চিংড়ি চাষে হারিয়ে যাওয়া এক সুন্দরবনের গল্প

চকোরিয়া সুন্দরবন। ছবি: সংগৃহীত

সুন্দরবন শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ খুলনা অঞ্চলের সুন্দরবন। কিন্তু, এটা ছাড়াও একসময় কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মাতামুহুরি নদীর মোহনায় ছিল আরও একটি সুন্দরবন।

এরশাদ সরকারের ভুলনীতি, দখল-বেদখলে মাত্র ৩ দশকে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে চকরিয়া সুন্দরবন।

প্রায় ৪৫ হাজার একর আয়তনের চকরিয়া সুন্দরবনে ছিল বাঘ, অজগর, হনুমান, বনবিড়াল, বন্য শুকরসহ অসংখ্য প্রাণের সমাহার। এখন হাজার হাজার একরজুড়ে শুধু চিংড়ি আর লবণ চাষের দাপট। এর মধ্যে টিকে থাকা মাত্র কয়েকশ একর বনের অংশের দিকে লোভাতুর দৃষ্টি আছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের।

১৯০৩ সালে এটিকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। ১৯২৯ সালের দিকে ২৬০টি ভূমিহীন পরিবারকে প্রায় ৪ হাজার একর জমি বরাদ্দ দিয়ে স্থানান্তর করা হয় সুন্দরবনে। তবুও ৭০ দশক পর্যন্ত এ বন টিকে ছিল স্বমহিমায়।

১৯৮৫ সালের দিকে এরশাদ সরকার চিংড়ি চাষ নীতিমালা প্রণয়ন করলে সর্বনাশ শুরু হয় এ বনের। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, চিংড়ি চাষযোগ্য যে কোনো বনভূমি সরকার আগ্রহীদের লিজ দিতে পারবে। এর আলোকে বনের ১০ হাজার একর জমি লিজ দেওয়া হয় বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিকে।

মূলত তখন থেকেই শুরু হয় এ বন বিলুপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়া।

ছবি: সংগৃহীত

এ নীতিমালার সুযোগ নিয়ে সরকার চকরিয়া সুন্দরবনের ১০ হাজার একর জায়গা মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করে। পরে বনের বাকি অংশ চিংড়ি ঘের মালিক ও লবণ চাষিদের দখলে-বেদখলে চলে যায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের বিভাগের অধ্যাপক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চকরিয়া সুন্দরবন খুলনা অঞ্চলের সুন্দরবনের চেয়েও পুরনো। কিন্তু আমরা সেটিকে ধরে রাখতে পারলাম না।'

'চিংড়ি চাষের মাধ্যমে বনটির ধ্বংস শুরু' উল্লেখ করে তিনি বলেন, '১৯৮৫ সালে এরশাদ সরকার চিংড়ি চাষের নীতিমালা নিলে, এর মাধ্যমে মূলত বন ধ্বংস শুরু। এরপর লিজের নামে চিংড়ি চাষিদের দেওয়া হয় বনের জমি। বাকিগুলো গেছে দখল-বেদখলে,' যোগ করেন তিনি।

চকরিয়া উপজেলার পূর্ব বড় বেওলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চকরিয়া সুন্দরবন বিলীন হওয়াতে সামুদ্রিক জোয়ার এখন আমাদের ইউনিয়নের অনেক ভেতরে চলে আসে।'

তিনি আরও বলেন, 'এ বন আমাদের ঝড়-তুফান থেকে রক্ষা করত। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে ঘূর্ণিঝড়। বনটি থাকলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হতো।'

চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চকরিয়া সুন্দরবনে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বাঘ ছিল। হরিণ ছিল ১৯৮০ সাল পর্যন্ত।'

তার মতে, 'এরশাদ সরকারের আমলে চিংড়ি চাষযোগ্য বনভূমি লিজ দেওয়ার যে নীতিমালা নেওয়া হয়েছিল, তাতে ১০ হাজার একরের মতো চকরিয়া সুন্দরবনের জমি লিজ দেওয়া হয়। এরপরও নানাভাবে সে বনের জমি বেহাত হয়েছে।'

'চকরিয়ার প্যারা বনে চিংড়ি চাষের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সেটা বিজ্ঞানভিত্তিক ছিল না। এখন চিংড়ির উৎপাদন দেখলে সেটা বোঝা যায়।'

তিনি বলেন, 'এখনো এ বন ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বন বিভাগের সে জ্ঞান আছে। দরকার শুধু সদিচ্ছার।'

চকরিয়া উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. ফারহান তাজিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মৎস্য অফিস ৫৮৭টা প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। প্রতিটি প্লট ১০ একর, আর কিছু ১১ একর করে।'

তিনি বলেন, 'বেড়িবাঁধ ও স্লুইস গেইট ভেঙে যাওয়ার কারণে এখন আশানুরূপ চিংড়ির উৎপাদন হচ্ছে না। তবে এগুলো মেরামত করে নতুন প্রকল্প হাতে নিলে উৎপাদন বাড়বে।'

Comments

The Daily Star  | English

‘No room for politics under AL name, ideology’

Nahid Islam, adviser to the interim government, spoke with The Daily Star on the nation's key challenges and the way forward.

15h ago