রাজনৈতিক দুর্দশা বুঝতে সাংস্কৃতিক রাজনীতির তত্ত্বতালাশ জরুরি

চলছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে সংহতি প্রকাশনী থেকে এসেছে মোহাম্মদ আজমের 'সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও বাংলাদেশ'।  বইমেলা ও নিজের নতুন বই নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

দ্য ডেইলি স্টার: 'সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও বাংলাদেশ' বইতে কতগুলো প্রবন্ধ আছে, এই বইয়ের বিশেষত্ব কী?

মোহাম্মদ আজম: বইটিতে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজনীতির কয়েকটি প্রধান দিকের পর্যালোচনা রয়েছে। প্রথম পর্বে উনিশ-বিশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে তাত্ত্বিক পটভূমি ও বিস্তার। দ্বিতীয় পর্যায়ে কিছু টেক্সট বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, চেতন-অচেতন নির্মাণে ওই প্রশ্ন ও প্রসঙ্গগুলো কিভাবে কাজ করছে। তৃতীয় পর্বে আছে ২টি অনুষঙ্গ, যেগুলো কাজ করে সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী এলাকায়। বস্তুত, 'সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও বাংলাদেশ' বইটিতে সংস্কৃতিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তি হিসেবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

বইতে 'কৃতজ্ঞতাপত্র', 'সূচনাপত্র' এবং 'সহায়কপঞ্জি' বাদ দিলে মোট ১৬টি প্রবন্ধ আছে।

ডেইলি স্টার: প্রকাশিত বই নিয়ে ধারনা দেওয়া যায়?

মোহাম্মদ আজম: এ বইয়ের প্রথম ও প্রধান প্রস্তাব, বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি মূলত সাংস্কৃতিক রাজনীতিরই বিকট প্রকাশ। কথাটা শিথিল অর্থে যে কোনো রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে মাত্রাগত দিক থেকে এবং বিভাজনের রাজনীতিকে উৎসাহিত করার দিক থেকে বাংলাদেশে কথাটার আরও সুনির্দিষ্ট অর্থ তৈরি হয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দুর্দশা বুঝতে সাংস্কৃতিক রাজনীতির তত্ত্বতালাশ খুব জরুরি।

দ্বিতীয় প্রস্তাব, দ্বিধা-বিভক্ত সাংস্কৃতিক রাজনীতিকে পুঁজি করেই ২০১৪ এবং ২০১৯-এর সরকার বাস্তবায়িত হয়েছে। ভূ-রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন ব্যাকরণ এবং দুনিয়াজোড়া 'সন্ত্রাসবিরোধী অনন্ত যুদ্ধ' নিশ্চয়ই 'রাজনৈতিক' অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক। কিন্তু ওই উপাদানগুলো কার্যকর হয়ে বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের কাঠামোগত ধ্বংস ত্বরান্বিত করতে পেরেছে সাংস্কৃতিক রাজনীতির জল-অচল বৈপরীত্যকে কাজে লাগিয়েই।

এ প্রেক্ষাপটে আমাদের তৃতীয় প্রস্তাব, চিন্তা ও চর্চার এ দুই ধারায় যতটা জল-অচল দূরত্ব আছে বলে প্রচার করা হয় বা মনে হয়, আসলে তা নয়। আশির দশক থেকে গড়ে ওঠা চিন্তা ছাঁচে পরস্পর বিপরীতধর্মী নিশ্চয়তার মধ্যবর্তী ধূসর পরিসরটা  মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়েছে। এ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও রাজনীতির জন্য তা ভালো হয়নি। এ বইকে বলতে পারি, ওই ধূসর এলাকা অন্তত খানিকটা পুনরুদ্ধারের আয়োজন।

ডেইলি স্টার : বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই বের হওয়ার সংস্কৃতিকে কীভাবে দেখেন?

