বাংলাদেশে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কতটা?

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী একযোগে হামলা শুরু করে প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের দেওয়া তথ্য অনুসারে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের কোনো দেশে অন্য কোনো রাষ্ট্রের চালানো এটাই সবচেয়ে বড় হামলা।

ইউক্রেনের ২ অঞ্চলকে স্বাধীন ঘোষণা করে সেখানে রুশ সেনা পাঠানোর নির্দেশের পর থেকেই রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আসছে। এ ছাড়া রাশিয়াকে 'একঘরে' করার জন্য আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) থেকে বাদ দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অনেকগুলো প্রকল্পে কাজ করছে রাশিয়া। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য। যার ৮৫ শতাংশ তৈরি পোশাক। এ সময়ে রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য।

এখন ইউক্রেনে আগ্রাসনের জের ধরে পশ্চিমের দেশগুলো রাশিয়ার ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞার দিয়েছে, বাংলাদেশের ওপর তার সম্ভাব্য প্রভাবের বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সঙ্গে।

তারা বলছেন, বাংলাদেশের ওপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। অর্থনীতিতে এরইমধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এই যুদ্ধ যতই জোরদার ও দীর্ঘায়িত হবে, এর নেতিবাচক প্রভাব ততই বাড়বে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাবে ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকেও নানা সঙ্কটের মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ।

এই যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'আমাদের আমদানি কিংবা রপ্তানি কোনোটাই আর রাশিয়ার মাধ্যমে করা যাবে না বিকল্প ব্যবস্থা করতে না পারলে। এটাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আর রাশিয়ার প্রায়োরিটিতে তো আমরা নেই। আমরা ছোট দেশ। ওরা হয়তো চীনের সঙ্গে করবে, ভারতের সঙ্গে করবে। বড় বড় কিছু দেশ, যারা নিরপেক্ষ আছে তাদের সঙ্গে করবে। কীভাবে করবে সেটা জানি না।'

'কাজেই বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে কোনো ব্যাংকের পক্ষে এলসি খোলা নিরাপদ না। যেগুলো খোলা হয়েছে সেগুলো হয়তো সেটেলমেন্ট হবে না। যে পণ্য পাঠানো হয়েছে, সেটার টাকা হয়তো আর পাওয়া যাবে না। জাহাজ তো আর যাচ্ছে না। বড় কোম্পানিগুলো সব বয়কট করছে রাশিয়াকে। কাজেই রাশিয়ার সঙ্গে আগামীতে আর কোনো সম্পর্ক, বিশেষ করে ফাইন্যান্সিয়াল, গভর্নমেন্ট রিলেশনশিপ এগুলো রাখা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।'

এ ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রসঙ্গে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'পারমাণবিক বিদুৎকেন্দ্রেও আমার মনে হয় না যে রাশিয়ার পক্ষে ফান্ডিং করা সম্ভব হবে। তারাই তো ৯০ পারসেন্ট ফান্ডিং করছিল। রাশিয়া এই টাকা এখন কীভাবে দেবে?'

তার ভাষ্য, 'এই ডিম্যান্ডগুলোকে ডাইভার্ট করে দিতে হবে। কিছু মানুষের খুব ক্ষতি হবে। হয়তো ২৫ থেকে ৩০টা কোম্পানি, যারা অলরেডি অর্ডার প্লেস করে ফেলেছে, তাদের বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে।'

বৈশ্বিক পর্যায়ে ইতোমেধ্যে এই যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে মন্তব্য করে আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, 'বৈশ্বিক অভিঘাত তো আসে তেল, গ্যাস ও গম থেকে। এই ৩টা জায়গায় বৈশ্বিক বাজারের যে চেইনটা… সবকিছুতেই এর প্রভাব পড়ছে। মেটাল মার্কেটও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেলে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরেও তেলের দাম বেড়ে গেছে। এই ঘটনা বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভারসাম্যকে বিশালভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আগে থেকেই এটা ছিল। এখন এই ভারসাম্যহীনতা আরও বাড়বে।'

এ পর্যায়ে বাংলাদেশের ওপর এই যুদ্ধের সার্বিক প্রভাবের ব্যাপারে তিনি বলেন, 'যেহেতু সরকার এখনো তেলের দাম বাড়াচ্ছে না, জিনিসপত্রের দাম অ্যাবজর্ব করার চেষ্টা করছে, সেজন্য আমরা ফুল প্রাইস ইমপ্যাক্টটা বুঝতে পারছি না। ইন্টারন্যাশনালি ও ন্যাশনালি এর ইমপ্যাক্ট খারাপ হবে। এটা অবশ্যম্ভাবী।'

