কটেজকোর: ইউটোপিয়ান ভাবনা নাকি শুধুই ফ্যাশন ট্রেন্ড
নতুন প্রজন্মের প্রতি অনেকেরই অভিযোগ, তাদের দৃষ্টি সারাক্ষণ স্ক্রিনে আটকে থাকে। প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের সদা বসবাস নিয়েও অনেকের অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু এই নতুন প্রজন্মই বিগত ৫ বছর ধরে প্রকৃতির কাছাকাছি, বিলাস বিবর্জিত 'কটেজকোর' নামের এক ধারণার, এক আন্দোলনে যে শামিল হয়েছে তা অনেকের অলক্ষ্যে রয়ে গেছে।
কটেজকোর শব্দের উৎপত্তি এবং সূচনাপর্ব
২০১৭ সালে কটেজকোর ধারণাটি ব্যাপকভাবে সামনে আসে। সে বছর টাম্বলার এবং ইনস্টাগ্রামে শুরু হলেও পরবর্তীতে টিকটকে কটেজকোরের বিপুল প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
কটেজকোর শব্দের অংশ 'কটেজ' কুঁড়েঘর অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং কোর অংশটি নেওয়া হয়েছে আশির দশকের হার্ডকোর পাংক মিউজিক থেকে।
কটেজকোর ধারণার স্বরূপ ও অভিযোগ
ইন্টারনেটকেন্দ্রিক এবং মূলত ভিজ্যুয়ালনির্ভর এই ধারণাতে আদতে ধরা পড়ে এক ধরনের নির্ঝঞ্ঝাট, শান্ত ও নাভিশ্বাস-না-ওঠানো গ্রামীণ জীবন-যাপনের আকাঙক্ষার প্রকাশ। যা অনেকাংশে জাপানিজ বনবাসের ধারণা 'মোরি কেই'-এর দ্বারা প্রভাবিত।
কটেজকোর যে জীবনের কথা বলে, সেখানে গ্রামীণ ঘরোয়া দিন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজের অধিক আর কোনো বাড়তি শ্রমের দরকার পড়ে না। দরকার পড়ে শুধু প্রাত্যহিক সহজ কাজ শেষ করার তাগিদ এবং আনন্দের ছোঁয়া মিশে থাকে সেই তাগিদে। এই জীবনে তাড়া নেই, নেই কোনো গতির চাপ।
স্বনির্ভরশীলতা এবং স্বার্থপরতা বর্জন করে অন্যের জন্য কাজ করার ইচ্ছা কটেজকোর-এর অন্যতম একটি মূল ভিত্তি।
কটেজকোর-এর ধারণায় মিশে আছে শিকড়ে ফিরে আধুনিক জীবনের অস্তিত্বের যাতনা থেকে মুক্তির ইচ্ছা।
জনপ্রিয়তা এবং প্রশংসা সত্ত্বেও কটেজকোর বিরুদ্ধে আছে ইউরোপকেন্দ্রিকতার অভিযোগ। অর্থাৎ গ্রামীণ সমাজের ভাবনায় ইউরোপের গ্রামকেই বেছে নেওয়ার বিষয়টি। কিংবা আছে কৃষি কাজকে অত্যন্ত সহজ শ্রমের কাজ ভাবার চিন্তাগত সীমাবদ্ধতার প্রশ্ন।
প্রযুক্তি থেকে মুক্তির বাসনা
কটেজকোর বা কুঁড়েঘরে জীবনযাপন বিশ্বে স্মার্টফোন ক্রমাগত মেসেজ আর বিভিন্ন আপডেটের আওয়াজ দেয় না। কল্পনার এই বিশ্বে নাই কোনো ই-মেইলের উত্তর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা। কিংবা হুকুম প্রদানকারী বসের উপস্থিতি।
প্রযুক্তি, স্মার্টফোন, বড় শহর এবং আধুনিক নাগরিক জীবনের ক্লান্তি থেকে মুক্ত এক জীবনের স্বপ্ন দেখায় কটেজকোর।
কটেজকোরের উপাদান ও কার্যক্রম
আবেগীয় গ্রামীণ এবং কৃষিভিত্তিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের উপস্থিতি দেখা যায় কটেজকোর-এর নান্দনিকতায়।
রূপকথার ডাইনি, পরীসহ ধীর চালে চলা কাঠবিড়ালি, মুরগি, হাঁস, খরগোশ, হরিণ ও ভেড়াসহ বিভিন্ন উপাদনকে কটেজকোর গ্রহণ করেছে।
বাগান করা, রান্না করা, রুটি বানানো, জামা সেলাই, বুনন ইত্যাদিকে কটেজকোর কার্যক্রম হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। বিগত সময়ে নতুন প্রজন্মকে দেখা গেছে এসব কার্যক্রমগুলোতে নিজেদের ব্যাপকভাবে নিযুক্ত করতে।
