চাকরিচ্যুত শরীফের বিরুদ্ধে ‘বহু অভিযোগ’ বললেন দুদক সচিব

সংবাদ সম্মেলনে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতির ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলন করেছেন দুদকের সচিব মাহবুব হোসেন। তিনি বলেছেন, 'কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে দুর্নীতি উদঘাটনের কারণে তাকে চাকরি থেকে অপসারণের কথা মোটেও সত্য নয়। দুদক প্রভাবিত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না।'

শরীফকে চাকরিচ্যুত করার পেছনে 'বহু অভিযোগ' থাকার কথা বলেন দুদক সচিব।

শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে কখনো আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ না থাকার পরও তাকে তড়িঘরি করে চাকরিচ্যুত করা হলো, যেখানে দুদক কর্মকর্তা এনামুল বাছিরের ঘুষ লেনদেনের অডিও প্রমাণ থাকার পরও ৫৪ (২) ধারা প্রয়োগ হয়নি—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে দুদক সচিব বলেন, 'প্রত্যেক দপ্তর বা অফিসের নিজস্ব বিধিমালা রয়েছে। কেউ বিধিমালা অনুসরণ করবেন না, প্রতি পদে পদে বিধি লঙ্ঘন করবেন, তাহলে কর্তৃপক্ষ কোন দিকে যাবে? এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে দুদকই ব্যবস্থা নিয়েছে।'

শরীফের পক্ষে সারা দেশে দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবস্থান নিয়েছেন, কর্মসূচি পালন করেছেন। কমিশনের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রশমনে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, জানতে চাইলে দুদক সচিব বলেন, 'যারা মানববন্ধন করেছেন তাদের কয়েকজন আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তাদেরকে আশ্বস্ত করেছি যে আমাদের দুদক আইন ও চাকরি বিধিমালা ২০০৮ অনুসারে আপনারা যদি ন্যায়সঙ্গতভাবে সততা রক্ষা করে কাজ করেন তাহলে কারো ভয়ের কিছু নেই। কারও বিরুদ্ধে ৫৪ (২) ধারা প্রয়োগ করা হবে না। দুদকের কর্মচারীরা শতভাগ আস্থার সঙ্গে কাজ করছেন এবং করবেন।'

শরীফের মতো আরও অন্যায়কারী কর্মকর্তা এই প্রতিষ্ঠানে আছে এবং তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে বলে দুদক চেয়ারম্যান যে কথা বলেছেন সে ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা সমন্বিতভাবে সবাইকে নিয়ে কাজ করব। এখানে আতঙ্কের কিছু নেই—ভয়ের কিছু নেই। যেকোনো প্রতিষ্ঠান চালাতে বিধি-বিধান মানতে হবে। এখানে কারও স্বাধীনতা ঘোষণা করা বা মনমতো কাজ করা কাম্য নয়। আমাদের শৃঙ্খলার ভেতরে কাজ করতে হবে।'

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করেন দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। এর পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে শরীফ উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, 'আমার চাকরিচ্যুতির পেছেনে একটি প্রভাবশালী চক্র কাজ করছে। ...ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন নয়, আমার কাজে দুদকের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে।'

বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে আজ দুদক তার বক্তব্য হাজির করল।

দুদক সচিব লিখিত বক্তব্যে বলেন, চাকরিবিধি না মানার কারণে শরীফের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তার কার্যকলাপ অন্য কর্মচারীদের শৃঙ্খলার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে নিরুৎসাহিত করতে পারে বলেই তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

দুদকের অবস্থান তুলে ধরে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছিল। একতরফা তথ্যের ভিত্তিতে প্রচারিত এসব খবরে যা বলা হচ্ছে তা প্রকৃত ঘটনার বিপরীত।

শরীফের বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে বলা হয়—শরীফ উদ্দিন কোন অনুসন্ধান বা তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া মাত্র দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত নির্দেশিকা অনুসরণ না করে নিজের খেয়ালখুশি মতো কাজ করতেন। অভিযোগের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নয়, এরকম বহু ব্যক্তিকে নোটিশের মাধ্যমে অথবা টেলিফোনের মাধ্যমে ডেকে এনে হয়রানি করতেন, যার প্রমাণ রয়েছে।

