ঔদ্ধত্য ও একটি বিপর্যয়

রাশিয়া নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। নাকি আমাদের বলা উচিত প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ইউক্রেনে আক্রমণ চালাতে হলো, দেশটির জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বাস্তুচ্যুত হলেন, লাখো মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হলেন, রুশ সেনাদের পাশাপাশি অসংখ্য বিদেশি নাগরিক ও একজন বাংলাদেশি নাবিকসহ হাজারো মানুষ প্রাণ হারালেন এবং সব মিলিয়ে একটি দেশকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলতে হলো। সর্বোপরি সারা পৃথিবীকে ঠেলে দেওয়া হলো অশান্তির মুখে।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

রাশিয়া নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। নাকি আমাদের বলা উচিত প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ইউক্রেনে আক্রমণ চালাতে হলো, দেশটির জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বাস্তুচ্যুত হলেন, লাখো মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হলেন, রুশ সেনাদের পাশাপাশি অসংখ্য বিদেশি নাগরিক ও একজন বাংলাদেশি নাবিকসহ হাজারো মানুষ প্রাণ হারালেন এবং সব মিলিয়ে একটি দেশকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলতে হলো। সর্বোপরি সারা পৃথিবীকে ঠেলে দেওয়া হলো অশান্তির মুখে।

আক্ষরিক অর্থেই প্রায় পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন এই আগ্রাসনের নিন্দা জানাচ্ছে, ইউরোপ দৃঢ়ভাবে ইউক্রেনের পক্ষ নিচ্ছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করেই পুতিনের বিরুদ্ধে তাদের স্বভাবগত আগ্রাসী মনোভাবের পেছনে নৈতিকতার নোঙ্গর খুঁজে পাচ্ছে, তখন কীভাবে রাশিয়া আগের তুলনায় বেশি সুরক্ষিত অবস্থায় আছে? পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে অবস্থিত যেকোনো নিরপেক্ষ মানুষের মনকে এই প্রশ্ন সংশয়াচ্ছন্ন করে তুলতে পারে।

রাশিয়ার উদ্বেগের পেছনের অন্তর্নিহিত ও দীর্ঘমেয়াদী কারণ যাই হোক না কেন, খুব সহজ একটি কারণে পৃথিবীর বাকি দেশগুলোর পক্ষে রাশিয়ার এই আগ্রাসন মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সেই কারণটি হলো, নিজেদের অস্তিত্ব সংকটের মতো অত্যন্ত দুর্লভ ও প্রমাণিত পরিস্থিতি ছাড়া কোনো দেশ আরেকটি দেশকে আক্রমণ করতে পারে না।

রাশিয়ার তুলনায় আয়তনসহ প্রায় প্রতিটি মানদণ্ডের বিচারে ছোট প্রতিবেশী দেশটির বিরুদ্ধে এই আগ্রাসনকে তুলনা করা যায় ২ প্রতিবেশীর মধ্যে ঝগড়া মেটানোর জন্য বড় আকারে পেশীশক্তির ব্যবহার ও সহিংসতাকে চূড়ান্ত উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের সঙ্গে। এই আগ্রাসনের মাধ্যমে সব ধরনের আন্তর্জাতিক আইন, প্রচলিত প্রথা, চর্চা ও প্রত্যাশিত আচরণের অবমাননা করা হয়েছে। বড় দেশগুলোর এ ধরনের ব্যবহারের বিরুদ্ধে যদি সোচ্চার হয়ে নিন্দা জানানো না হয়, তাহলে কোনো দেশই আর নিরাপদ বোধ করবে না এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো কিছুই আর নিশ্চিত থাকবে না। ভাবুন, বড় প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে নেওয়া ছোট দেশগুলোর অবস্থা কী হবে?

হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রও ইরাকে আগ্রাসন চালিয়ে একই কাজ করেছিল। কিন্তু একটি অন্যায়ের উদাহরণ দিয়ে আরেকটি অন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের ১ মাস পূর্ণ হয়েছে। ইউক্রেন এমন একটি দেশ, যেটি কোনো দিক থেকেই রাশিয়ার মতো পরাশক্তির সমকক্ষ নয় এবং এই দেশটি কোনোভাবেই তার সুবিশাল প্রতিবেশীর জন্য কোনো ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেনি।

জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুসারে, আগ্রাসনের এই ৩০ দিনে প্রায় ১ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, শরণার্থী হয়েছেন ৩৬ লাখ মানুষ, মোট ৯৭৭ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন, দেড় হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।

ইউনিসেফ জানিয়েছে, দেশটির ৭৫ লাখ শিশুর মধ্যে ৪৩ লাখ এখন আশ্রয়ের খোঁজে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, যাদের মধ্যে ১৮ লাখ শিশু শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে।

রাশিয়ার দেওয়া আনুষ্ঠানিক তথ্য অনুযায়ী, তাদের ১ হাজার ৩৫১ জন সেনা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৩ হাজার ৮২৫ জন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যাচাই করে জানিয়েছে, এ সময়ের মধ্যে ৬৪টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ধ্বংস হয়েছে।

এতসব ঘটনা কীভাবে রাশিয়াকে আরও বেশি সুরক্ষিত করেছে? প্রতিবেশীর ওপর এত বেশি অযৌক্তিক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর ভবিষ্যতে রাশিয়া কী কখনো ইউক্রেনের সঙ্গে ভালো প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক প্রত্যাশা করতে পারে?

এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার ভাষ্য হচ্ছে, ন্যাটো তাদের দোরগোড়ার বেশি কাছাকাছি পৌঁছে গেছে এবং ইউক্রেনের এই সংস্থার সদস্যপদ লাভের ইচ্ছা তাদের (রাশিয়ার) জন্য এক ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। এই অবস্থানের স্বপক্ষে যুক্তি আছে।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর পূর্ব অভিমুখে ন্যাটোর সম্প্রসারণকে সহজ ভাষায় দায়িত্বজ্ঞানহীন বলা হলেও বাস্তবে এটি ছিল একটি উস্কানিমূলক আচরণ। হেনরি কিসিঞ্জারসহ অসংখ্য মার্কিন বৈদেশিক নীতি বিশেষজ্ঞ ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করার বিরুদ্ধে সতর্কবাণী দেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে বেপরোয়া আচরণ করেছে এবং ফ্রান্স, জার্মানি ও অন্যান্যরা এই বিপজ্জনক নীতির বিরোধিতা করার মতো শক্ত অবস্থানে ছিল না।

ন্যাটো সম্প্রসারণের বিষয়টি ছিল একটি বিপজ্জনক খেলা, যেটি যুক্তরাষ্ট্র খেলেছে। তবে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের মাধ্যমে যে খেলা শুরু করেছে, তা আরও বেশি বিপজ্জনক। পুরো বিশ্ব এখন এই ২ পরাশক্তির বেপরোয়া খেলার ক্রসফায়ারের মাঝে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী হচ্ছেন ইউক্রেনের জনগণ।

এ ছাড়া, যে বিষয়টিকে বাংলাদেশ এবং খুব সম্ভবত পৃথিবীর বাকি দেশগুলো আরও বেশি পরিমাণে নিন্দনীয় ও আপত্তিকর হিসেবে বিবেচনা করছে তা হলো, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকোভ গত মঙ্গলবার সিএনএনকে বলেন, 'দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে আমাদের একটি নীতিমালা আছে, যা সবার জন্য উন্মুক্ত। ঠিক কি কারণে ও পরিস্থিতিতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে, তা আপনারা পড়ে নিতে পারেন। সুতরাং, যদি আমাদের দেশের জন্য হুমকি তৈরি হয়, তবে আমাদের নীতিমালার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এর (পারমাণবিক অস্ত্র) ব্যবহার হতে পারে।'

এখান থেকে আমরা কী বুঝতে পারি? প্রতিটি দেশেরই নিজেদের সুরক্ষিত রাখার অধিকার রয়েছে এবং দেশগুলো এ ধরনের মারাত্মক অস্ত্র সমৃদ্ধ অস্ত্রাগার রক্ষণাবেক্ষণ করে শুধুমাত্র সেই ভয়ংকর দিনটির জন্য, যেদিন তাদের 'অস্তিত্ব' হুমকির মুখে পড়বে। কিন্তু এই মুহূর্তে রাশিয়ার অস্তিত্বকে কোন দেশ হুমকির মুখে ফেলছে? কেউ কি রাশিয়াকে আক্রমণ করেছে? একজন বিদেশি সেনাও কি রুশ সীমান্ত পেরিয়েছে? একটি বোমাও কি পড়েছে রুশ ভূমিতে? তাহলে কোন 'অস্তিত্বের হুমকির' কথা বলছেন পেসকোভ?

সব শান্তিকামী মানুষের মতো আমরা বাংলাদেশিরাও চাই, শিগগির ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বন্ধ হোক। এ ক্ষেত্রে আর কালক্ষেপণ না করে কার্যকর আলোচনা শুরু হওয়া উচিৎ। প্রেসিডেন্ট পুতিন তার হাতে থাকা সব তাস খেলে ফেলেছেন। তার হাতে যত ভালো তাস ছিল, সে তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ বাজি তিনি ইতোমধ্যে ধরে ফেলেছেন এবং অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় রাশিয়ার ভবিষ্যতকে অধিকতর বিপদগ্রস্ত করে তুলেছেন। সেটা কেবল নিরাপত্তার দিক থেকে নয়, বরং অর্থনৈতিক দিক দিয়েও। কেননা রাশিয়ার নিজেকে সুরক্ষিত রাখার মতো সক্ষমতা আছে। এখন যদি দেশটির চীনের মতো বিস্ময়কর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের কোনো স্বপ্ন থেকেও থাকে, তবে তা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

আমরা যখন দুঃখের সঙ্গে এই অনাবশ্যক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রথম মাস অবলোকন করছি, আমাদের আশঙ্কা, একটি ছোট ঘটনা থেকে আরেকটি ঘটনার সূত্রপাত হবে। শিগগির পরাশক্তিরা সেখান থেকে তথাকথিত 'না ফিরে আসতে পারার' পর্যায়ে পৌঁছে যাবে এবং নিজেদের মহিমান্বিত করার আত্মম্ভরি চিন্তাধারা তাদের যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রাখবে। সেক্ষেত্রে আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে প্রবেশ করব, যেখানে প্রতিটি পক্ষ নিজেদের কাজগুলোকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ঘটনা সৃষ্টি করবে এবং প্রকৃত সত্য থেকে আমাদের নজর সরে যাবে। আমরা যেন কখনোই এ বিষয়টি ভুলে না যাই যে, যেকোনো সংঘাতের প্রথম ভুক্তভোগী হচ্ছে সত্য। এই পারমাণবিক শক্তিমত্তার পৃথিবীতে সেই সত্য থেকে নজর সরে যাওয়া আমাদের সবাইকেই অতিমাত্রায় ভঙ্গুর করে তুলবে।

মিথ্যা অহংকার ও গর্ব আমাদের সবাইকে গ্রাস করার আগেই এই আগ্রাসন বন্ধ করুন।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Sheikh clan’s lust for duty-free cars

With an almost decimated opposition and farcical elections, a party nomination from the ruling Awami League was as good as a seat in the parliament.

6h ago