শেন ওয়ার্ন: 'ভুল' করে বেছে নেওয়া এক রোল মডেল

ছবি: সংগৃহীত

শেই ওয়ার্নকে নিয়ে আমার সমবয়সী অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে ফেলে আসা শৈশবের কথা বলছেন। ঠিকই আছে, কারণ আমরা যারা গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে বেড়ে উঠেছি, তারা ওয়ার্নের খেলা টিভিতে দেখতাম। ওয়ার্নের মৃত্যুতে কেউ কেউ বলছেন, যেন নিজের আপন কেউ মারা গেছেন। হাজার হাজার মাইল দূরের একজন স্বভাবসুলভ বেপরোয়া পাগলাটে অস্ট্রেলিয়ান, যার সঙ্গে কখনো দেখা হওয়ার বা কথা বলার কোনো সুযোগ ছিলো না, তিনি কী করে বাংলাদেশের কিছু ছেলেমেয়ের শৈশবের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন? কেন তার মৃত্যুতে এতটা মন খারাপ লাগছে?

সরাসরি মাঠে বসে ওয়ার্নের খেলা দেখার সুযোগ আমাদের ছিলো না। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় আয়োজিত মিনি বিশ্বকাপে ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটা মাঠে গিয়ে দেখেছিলাম। সে ম্যাচে শচীন টেন্ডুলকার সেঞ্চুরি করেছিলেন। ক্রিকইনফোতে গিয়ে স্কোরকার্ড চেক করে দেখলাম, ওয়ার্ন সে ম্যাচে খেলেননি। খেললেও যে বিশেষ কিছু করতে পারতেন, সেরকমটা মনে হয় না। কারণ, ভারতের বিরুদ্ধে ওয়ার্নের রেকর্ড বরাবরই সাধারণ। তবে টিভিতে অনেক খেলা দেখেছি ওয়ার্নের। যাদের (মার্ক ওয়াহ, সাঈদ আনোয়ার, অ্যালান ডোনাল্ড, ওয়াসিম আকরাম, রাহুল দ্রাবিড়, ব্রায়ান লারা) খেলা দেখে ক্রিকেটার হওয়ার সাধ জাগতো, তাদের মধ্যে ওয়ার্নও ছিলেন একজন।

ফাস্ট বোলার হতে চাইনি কোনোদিন। ব্যাটিং আর স্পিন বোলিং করার চেষ্টা করতাম। প্রথমে পাড়ার ক্রিকেটে টেপ টেনিস বল দিয়ে, পরে স্কুলের প্র্যাকটিসে ক্রিকেট বল দিয়ে। সাকলায়েন মুশতাক বা মুত্তিয়া মুরালিধরন তখনো সেভাবে পরিচিত নন। তাই স্পিনার বলতে তখন কেবল ওয়ার্নকেই চিনতাম। তাই তার দেখাদেখি লেগ স্পিনটাই করতে চাইতাম। এখন যেমন ইউটিউবে খোদ ওয়ার্নেরই অনেক ভিডিও টিউটোরিয়াল পাওয়া যায়, তখন তো সেরকম ছিলো না। সেসময় যাদের কোচ হিসেবে পেতাম, তাদের পক্ষেও লেগ স্পিন শেখানো সম্ভব ছিলো না। বাংলাদেশ তো ২২ বছর টেস্ট ক্রিকেট খেলেও একজন লেগ স্পিনার বের করতে পারলো না। আর আমি যখনকার কথা বলছি, তখন তো বাংলাদেশ ওয়ানডে ম্যাচই খেলে বছরে দু-চারটা। সুতরাং লেগ স্পিন কীভাবে করে, সেটা জানার উপায় ছিলো না বললেই চলে।