কতটা বাস্তবিক আর কতটা ভার্চুয়াল
নতুন প্রজন্ম সামগ্রিকভাবে এবং বাস্তবেই কটেজকোর-এর বিশ্বে বসবাস করছে তা বলা যাবে না। কটেজকোর বা এর আরেক নাম ফার্মকোর ধারণার পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ ঘটেছে মূলত সামাজিক মাধ্যমে ফ্যাশন ও নান্দনিকতার প্রকাশে। যেই প্রকাশে বাস্তবতার তুলনায় গ্রামীণ ও কৃষিভিত্তিক সমাজকেন্দ্রিক কল্পনার প্রাধান্যই বেশি এবং সেই কল্পনার রঙে আঁকা কটেজকোর-এর প্রকাশ ঘটছে নতুন প্রজন্মের সামাজিক মাধ্যমে ছবি ও এই সংশ্লিষ্ট উপাদান উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ের কটেজকোর-এর ধারণা কতটা কেবল ভাবনায় সীমাবদ্ধ অর্থাৎ নগরায়নের সুবিধাহীন গ্রামীণ জীবনে বসবাস করতে গিয়ে নতুন প্রজন্মের কল্পনার ধারণা কতটুকু অক্ষুণ্ণ থাকে সেই বিষয়ে অনেকের সন্দেহ আছে।
কটেজকোর-এর নান্দনিকতা
টেকসই এবং প্রকৃতির সঙ্গে ঐকতানে থেকে জীবন যাপনের আকাঙক্ষা কটেজকোর-এর মূল বিষয়। যা তরুণ প্রজন্মের কাছে বাস্তবতায় ধরা না পড়লেও, ধরা পড়ছে তাদের নান্দনিকতার প্রকাশে।
কটেজকোর রঙে দেখা যায় প্রাকৃতিক রঙের আধিক্য যেমন, হালকা সবুজ, প্রাকৃতিক পাথরের বাদামি ও ফুলের রঙ। আলোর উৎস সব সময়ই প্রাকৃতিক।
বিস্তীর্ণ মাঠ, শস্যক্ষেতও বারবার দেখা যায় কটেজকোর-এর নান্দনিকতার প্রকাশে।
কটেজকোর ফ্যাশন
সবচেয়ে বেশি কটেজকোর-এর প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে পোশাক-পরিচ্ছেদ এবং ফ্যাশনে। সেই ফ্যাশনে ফুলের নকশার আধিক্য দেখা যায়।
কটেজকোর প্রভাবিত পোশাক হিসেবে দেখা যায় লম্বা, ঢিলাঢালা পোশাক। বড় পকেট, ফুলে থাকা হাতা, গাছ-পালা, পশু পাখি, ফুলের প্রিন্টস। হাতে বোনা মোজা ও হ্যাট।
বিগত বছরগুলোতে নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিভিন্ন পত্রিকা ও ফ্যাশন ম্যাগাজিনে কোটেজকোর-এর ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।
ফ্যাশনে কটেজকোর-এর উপাদানের উপস্থিতি এবং এর তুমুল জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায় করোনাকালীন গৃহবন্দী সময়ে লিরিকা মাতোশির স্ট্রবেরি পোশাকের প্রচুর বিক্রির ঘটনা থেকে। ফ্যাশন ম্যাগাজিন ভোগের ভাষ্যমতে, ওই পোশাক ব্যাপক আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে, কারণ এই পোশাকে থাকা মিষ্টি স্ট্রবেরির নকশার এক ধরনের কোভিড পূর্ববর্তী ভীতিহীন নস্টালজিয়া কিংবা কোনো এক প্রাচীন গ্রামীণ সমাজের সুখময় জীবনের অনুভূতি জাগিয়ে তোলার সক্ষমতা আছে বলে।
ইউটোপিয়ান ভাবনা নাকি শুধুই ফ্যাশন ট্রেন্ড?
অনেকের মতে কটেজকোরের প্রতি নতুন প্রজন্মের টান মূলত তাদের জীবনের ক্রমবর্ধমান হতাশা, ক্লান্তি, চাপ থেকে খানিক সময়ের মুক্তির আশা। যেখানে কটেজকোর বিশ্বের স্বপ্ন ইউটোপিয়ান ভাবনা হিসেবে কাজ করে।
প্রশ্ন আসে নগর জীবনের সীমাহীন চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কি নতুন প্রজন্মের কটেজকোর নামের এক ইউটোপিয়ান ভাবনার আশ্রয় নেওয়া? নাকি সময়ে সময়ে যে নানারূপের ফ্যাশনকে বিস্তার নিতে দেখা যায় কটেজকোর সেরকম শক্তিশালীভাবে বিস্তার নেওয়া নতুন আরেকটি ফ্যাশন ট্রেন্ডই কেবল?
Comments