তিনি বলেন, অনুসন্ধান ও তদন্তের স্বার্থে কোন ব্যক্তির ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ করার ক্ষেত্রে শরীফ উদ্দিন কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করতেন না। 

এরকম একটি ঘটনা উচ্চ আদালতে গড়ানোর কথা উল্লেখ করে তাতে কমিশনের বিব্রত হওয়ার কথা জানান দুদক সচিব মাহবুব হোসেন।

তিনি বলেন, কক্সবাজারে এক সার্ভেয়ারের বাসা থেকে র‍্যাবের জব্দ করা টাকা শরীফ তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত না করে এক বছর চার মাস নিজের কাছে রেখেছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা অগ্রহণযোগ্য। একটি মামলায় শরীফ একজনকে চট্টগ্রামের অফিসে ডেকে এনে নির্মমভাবে প্রহার করেছেন। এই অভিযোগ দুদকের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। তার বিরুদ্ধে এ ধরনের বহু অভিযোগ আছে।

চট্টগ্রাম দুদক কার্যালয়ে শরীফের কর্মকাল তিন বছরের বেশি হওয়ায় আরও ২০ জন কর্মচারীর সঙ্গে তাকে বদলি করা হয়েছিল। ২০২১ সালের ১৬ জুন তাকে বদলি করা হলেও তিনি কমিশনের আদেশ অবজ্ঞা করে এক মাস পর পটুয়াখালীতে তার নতুন কর্মস্থলে যোগ দেন। লকডাউনের অজুহাত দেখিয়ে তিনি প্রায় তিন সপ্তাহ পর নতুন কর্মস্থলে সশরীরে উপস্থিত হন। তিনি তার পুরনো কর্মস্থলের নথিপত্র পত্রও প্রায় দুই মাস নিজের কাছে আটকে রেখেছিলেন।

কক্সবাজার জেলার জমি অধিগ্রহণ নিয়ে তিনি মামলায় তিনি যে তদন্ত প্রতিবেদন দেন তাতে দুদক বিধিমালার নির্দেশনা অনুসরণ করেননি। কে, কখন, কীভাবে কী অপরাধ করেছে এবং অপরাধের সঙ্গে আসামিদের দায় সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। আসামিদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ক্রিমিনাল চার্জ সমর্থনে সাক্ষ্য প্রমাণ সুস্পষ্ট করা হয়নি। যাদের অভিযোগের দায় হতে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে, তাদেরকে কেন অব্যাহতি প্রদান করা হবে তার ব্যাখ্যা প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়নি। এছাড়াও অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি ও দায়সারা গোছের প্রতিবেদনের কারণে কমিশন কর্তৃক তা বিবেচিত হয়নি বলে জানান দুদক সচিব।

উল্লেখ্য, শরীফ উদ্দিন প্রায় সাড়ে ৩ বছর দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। শরীফ তার মেয়াদকালে বিভিন্ন খাতে অনিয়মের খবর প্রকাশের জন্য আলোচিত হন। সে সময় তিনি ইসি কর্মকর্তা, কর্মচারী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ইয়াবা চোরাকারবারি, রোহিঙ্গা, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১ ডজনেরও বেশি মামলা করেন। এনআইডি সার্ভার ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি ভোটার করার অভিযোগে ২০২১ সালের জুনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) একজন পরিচালক, ৬ কর্মীসহ আরও ১০ জনের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করেছিলেন। এ মামলার পরপর ১৬ জুন তাকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়।

সর্বশেষ গত ৩০ জানুয়ারি প্রাণনাশের হুমকি পাওয়ার অভিযোগ এনে শরীফ উদ্দিন কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আইয়ুব খান চৌধুরীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের খুলশী থানায় সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেন।

এর পরই গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এর প্রতিবাদে শরীফের সহকর্মীরা গত বৃহস্পতিবার সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।

Comments

The Daily Star  | English

People will have to take to the streets for voting rights: Fakhrul

People will have to take to the streets like they did on August 5 to realise their voting rights, said BNP Secretary General Mirza Fakhrul Islam Alamgir today

52m ago