এমন পরিস্থিতিতে ওয়ার্ন কীভাবে বল করেন, টিভিতে দেখে সেটা আমার কিশোর মগজ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতাম। তারপর মাঠে গিয়ে চেষ্টা করতাম। কিছুই হতো না যদিও। লেগ স্পিনের গ্রিপ, অনামিকা বা 'থার্ড ফিংগার' দিয়ে বলটাকে ঘুরিয়ে দেওয়া, বল ছাড়ার সময় হাতের উল্টোপিঠটা বোলারের মুখের দিকে রাখা, এতসব কেউ যদি হাতেকলমে দেখিয়ে না দেন, তাহলে তো আর সবটুকু টিভিতে দেখে বোঝা সম্ভব না। না বুঝেই নানাভাবে চেষ্টা করেছি। যথারীতি কিছুই হয়নি। বেশিরভাগ বলই হয় শর্টপিচ হতো, নয়তো ফুলটস।

একজন লেগ স্পিনার বাঁ পায়ে ভর দিয়ে কোমরটা মোচড় দিয়ে ডান পা নাচের মুদ্রার মতো সামনে ঘুরিয়ে আনার সময় বলটা হাত থেকে ছোঁড়েন। এখানে কাঁধেরও বিরাট ভূমিকা আছে - বলের গতি এবং ফ্লাইট কেমন হবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে হয় কাঁধ থেকে। সবমিলিয়ে বেশ অনেকগুলো প্রক্রিয়া, যার সবগুলো ঠিক সময়ে ঠিকঠাক মতো হলেই কেবল বলটা ঠিক জায়গায় পিচ করানো সম্ভব। এই সবগুলো প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার ঘিলুটাকেও সমানতালে কাজ করাতে হয়। সব ব্যাটারকে যেমন একই লাইন-লেংথে বল করলে কাজ হবে না, তেমনি সব পিচেও একই লাইন-লেংথ কাজ করে না। কোনো ব্যাটারের জন্য বেশি স্পিন দরকার, কোনো ব্যাটারের জন্য কম। বল ছাড়ার সময় সেলাই বা সিমের অবস্থানের উপর নির্ভর করে বল কতটুকু ঘুরবে। এক্ষেত্রে ব্যাটারের 'মাইন্ড রিড' করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। সে সামনে এগিয়ে এসে খেলতে যাচ্ছে, নাকি ক্রিজের ভেতর থেকেই খেলছে, নাকি সুইপ করতে চাচ্ছে- এসবের ওপরেও বলের লাইন-লেংথ নির্ভর করে। সুতরাং, ব্যাটার ও উইকেটের চরিত্র বুঝে এই অ্যাডজাস্টমেন্টগুলো করতে পারাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। শেন ওয়ার্ন এই কাজগুলোতে একদম মাস্টার ছিলেন।

একবার স্কুলের এক ম্যাচে ১ ওভারে ৫টা ছক্কা খেয়ে আমি অবশেষে বুঝতে পারলাম যে, লেগ স্পিন করার চেষ্টা করতে থাকলে একসময় আমাকে আর কেউ বলই করতে দেবে না। সেটা বুঝেই লেগ স্পিনার হওয়ার চেষ্টা বাদ দিয়ে দিলাম। ততদিনে সাকলায়েন এবং মুরালি লাইমলাইটে চলে এসেছেন। অফস্পিন বল করে টপাটপ উইকেট তুলে নিচ্ছেন। তাই বাটিংয়ের পাশাপাশি হাজারগুণে সহজ শিল্প অফস্পিন ধরলাম।

ওয়ার্ন আসলে আমার জীবনের প্রথম রোল মডেল। সেই ছোটবেলাতে প্রচুর চার-ছক্কা খেয়ে বুঝেছিলাম যে, ওয়ার্ন যে কাজটা অনায়াসে করতো, সেটা আসলে অন্য কারও জন্য কত কঠিন। ফুলটস বা শর্টপিচ না করে ডানহাতি ব্যাটারের লেগ থেকে বলটা অফের দিকে টার্ন করানোর মতো বিষয়টিই এত কঠিন যে, সেটাও কখনো শিখতে পারিনি। আরও কত রকমের বল করতেন ওয়ার্ন - গুগলি, টপ স্পিন, ফ্লিপার, স্লাইডার। এক লেগ ব্রেকই শিখতে পারলাম না। বাকিগুলোর কথা তো তখন জানতামই না, করা তো দূরের কথা।

