‘ঢাকা থেকে পালানো মানুষ ও আমরা জিঞ্জিরা গণহত্যার লক্ষ্য ছিলাম’
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জিঞ্জিরা গণহত্যা এক ভয়াবহ অধ্যায়। ২৫ মার্চ কালরাতে ভয়াল গণহত্যার ঠিক এক সপ্তাহ পর ২ এপ্রিল ভোর থেকে সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা, কালিন্দী ও শুভাঢ্যা ইউনিয়নে নৃশংস গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষ এই গণহত্যায় শহীদ হন।
জিঞ্জিরা গণহত্যার সময় কেরানীগঞ্জের একটি গ্রামে ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা ও কেরানীগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা মোহসীন মন্টু। ২৫ মার্চের গণহত্যার পর ঢাকা ছেড়ে কেরানীগঞ্জে এসে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন তিনি।
দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মোস্তফা মোহসীন মন্টু বলেছেন জিঞ্জিরা গণহত্যা নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আহমাদ ইশতিয়াক।
মুক্তিযুদ্ধে বড় গণহত্যার কথা বললে প্রথমেই জিঞ্জিরা গণহত্যার নাম আসবে। জিঞ্জিরা গণহত্যার প্রেক্ষাপট আসলে কী? কেন পাকিস্তানি বাহিনী সেদিন কেরানীগঞ্জকেই বেছে নিয়েছিল?
২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যার পর প্রায় দেড় থেকে ২ লাখ লোক বুড়িগঙ্গা পার হয়ে কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এর মধ্যে জিঞ্জিরা, কালিন্দী শুভাঢ্যা ইউনিয়নে ছিলেন সবচেয়ে বেশি মানুষ। কেউ পরিবার নিয়ে, কেউ বিচ্ছিন্নভাবে ছিলেন। বেশিরভাগই সেখানে আশ্রয় নেওয়ার ২-১ দিনের মধ্যেই বিভিন্ন গন্তব্যে চলে যাচ্ছিলেন।
আমরা নেতাকর্মীরা যারা জিঞ্জিরায় নতুন করে মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করছি, তারা জিঞ্জিরা গণহত্যার অন্যতম লক্ষ্য ছিলাম। আবার ঢাকা ছেড়ে কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নেওয়া মানুষও তাদের লক্ষ্য ছিলেন।
আমরা ২৫ মার্চ রাতেই ঢাকা থেকে পালিয়ে কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নিয়েছিলাম। যত দ্রুত সম্ভব কেরানীগঞ্জ গিয়ে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমাকে। আমার বাড়ি ছিল নেকরোজবাগে। ওটা আমার নানার বাড়ি হলেও আমার যাতায়াত বেশি ছিল ওই বাড়িতে। নেকরোজবাগ গ্রামে এসেই আমি একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুলি।
এরপর জাতীয় নেতারা আসতে শুরু করলেন। শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রবসহ প্রভাবশালী ছাত্র নেতারা এলেন। কেবল আবদুল কুদ্দুস মাখন ছিলেন না। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে গিয়েছিলেন। আমাদের বাড়ির পাশে আমবাগান ছিল। ওই আমবাগানেই কে কোন দিক দিয়ে যাবেন, তা নিয়ে আলোচনা হলো। আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী রয়ে গেলেন। বিভিন্ন বাড়িতে তাদের রাখা হলো। বাকিরা চলে গেলেন।
ঢাকা থেকে যেসব মানুষ এদিক দিয়ে যাবেন, তাদের খাবার, থাকার বন্দোবস্ত করা আমাদের দায়িত্ব ছিল। এরইমধ্যে তাজউদ্দীন সাহেব, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম সাহেব এলেন। তাদেরকেও আমরা নিরাপদেই পার করলাম। তখনই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। বাঙালি গোয়েন্দারা আমাদের বলেছিলেন, 'সাবধানে থাকবেন। ওরা কিন্তু আমাদের কাছ থেকে আপনাদের প্রচুর খবর নিচ্ছে। আমরা মিথ্যা কথাই বলছি, উল্টাপাল্টা খবর দিচ্ছি। কিন্তু তারা আরও বেশ কয়েকজন লোক লাগিয়ে রেখেছে। ওদের লোকজন কিন্তু ভীষণ সক্রিয়।'
হামলা যে আসন্ন, তার আভাস কীভাবে পেলেন?
১ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে আমরা খবর পেলাম, উচ্চপদস্থ কয়েকজন পাকিস্তানি অফিসার মিটফোর্ড হাসপাতালে রেকি করে গেছে। আর্মি অফিসাররা কেন এল, আমরা বুঝলাম না। ওরা কি হাসপাতাল দখলে নিতে চায়? নাকি অন্য কিছু? তবে আমরা আমাদের বিভিন্ন পয়েন্টে খবর দিলাম।
হামলার আশঙ্কায় আমরা আগেই প্রতিটি গ্রামে ও ঘাটে পাহারা বসিয়েছিলাম। আমাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য সাইকেল ছিল। স্থানীয় ছেলেরা সাইকেল নিয়ে এক পয়েন্ট থেকে আরেক পয়েন্টে খবর পৌঁছে দিত।
আক্রমণ কীভাবে শুরু হলো?
