ইউএনও মো. মিজানুর রহমান রাত ৯টায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার স্বার্থে তদন্ত রিপোর্টটি এখনই সম্পুর্ন প্রকাশ করা যাচ্ছে না।'

তবে তিনি প্রতিবেদন থেকে কিছু তথ্য উল্লেখ করেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বুধবার বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমোদিনী পাল স্কুলের নির্ধারিত পোশাক না পরে আসার কারণে বেশ কয়েকজন ছাত্রীকে শাসন করছিলেন, হিজাব পরে আসার জন্য নয়।  

শাসন করার সময় আমোদিনীর সঙ্গে আরেকজন মুসলিম শিক্ষক বদিউল আলম ছিলেন।

যে সব ছাত্র-ছাত্রীদের শাসন করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে হিন্দু শিক্ষার্থী ছিল বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে কারণেই হোক, ছাত্র-ছাত্রীদের মারধর করা অন্যায়।

ছাত্র-ছাত্রীদের মারধর করায় আমোদিনী পাল ও বদিউল আলমের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।

রোববার বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী ডেইলি স্টারকে স্কুল কর্তৃপক্ষের অনিয়মের তথ্য দিয়েছিলেন।

মুঠোফোনে আলাপকালে তারা জানান, সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পালের কাছে বিদ্যালয়ের বিদায়ী প্রধান শিক্ষক যেন দায়িত্ব হস্তান্তর করতে না পারেন, এ জন্য তাকে 'পরিকল্পিতভাবে' বিতর্কিত করা হয়েছে।

তারা জানান, আমোদিনীকে কোনোভাবে সাময়িক বরখাস্ত করে দুর্নীতিবাজরা তাদের পছন্দের কোনো শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে চেয়েছিল।

তারা বলেন, 'বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সভাপতি নির্বাচন করার ক্ষেত্রেও স্থানীয় সংসদ সদস্যের সুপারিশও অমান্য করেছে দুর্নীতিবাজরা।'

নতুন কমিটির কয়েকজন নেতা 'মিথ্যা ও বানোয়াট কেলেঙ্কারি' ছড়াতে সহায়তা করেছেন বলে উল্লেখ করেন তারা।

তাদের এসব বক্তব্যের সঙ্গে গ্রামবাসীদের কয়েকজনও একমত পোষণ করেছেন।

যোগাযোগ করা হলে নওগাঁ-৩ আসনের সংসদ সদস্য মো. সলিম উদ্দিন তরফদার ডেইলি স্টারকে বলেন, তিনি জানতে পেরেছেন যে স্কুলের একাংশ সাধারণ একটা ঘটনাকে ধর্মীয় রঙ দেওয়ার চেষ্টা করছে।

'আমি আমার সুপারিশ করার আগে সব মহলের সঙ্গে কথা বলেছি,' তিনি বলেন।

তার অনুমোদন কেন উপেক্ষা করা হলো, সেটিও তদন্ত করা উচিত বলে উল্লেখ করেন সংসদ সদস্য।

গত বুধবার স্কুলের সমাবেশ চলাকালে  ছাত্র-ছাত্রীদের মারধরের ঘটনার পর সে রাতে শামীম আহমেদ জয় নামে একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেন। পোস্টে হিজাব পরার জন্য ছাত্রীদের মারধরের জন্য আমোদিনী পালকে দায়ী করা হয়।

পোস্টটি তিনি সে রাতে মুছে দিলেও, পরে তা ভাইরাল হয়ে যায়।

বৃহস্পতিবার, শতাধিক গ্রামবাসী স্কুল অবরোধ করে, আসবাবপত্র ভাঙচুর করে এবং আমোদিনীর অপসারণের দাবি করে।

পুলিশ সেদিন পরিস্থিতি সামাল দেয় এবং স্কুলের প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ আমোদিনী পলের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেন।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাহাদাত হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রধান শিক্ষক ২০১২ সালে অফিসে যোগদানের পর থেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছাত্রদের বিভিন্ন ফি, উপবৃত্তি তহবিলের ব্যাঙ্কের মুনাফা এবং নিয়োগ নিয়ে লেনদেন করেন।'

সম্প্রতি প্রধান শিক্ষক ও আগের পরিচালনা কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে ৩ শিক্ষক নিয়োগে ৩৫ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়।

বিষয়টি নিয়ে গত মাস পর্যন্ত ৩টি গ্রাম্য সালিশ হয় এবং এ বিষয়ে ওই দুজনকে দায়ী করা হয়।

সালিশে শাস্তি হিসেবে তাদের দুজনকে বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য ৫ লাখ টাকা দিতে বলা হয়।

কমিটির সভাপতি তার অংশের জরিমানা পরিশোধ করলেও, প্রধান শিক্ষক এখনো পরিশোধ করেননি।

তিরস্কার করা ছাত্রীদের মধ্যে একদলের দাবি, তারা হিজাব পরায় মারধরের শিকার হয়েছে। 

অন্য দলের দাবি, স্কুলের পোশাক না পরার জন্য ওই ঘটনা ঘটেছে।

শিক্ষক আমোদিনী পাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্কুলে হিজাব পরা নতুন কিছু নয়। আমি এর জন্য কাউকে বকাঝকা করিনি, সেদিনও নয়।'

তবে প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, 'তার (আমোদিনী) কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।'

'আমার কাছে আর্থিক বিষয়ের সব হিসাব আছে এবং কোনও দুর্নীতি হয়নি,' বলেন তিনি।

গ্রাম্য সালিশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'গ্রামের লোকজন জোর করে আমার কাছে টাকা দাবি করেছে। জীবন বাঁচাতে টাকা দিয়েছি।'

তার দাবি, ৫ লাখ নয়, সালিশে তাদের ৯ লাখ টাকা দিতে বলা হয়েছিল।

Comments

The Daily Star  | English
PM Sheikh Hasina

Govt to seek extradition of Hasina

Prosecutors of the International Crimes Tribunal have already been appointed and the authorities have made other visible progress for the trial of the ones accused of crimes against humanity during the July students protest

49m ago