তারপর বছরের পর বছর ধরে ওয়ার্নকে টিভিতে দেখেছি অনেক জাদুকরি স্পেল করতে। মুগ্ধ হয়ে দেখেছি ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, ওয়েস্ট  ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ডের ব্যাটারদের রীতিমতো নাকানি-চুবানি খাওয়াতে। ফ্লিপারটা তো আমার কাছে এখনো রকেট সায়েন্স - তুড়ি মেরে লেগ স্পিন অন্য কোনো স্পিনারকে কখনো করতে দেখিনি। পেসারদের জুতার স্পাইকের আঘাতে পিচে যে খড়খড়ে রাফ তৈরি হয়, সেগুলোকে ব্যবহার করে বলকে ২ থেকে ৩ হাত ঘোরাতে সব বোলার পারেন না। ব্যাটারের স্বভাব বুঝে টোপ দিয়ে সামনে টেনে এনে স্টাম্পিং বা গুগলি-ফ্লিপারে এলবিডব্লিউ - ওয়ার্ন যেন এক দক্ষ ওয়ার ট্যাকটিশিয়ান। এতরকম বল করার স্কিল আর তার সঙ্গে ব্যাটারের মাইন্ড রিড করার ক্ষমতাসহ আরেকটি ওয়ার্ন পাওয়া মুশকিল। এমনকি তার ধারে কাছেও তো কেউ নেই। তাই এখন আর খুব একটা আফসোস হয়না লেগ স্পিনটা কখনো শিখতে পারিনি বলে। ভয়ানক কঠিন কাজ, সবাই পারে না।

আমার বাসায় একটা ক্রিকেট বল আছে। প্রায়ই সেটা হাতে নিয়ে ঘোরাই। বেশিরভাগ সময় আনমনে সেটা লেগ স্পিনারের মতো করে হাতের উল্টো দিক দিয়েই এবং তখনো অবচেতনে আসলে ওয়ার্নের কথাই ভাবি। ক্রিকেটটা শেষ পর্যন্ত আর সিরিয়াসলি খেলা হয়ে ওঠেনি আমার। পড়াশোনাকেই বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু ক্রিকেট দেখেছি প্রচুর। তারমধ্যে বোধহয় ওয়ার্নের খেলাটাই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখেছি এবং বুঝেছি যে 'ভুল' রোল মডেল বেছে নিয়েছিলাম! এখানে ওয়ার্ন ভুল নন, ভুল ছিলো আমার রোল মডেল বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত। যার সমস্ত দক্ষতার মাত্র ১ ভাগ অর্জন করতে পারাটাও পাহাড় ডিঙানোর মতো কঠিন, তাকে রোল মডেল হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে তো ভুলই বলতে হবে।

একসময় লেগস্পিন করার চেষ্টা বাদ দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু ওয়ার্নের বোলিংয়ের ব্যপারে মুগ্ধতা একবিন্দুও কমেনি। বরং তা বেড়েছে। কী দারুণ বোলার ছিলেন ওয়ার্ন, কী দারুণ একজন এন্টারটেইনার। ওয়ার্ন আমাকে চিনতেন না, কিন্তু আমি তো ওয়ার্নকে খুব ভালোভাবে চিনতাম। সেই ওয়ার্ন যখন মারা গেলেন, তাও মাত্র ৫২ বছর বয়সে; তখন তো এমনটাই মনে হবে যে, একদম আপন কেউ চলে গেলেন!

রাজীব ভৌমিক: কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ

Comments

The Daily Star  | English

Agri budget not enough to ensure food security: experts

The government has proposed a 3.55 percent rise in the budget allocation for agriculture, food, livestock and fisheries in the next fiscal year, setting aside Tk 39,620 crore..But agro-economists say the increase is far from sufficient to ensure the country’s long-term food security..<p

36m ago