রাত সাড়ে ৩টার দিকে আমরা খবর পেলাম, পাকিস্তান আর্মি গানবোট থেকে জিঞ্জিরার দিকে নামছে। সাইকেলের মাধ্যমে আমরা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করতাম। সেভাবেই খবর পেলাম একপাশ থেকে। এর আগে নদীর ওপারে বিভিন্ন জায়গায় পয়েন্টে পয়েন্টে ওরা লঞ্চ রেখেছিল। ওই লঞ্চ থেকে নেমে খুব গোপনে খাল ও নদী দিয়ে ঢুকছিল তারা।
রাত ২টা-৩টার দিকে খুবই নীরবে তারা আসে। তাদের পজিশন যখন ঠিক হয়ে যায়, তখন রাত সাড়ে ৩টা বা ৪টা হবে। তখন ট্রেসার লাইটের মতো কিছু একটার আলোয় পুরো আকাশ আলোকিত হয়ে গেল। এরপর ওরা মর্টার শেল ছুড়তে শুরু করল।
পাকিস্তানি সেনারা এরপর পেছন দিকে কাঁটাতারের দিয়ে বেড়া দিতে শুরু করল। যেখানেই ফাঁকা পাচ্ছে, সেখানেই বাঁশের খুঁটির সঙ্গে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরাও করে ফেলছে। বাঁশঝাড়, বাড়ির পাশে বা বিলের দিকে যেখানে একটু ফাঁকা আছে, সেখানেই। যেন কেউ পালাতে না পারে।
ওরা ভেবে রেখেছিল, সামনের দিক থেকে আক্রমণ করলে মানুষ পেছনের দিক দিয়ে পালাতে যাবে। সেটা যেন তারা করতে না পারে, সেজন্যই কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হচ্ছিল।
এরপর পাকিস্তানি আর্মি বসতির দিকে আসতে শুরু করল। কিছু কিছু আর্মি সামনের দিক থেকে একটানা গুলিবর্ষণ শুরু করল। লোকজন ছোটাছুটি করে পেছনের দিকে গিয়ে পেল কাঁটাতারের বেড়া। ওরা আর পালাতে পারল না। সবাইকেই ব্রাশফায়ারে হত্যা করল পাকিস্তানি বাহিনী। এভাবে সকাল পর্যন্ত একটানা গুলি চালাল তারা।
আপনারা ছাত্রনেতারা তো লক্ষ্য ছিলেন। আপনাকেও খুঁজছিল তারা। কিন্তু চিহ্নিত করতে পারল না। এটি কীভাবে সম্ভব হলো?
আমরা ছাত্রনেতাদের কয়েকটি গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে রেখেছিলাম। ছাত্রনেতাদের মধ্যে আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী তখন সেখানেই ছিলেন। আমার নিজের অবস্থান ছিল অনেকটা ছোটাছুটির মধ্যে।
আমি বারবার অবস্থান বদল করছিলাম। যেখানেই পাকিস্তানি আর্মির উপস্থিতি দেখা যেত, আমি সতর্ক হয়ে যেতাম। ওই এলাকা তো আমার হাতের তালুর মতোই চেনা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আমাকে বলেছিলেন, ঘাটে ঘাটে তারা জিজ্ঞেস করেছে, নারিকেলবাগ কিধার হ্যায়? মন্টু কোন হ্যায়? কিন্তু তারা বলেননি।
নারিকেলবাগ আসলে নেকরোজবাগ। নেকরোজবাগ উচ্চারণ করতে পারত না বলে ওরা বলতো নারিকেলবাগ। সবচেয়ে সৌভাগ্যের বিষয় হলো, আমার অবস্থান একটা লোকও চিনিয়ে দেননি। আমার নাম ধরে ধরে ওরা জিজ্ঞেস করেছে প্রতিটা ঘাটে। মানুষ মারা যাচ্ছেন, গুলি খাচ্ছেন। কিন্তু কেউ আমার গ্রাম চিনিয়ে দেননি। আমি তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ। বিপদের মুখেও তারা আমাকে বাঁচিয়েছেন।
জিঞ্জিরা গণহত্যায় ঠিক কতজন শহীদ হয়েছেন, তা আমরা জানতে পারিনি। কেউ বলেন ২ হাজার, কেউ ৩ হাজার, কেউ ৫ হাজার। কেউ তারও বেশি বলেন। শহীদের সংখ্যা কত হতে পারে বলে আপনার ধারণা?
শহীদের সংখ্যা যে কত, তা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। এর প্রধান কারণ, সেখানে শুধু স্থানীয় বাসিন্দারা শহীদ হননি। স্থানীয় শহীদের সংখ্যা বেশি হলে ৩০০-৪০০ হবে। ২৫ মার্চের পর যারা ঢাকা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন এবং সেখানে রয়ে গিয়েছিলেন, তারাই মূলত শহীদ হয়েছিলেন। এই শহীদদের স্বজনরা হয়তো জানেনই না, তাদের স্বজন বা পরিবারের সদস্যরা এখানে শহীদ হয়েছেন।
শহীদের সংখ্যা নিরূপণে কি কখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল? সেল গঠন বা অন্য কোনভাবে? এখনো তো সম্ভব এটি।
না। ওটা হয়নি। হলে ভালো হতো। সেল গঠনের মাধ্যমে করা যেত। বিশেষ করে শেষ ৩ দিন যাদের স্বজনরা এই পথ দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন, তাদের কাছ থেকে তথ্য নেওয়া যেত। আমরা বহুবার চেয়েছিলাম. কিন্তু করা যায়নি। এই যে স্মৃতিসৌধটা আছে বর্তমানে, সেটি বিএনপির আমলে আমানউল্লাহ আমান সাহেব করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, করতে চান। আমরা বললাম, আমাদের সহযোগিতা পাবেন। মানুষ তো সহযোগিতা করতে রাজি। কিন্তু সরকারকে তো এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করি। এটাতেই শেষ। আমরা বহুবার বলেছি, এটিকে অন্তত দিবস হিসেবে পালন করা হোক। জিঞ্জিরা গণহত্যা যে কতটা পৈশাচিক ও নির্মম ছিল, তাহলে তা কিছুটা হলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অনুধাবন করতে পারবে।
Comments