২৪ অক্টোবর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধে ৩ রমজান 

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

(পবিত্র কোরআনে রমজানকে রহমতের মাস বলা হলেও, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা এই মাসে বর্বরোচিত গণহত্যা, নৃশংস নির্যাতন-নিপীড়ন, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ চালায়। অন্যদিকে, প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য এ মাসে রণাঙ্গনে প্রাণপণে লড়াই করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। রোজা পালনরত অবস্থাতেই স্বদেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা।  মুক্তিযুদ্ধের রমজান মাস কেমন ছিল, তা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজনের তৃতীয় পর্বে আজ রইল ৩ রমজানের ঘটনাপ্রবাহ।)

মুক্তিযুদ্ধের ৩ রমজান পালিত হয়েছিল ২৪ অক্টোবর। দিনটি ছিল রোববার। অন্যান্য দিনের মতো পবিত্র রমজান মাসের তৃতীয় দিনেও গণহত্যা, নির্যাতন ও নৃশংসতা অব্যাহত রেখেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধের ৩ রমজান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হল ঘেরাও করে রসায়ন বিভাগের ছাত্র ও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদসহ বিভাগের দুজন ছাত্র, ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক গিয়াসউদ্দিন এবং হলের নিরাপত্তাপ্রহরীকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাদেরকে রড দিয়ে পিটিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হোসেন। যদিও পরবর্তীতে প্রাণে বেঁচে যান হুমায়ূন আহমেদ।

মুক্তিযুদ্ধের ৩ রমজান রাতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল নৌকায় করে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের একটি দল মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অ্যামবুশ করে। প্রথমে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গেলেও ব্যর্থ হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পিছু হটতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। ক্রলিং করার সময় হানাদার বাহিনীর গুলি এসে লাগে আশুরঞ্জন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধার পায়ে। আহত অবস্থায় তাকে আটক করে নিকটস্থ কালীবাড়িতে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। তার উপর বেশ কয়েকদিন পৈশাচিক নির্যাতন চালায় রাজাকার ও হানাদার বাহিনী। পরবর্তীতে রাজাকারেরা তাকে হত্যা করে।

রণাঙ্গনে ৩ রমজান

মুক্তিযুদ্ধের রমজান মাসের শুরুতে গাইবান্ধার সাঘাটা থানার বোনারপাড়া ইউনিয়ন শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে মুক্তিবাহিনীর একটি দল ত্রিমোহিনী রেলস্টেশনের পাশে কয়েকটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। এদিকে স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে জানায়। ৩ রমজানে সেহরির সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বড় একটি দল স্থানীয় রাজাকার শান্তি কমিটির সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে ত্রিমোহিনী ঘাট এলাকা ঘিরে ফেলে। এ সময় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২১ জন নিহত হন।

মুক্তিযুদ্ধের ৩ রমজানের ভোরে কুমিল্লা দাউদকান্দি সড়কে মাইন পুঁতে রাখে মুক্তিবাহিনীর একটি দল। পরে সকাল ৯টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি সামরিক বহর এই পথ দিয়ে যাওয়ার পথে মাইন বিস্ফোরিত হয়। এ সময় ৬ জন হানাদার মিলিশিয়া নিহত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ৩ রমজানের দিন ময়মনসিংহে মুক্তিবাহিনীর একটি দল সেহরির আগমুহূর্তে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কমলপুর বিওপির উপর অতর্কিত হামলা চালায়। হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এ সময় মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকজন আহত হন। পরে মুক্তিযোদ্ধা দলটি ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে ত্রিমুখী আক্রমণ গড়ে তুললে হানাদার বাহিনী বিওপি ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণে ৩ জন হানাদার সেনা নিহত হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের ৩ রমজানের দিন দুপুরে রাজাকারদের একটি দল ময়মনসিংহের ভালুকার বিরুলিয়া গ্রামে বেশ কয়েকটি বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। মুক্তিবাহিনীর একটি দল এই খবর পাওয়া মাত্র বিরুলিয়া গ্রামে এসে রাজাকারদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় ৫ রাজাকার নিহত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ৩ রমজানের দিন সন্ধ্যায় ৮ নম্বর সেক্টরের সাদীপুরে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর অতর্কিত হামলা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল। হামলার সময় ইফতার করছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত হামলায় একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। পরে ক্যাম্পে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা সেই মুহূর্তে খাওয়া ছেড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। একপর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৫ সেনা নিহত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর ২ পাকিস্তানি সেনাকে জীবিত অবস্থায় ধরতে সমর্থ হয়। বাকি পাকিস্তানি সেনারা এ সময় পালিয়ে যায়।

ঝিনাইদহের মধুহাটী ইউনিয়নের বেড়াশুলা গ্রামে ছিল রাজাকারদের একটি বড় ক্যাম্প। এই ক্যাম্প থেকে রাজাকারেরা বিভিন্ন দলের বিভক্ত হয়ে নিয়মিতই আশেপাশের ২০টি গ্রামে লুটপাট, ধর্ষণ, হত্যা ও লুণ্ঠন চালিয়ে যাচ্ছিল। গ্রামবাসীরা রাজাকারদের কথা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে খুলে বলে। এরপর মুক্তিবাহিনীর একটি বড় দল ৩ রমজানের দিন সন্ধ্যায় রাজাকারদের ক্যাম্পের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালালে রাজাকারেরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। এ সময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় ১১ রাজাকার নিহত হয় এবং জীবিত অবস্থায় ৯ রাজাকার ধরা পড়ে। অন্যদিকে বেশ কয়েকজন রাজাকার ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

চুয়াডাঙ্গার তীতুদহ গ্রামে একটি গোপন ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। এদিকে স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে গোয়েন্দা মারফতে খবর পেয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল সঙ্ঘবদ্ধ রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে ৩ রমজানের দিন ভোরে মুক্তিবাহিনীর এই গোপন ঘাঁটিতে অতর্কিত হামলা চালায়। অতর্কিত হামলায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে হতচকচিত হয়ে গেলেও প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এ সময় প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর হানাদার ও রাজাকারেরা পিছু হটে। এই সংঘর্ষে ১ হানাদার সেনা ও বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত হয় অন্যদিকে দুজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। 

সূত্র- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র অষ্টম এবং দশম খণ্ড। 

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

How a 'Dervish Baba' conjured crores from a retired nurse

Want to earn easy money? Just find someone who thinks their partner is cheating on them, then claim to be a “Genie King” or “Dervish Baba,” and offer solutions to “relationship problems” for a fee

3h ago