এ বিষয়ে সিপিডির খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'সেখানে (রাশিয়ায়) সুইফট বন্ধ হয়ে গেছে, রাশিয়ার সঙ্গে জাহাজ চলাচলও কমে এসেছে। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য এই মুহূর্তে দুরূহ হয়ে পড়েছে। রাশিয়াতে আমাদের মূল রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক, প্রায় ৮৫ শতাংশের মতো। সেগুলোর ক্ষেত্রে পেমেন্ট আটকে গেছে, নতুন করে অর্ডার নেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। একটা নেতিবাচক প্রভাব এখানে আমরা দেখতেই পাচ্ছি।'

আপাতত এই সমস্যা সমাধানে একটি বিকল্প উপায়ের কথা জানান এই গবেষক। বলেন, 'এর পরিপ্রেক্ষিতে যেটা করা যেতে পারে সেটা হলো, রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে সুইফট যে ব্যাংকগুলোকে নিষিদ্ধ করেছে এর বাইরে আরও অন্তত ২টি ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন এখনো অ্যালাউড আছে। সুতরাং ওই ব্যাংক ২টির মাধ্যমে হয়তো ব্যবসায়ীরা সীমিত আকারে লেনদেন করতে পারেন। যদিও নতুন ধরনের ব্যবসার ক্ষেত্রে এটা কঠিন'

'আমদানির ক্ষেত্রেও বিষয়টি তাই। মূল যে পণ্যগুলো, বিশেষ করে গম, সার, অন্যান্য পণ্য হয়তো বিকল্প কোনো ক্ষেত্র থেকে আমদানি করতে হবে। যদিও ব্যয় বেশি পড়বে। এর ফলে আমদানি ব্যয় বাড়বে, মূল্যের ক্ষেত্রেও এর একটা প্রতিক্রিয়া হবে। এটা এড়ানোর সুযোগ নেই। বৈশ্বিক এই পরিস্থিতির কারণে অন্যান্য দেশের মতোই এখানেও মূল্যের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া হবে।'

গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু রাশিয়া থেকে তেল নেওয়া বন্ধ করেছে, যুক্তরাজ্যও এটা করেছে, গ্যাস নেওয়াও বন্ধ করেছে। বোঝা যাচ্ছে যে, বৈশ্বিক পর্যায়ে অন্য দেশগুলোও রাশিয়ার সঙ্গে তেল ও গ্যাসের লেনদেন সীমিত করবে। এতে তেলের বাজারে যে অস্থিরতা তৈরি হবে, তাতে তেলের দাম আরও বৃদ্ধি পাবে। এটা আমাদের জন্য সবচেয়ে দুর্ভাবনার জায়গা।'

এ ছাড়া রাশিয়ার ওপর নানাবিধ নিষেধাজ্ঞার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের বিষয়ে তার পর্যবেক্ষণ হলো, 'এসব নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য যেহেতু রাশিয়ার অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দেওয়া, সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যও ভবিষ্যতে হয়তো সীমিত হয়ে যাবে। আর দুর্বল অর্থনীতির কারণে পণ্য চাহিদার ক্ষেত্রেও একটা প্রভাব পড়বে।'

'ফলে আগামী দিনগুলোর প্রেক্ষাপটে হয়তো রপ্তানির ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সময়ে যে বড় প্রবৃদ্ধি দেখছিলাম, সেটার ক্ষেত্রেও কিছুটা ভাটার টান আসতে পারে।'

এর পাশাপাশি যুদ্ধের কারণে ইউরোপ থেকে প্রত্যাশিত মাত্রায় ঋণ সহায়তা না পাওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, 'এই যুদ্ধের জন্য শরণার্থী চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে ইউরোপ। এ কারণে, ইউরোপের দেশগুলো যে ঋণ সহায়তা দিয়ে থাকে, সেগুলো হয়তো এই শরণার্থীদের পেছনেই ব্যয় হবে। সেটার কারণে হয়তো ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্ল্ডে অনেক দেশই আগামী বছরগুলোতে প্রত্যাশিত মাত্রায় ঋণ পাবে না।'

Comments

The Daily Star  | English
enforced disappearance in Bangladesh

Enforced disappearance: Anti-terror law abused most to frame victims

The fallen Sheikh Hasina government abused the Anti-Terrorism Act, 2009 the most to prosecute victims of enforced disappearance, found the commission investigating enforced disappearances.

9h ago