মোহাম্মদ আজম: এই সংস্কৃতি বিশেষভাবে ভালো কিংবা খারাপ নয়। তবে আমাদের এখানে অন্য সবকিছুর মতো এ ক্ষেত্রেও খারাপ অনেক কিছু ঘটে। তারমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রস্তুতি ছাড়া বই বের করা। লেখক-প্রকাশকদের মধ্যে এ উপলক্ষে একটা তাড়াহুড়ার ভাব দেখা যায়। এটা আমাদের সামগ্রিক পুস্তক-সংস্কৃতির গরিবির মধ্যে অধিকতর গরিবির কারণ হচ্ছে। সারা বছর বই প্রকাশের সংস্কৃতি জোরালো হলে এ ঘটনা খানিকটা এড়ানো যেত বলেই মনে হয়।

তবে আজকাল বেশ কিছু প্রকাশক প্রুফ রিডিং, সম্পাদনা ইত্যাদি জরুরি কাজে মনোযোগ দিয়েছেন। এ অবস্থার আরও উন্নয়ন দরকার।

ডেইলি স্টার : সাংস্কৃতিক রাজনীতি নিয়ে গবেষণা কম হয়েছে, তথাপি এই বই লিখতে কারো বই কী সামনে ছিল?

মোহাম্মদ আজম: সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের এখানে গবেষণা কম হয়েছে এমন নয়। তবে আমাদের প্রজন্মে এবং সময়ে যে ধরনের কাজ হচ্ছে, তার সঙ্গে আগের কাজের কিছু পার্থক্য আছে। সংস্কৃতিকে রাজনীতি ও অন্য গুরুত্বপূর্ণ বর্গের পঠন-পাঠনের জন্য ব্যবহারের কাজটা তুলনামূলক নতুন। সারা দুনিয়াতেই এ ধরনের পাঠের পরিমাণ বেড়েছে।

তার কারণ, প্রধানত নিউ লেফট ঘরানার চিন্তাচর্চার এক বিরাট প্রবাহ গত অনেক দশক ধরে আমরা প্রত্যক্ষ করছি। তার কিছু প্রভাব আমাদের এখানে পড়েছে। আমাদের আগের প্রজন্মগুলোর কয়েকজন লেখক, সংখ্যায় বেশি না হলেও, এ ধারায় উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। আর আমার কালে ও প্রজন্মে বহু লেখক এ ধারায় কিংবা কাছাকাছি ধারায় কাজ করছেন। ফলে আপনি বলতে পারেন, যুগের একটা প্রভাব এখানে আছে। যদিও ব্যক্তি-লেখকের ক্ষেত্রে তার প্রকাশ ও আগ্রহের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন।

ডেইলি স্টার : রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও জাতীয়তাবাদ নিয়ে আপনার চিন্তা, কতটা কার্যকরী হবে বলে মনে করেন?

মোহাম্মদ আজম: প্রথমত, আমার কাজের ধরন খানিকটা একাডেমিক, খানিকটা বুদ্ধিবৃত্তিক। রাজনীতির মূলধারা এ ধরনের কাজ দ্বারা প্রায় কখনোই সরাসরি প্রভাবিত হয় না। আমাদের এখানে এ ধরনের প্রভাবের মাত্রা অন্য দেশের তুলনায়ও অনেক কম।

এ ধরনের লেখালেখির প্রভাব আসলে পড়ে ভিন্ন দিক থেকে এবং ভিন্ন তরিকায়। এ ধরনের রচনা, যদি আমার বই বা লেখালেখি সে মাত্রায় পড়ে থাকে তাহলে, সাধারণত নতুন চিন্তকদের প্রভাবিত করে এবং সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের ভাষাকে প্রভাবিত করে। পাঠকরা চিন্তার নতুন এলাকার সন্ধান পান এবং কেউ কেউ নিজেদের ভাবনা ও কাজে তাকে আপন করে নেন। মূলধারার রাজনীতিতে প্রভাবটা পড়ে আসলে এর পরের ধাপে।

আমার লেখা সে ধরনের প্রভাব ফেলতে পারবে কি না, তাতো বলতে পারব না। কিন্তু আমি মনে করি, এ ধরনের চিন্তাভাবনা সমাজে আরও বেশি হারে হওয়া উচিত এবং এ ধারায় লেখালেখির পরিমাণও বাড়া উচিত। তাতে বৃহত্তর জনসমাজে চিন্তাটা জোরদার হবে

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

7h ago