জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো

বৃষ্টিতে ভিজেই ওএমএসের ট্রাক থেকে পণ্য কেনার লম্বা সারি। ছবি: স্টার ফাইল ছবি

বিখ্যাত গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার ঠিক কোন প্রেক্ষিতে 'জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো' গানটি লিখেছিলেন জানি না। হয়তো চলচ্চিত্রের প্রয়োজনেই লিখেছিলেন। আমার এই ধারনার মূলে ছিল ছবিটির নাম, 'জন্ম থেকে জ্বলছি'।

প্রেক্ষাপট যাই হোক না কেন, ১৯৮৩ সালে মুক্তি পাওয়া ছবির এই গান যেন অনন্তকালের। জগতের সৃষ্টি থেকে শেষ পর্যন্ত এই গানের যে কথা তার আবেদন কমবে না, এ কথা হলফ করে বলাই যায়। আর এখানেই একজন গীতিকবির সার্থকতা। টুপি খোলা অভিনন্দন গাজী সাহেবকে।

যে সময়ে এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়, সে সময়ে মূলত দেশের নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মূল্যবোধকে মাথায় রেখেই চলচ্চিত্র নির্মিত হতো। তাই আমরা ছোটবেলায় দেখতাম, নায়ক-নায়িকার দুঃখে দর্শক চোখ মুছেন, আবার ভিলেনের শাস্তিতে মুখে হাসি ফোটান।

তারপরেও ছবি আর বাস্তবতায় তো ফারাক থাকেই। চলচ্চিত্র থেকে এবার আসি বাস্তবে। জ্বলে সব মানুষই। কেউ প্রেমের আগুনে, কেউ বিরহের অনলে, কেউবা আবার নিতান্তই প্রাণটা বাঁচাতে সংসারের চুলা জ্বালাতে জ্বলে।

ফেসবুক স্ক্রল করলে, পত্রিকার পাতা খুললে বা যদি একটু চলতি পথে টিসিবির ট্রাকের দিকে কোনো কারণে চোখ চলে যায়, তখন দেখবেন চোখটা পোড়ায়। আমার অন্তত পোড়ায়। পোড়াতে পোড়াতে একটা সময় ঘোলা হয়ে যায়। কারণ নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত—সবার জীবনের গল্প যে একটাই। জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো। সবাই আজ টিসিবির লাইনে।

টিসিবির লাইন কিন্তু মোটেই খারাপ কিছু না। কিন্তু সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য যে লাইন সেখানে গিয়ে তাদের অংশে ভাগ বসাতে হচ্ছে। মধ্যবিত্তরা সচেতনভাবেই ভাগ বসাচ্ছেন, তবে নিরুপায় হয়ে। তার ওপরে টাকা দিয়ে তেল-ডাল কেনার যে হাহাকার তা বেদনাদায়ক।

মধ্যবিত্ত মানেই একটু বেয়াড়া এবং একই সঙ্গে সামাজিক মূল্যবোধের ধারক ও বাহক। জান দিবে, তবুও মান দিবে না। না খেয়ে থাকবে তবুও মুখ ফুটে বলবে না, হাত পাতার তো প্রশ্নই ওঠে না। নুন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা, তবুও সিনা টানটান। কিন্তু কতক্ষণ?

বিখ্যাত কবি হেলাল হাফিজ তার প্রথম কবিতার বই 'যে জলে আগুন জ্বলে' বইয়ের 'যার যেখানে জায়গা' কবিতার একটা লাইন লিখেছিলেন। লাইনটা এমন, 'বেদম মাইরের মুখে কতক্ষণ পারবো দাঁড়াইতে'।

আসলেই তো, কতক্ষণ? উচ্চবিত্ত ছাড়া এবার সবাই এক লাইনে। ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সমাজের একটা শ্রেণী ছাড়া সবাই আজ এক লাইনে। লাইন ছাড়া কোনো গতি নেই। যেন প্রখ্যাত গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা ও পাগল মন খ্যাত শিল্পী দিলরুবা খানের গাওয়া 'রেল লাইন হবে সমান্তরাল' গানের মতোই।

জীবনটা এখন কোনোভাবে পার করতে পারলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। শখ-আহ্লাদ সব ছাপিয়ে আগে তো বাঁচি। এই যখন একটি রাষ্ট্রর অধিকাংশ নাগরিকের অবস্থা, তখন উন্নয়নশীল দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশ বা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির তথ্যগুলো যেন রূপকথার গল্পের মতো শোনায়। দেশ এগিয়ে গেলেও মানুষগুলো যেন পিছিয়ে যাচ্ছে।

দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া যেন জিডিপির পরিসংখ্যান, চোখ কপালে তোলা রিজার্ভ, উড়াল সেতু, মেট্রোরেল বা পাতাল রেলের মতো সব অর্জনকে ধ্বংস করে ছুটছে দূর্বার গতিতে। সব পরিসংখ্যানের পরীরা যেন ডানা মেলে পালাচ্ছে। সংখ্যাগুলো হয়ে উঠছে কাগজের কালি আর মানুষগুলো হয়ে উঠছে এক একটি সংখ্যা।

চারিদিকে যেন কোরাস শুনছি, 'জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো'। আর চোখে ভাসছে টিসিবির ট্রাকের পিছনে নারী-পুরুষের দীর্ঘ লাইন, তাদের বাড়ানো শীর্ণজীর্ণ ও রুগ্ন হাত।

মোহাম্মদ আল-মাসুম মোল্লা: সাংবাদিক

Comments