ব্যক্তিত্ব গঠনে নাম কি কোনো প্রভাব ফেলে?
কখনো কি ভেবেছেন, আপনার নাম আপনার ব্যক্তিত্বের ওপর কোনো প্রভাব ফেলছে কি না? বিভিন্ন গবেষণা থেকে পাওয়া ফলাফল বলছে, অবশ্যই প্রভাব ফেলতে পারে। অথচ নামটি নির্বাচনে আপনার নিজের কোনো হাতই ছিল না।
অসংখ্য বিষয় আমাদের ব্যক্তিত্ব গঠণে ভূমিকা রাখে। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে নামের বিষয়টিকে আমরা বরাবরই উপেক্ষা করে আসছি। যা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে থেকে যায়, যদি না আমরা সেটা পরিবর্তন করি।
একজন মানুষের জীবনে আলাদাভাবে সবচেয়ে বেশি যে শব্দগুলো শুনে থাকে তার মধ্যে নিজের নাম অন্যতম। অন্যরা আমাদের কীভাবে উপলব্ধি করে সেটার ওপর আশ্চর্যজনক প্রভাব ফেলতে পারে এই নাম।
অপরিচিত ব্যক্তিরা বেশিরভাগ মানুষের সম্পর্কে প্রথম যে তথ্যটি প্রথমে জানে তা হলো, তাদের জন্য অভিভাবকদের বাছাই করে দেওয়া নাম।
ফার্স্ট ইম্প্রেশন তৈরিতে বিভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্য, চেহারা, পোশাক-পরিচ্ছদ, কথার ধরন, আচার-আচরণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তেমনি একটি সুন্দর নাম মুহূর্তের মধ্যেই সবার মাঝে আপনাকে করে তুলতে পারে অনন্য, সবার থেকে আলাদা। যা আপনার ব্যক্তিত্বকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে পারে।
আমরা আমাদের নাম পছন্দ করি বা না করি, এই আরোপিত উপহার আমাদের শরীরের যেকোনো অঙ্গের মতোই সারাজীবন বহন করতে হয়। এমনকি মৃত্যুর পরও। দৈনন্দিন জীবনে এই সূক্ষ্ম অথচ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি অনেকে সেভাবে ভাবেন না।
সামাজিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এটি মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। একজন মানুষের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করা হয়, তার ওপর ভিত্তি করে আচরণগত দিকগুলো মোটামুটি গঠিত হয়।
এ ক্ষেত্রে 'দ্য লুকিং গ্লাস সেলফ' নামে একটি কৌতূহলোদ্দীপক তত্ত্ব রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী চার্লস হর্টন কুলি এ সম্পর্কে বলেছেন, কাউকে অন্যরা কীভাবে উপলব্ধি করছে তা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সেই ব্যক্তির নিজেদের সম্পর্কে ধারণা বিকশিত হয়। কীভাবে অন্যরা তাদের সঙ্গে আচরণ করে তার ওপর ভিত্তি করে নিজে সে ধরনের ব্যক্তি হয়ে উঠতে থাকে। আমাদের নামের ক্ষেত্রে অন্যদের উপলব্ধি ও সে ধরনের আচরণও আমাদের সার্বিক পরিণতি নির্ধারণ করে দিতে পারে। কারণ নামের কারণে অন্যরা আমাদের সম্পর্কে কেমন অনুভব করে এবং অন্যরা আমাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে তা দিনশেষে তাদের ধারণাকেই আমাদের মধ্যে প্রভাবিত করতে পারে।
ডেভিড ঝু, ম্যানেজমেন্ট এবং এন্টারপ্রেনারশিপের একজন অধ্যাপক, যিনি অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মানুষের নামের মনোবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বলেন, 'যেহেতু একটি নাম একজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে এবং প্রতিদিনের ভিত্তিতে ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হয়, তাই এটি একজনের আত্ম-ধারণার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।'
একেবারে প্রাথমিক স্তরে যদি চিন্তা করি, আমাদের নামগুলো জাতিগত বা সাংস্কৃতিক দিকগুলো সম্পর্কে অন্যের কাছে একটি ধারণা প্রকাশ করতে পারে। বিশেষ করে বিদেশি বা বহিরাগত কারও কাছে। যা সামাজিক পক্ষপাতের বিভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামিক নামের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে সম্পর্কিত একটি শব্দ বেশ প্রচলিত, তা হচ্ছে, ইসলামোফবিয়া। ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালিত আমেরিকান গবেষণায় দেখা গেছে, হুবহু একই জীবনবৃত্তান্ত বিশিষ্ট ইন্টারভিউতে সাধারণত পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গ নামের তুলনায় আরবি-শব্দযুক্ত নামের ব্যক্তিদের চাকরির জন্য আকৃষ্ট করার সম্ভাবনা কম ছিল। যেটি খুবই অন্যায্য, কারণ নামগুলো আমাদের স্বভাব, চরিত্র ও পটভূমির একটি অবিশ্বস্ত সূচক হতে পারে।
মার্কিন মনোবিজ্ঞানী জিন টোয়েঞ্জের নেতৃত্বে ২০০০ সালের দিকে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনের সাধারণ অসন্তুষ্টিগুলো নিয়ন্ত্রণ করার পরও যারা নিজেদের নাম পছন্দ করেন না, তাদের মানসিক সামঞ্জস্য অত্যন্ত নগণ্য ছিল। হয়তো তাদের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মমর্যাদার অভাব নিজেদের নাম অপছন্দ করায় প্রভাব ফেলে অথবা তাদের নিজেদের নাম অপছন্দ করার কারণে তাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব সৃষ্টি হয়েছে।
এমনকি একটি একক সংস্কৃতি বা দেশের মধ্যেও, নামগুলো সাধারণ বা বিরল হতে পারে। নামগুলোর অর্থের পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট ইতিবাচক বা নেতিবাচক অর্থ থাকতে পারে। যা সেগুলোকে আরও আকর্ষণীয় ও ফ্যাশনেবল বা অপছন্দের ও সেকেলে হিসেবেও উপস্থাপন করতে পারে।
অন্যদিকে এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলো আবার সময়ের সঙ্গে, ফ্যাশনের সঙ্গেও পরিবর্তিত হতে পারে। যার ফলে, আমাদের নামের এই বৈশিষ্ট্যগুলোর অর্থাৎ এটি কি ফ্যাশনেবল নাকি সেকেলে তার প্রেক্ষিতে অন্যরা আমাদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করে তা আমাদের ওপর বেশ প্রভাব ফেলে। আমরা অন্যদের আচরণে নিজেদের সম্পর্কে কেমন অনুভব করি বা ভাবি তা আমাদের ব্যক্তিত্বের ওপর দাগ কাটতে পারে।
নামের কারণে অনেকে সময় যেমন প্রশংসা পাওয়া যায় আবার অনেকক্ষেত্রে বুলিংয়েরও শিকার হতে পারেন অনেকে।
তাই শিশুর নামকরণের ক্ষেত্রে এই সূক্ষ বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। কেন না, সাধারণত কেউই তার জীবনে অভিভাবকের দেওয়া নাম পরিবর্তনের বিষয়টি আর মাথায় আনে না। ছোটবেলা দেওয়া নামটি সারা জীবনের পরিচয় হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র:
বিবিসি, এনসাইক্লোপিডিয়া.কম
Comments