দুদকের ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ নয়, উজ্জ্বল করেছি: শরীফ উদ্দিন

তিনি একসময় আলোচিত হয়েছেন প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে। এখন আলোচিত চাকরিচুত্য হয়ে। বলছি দুদক কর্মকর্তা শরিফ উদ্দিনের কথা। তার কাজ ও চাকরিচ্যুতির বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনাকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, দুদক পরিচালকের বক্তব্য অনুযায়ী, আপনার কর্মকাণ্ডে দুদকের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। সেই কর্মকাণ্ডগুলো কী?

শরীফ উদ্দিন: ধন্যবাদ। আমিও স্যারের এ কথা শুনেছি যে, আমি দুদকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছি, যেগুলো অপ্রকাশযোগ্য। আমি কক্সবাজারের ল্যান্ড অ্যাকুইজিশনের (ভূমি অধিগ্রহণ) তদন্ত করেছি এবং ওই তদন্ত করতে গিয়ে যারা প্রকৃত ভূমি মালিক তাদের যে হয়রানি ও পদে পদে টাউট থেকে শুরু করে অন্যদের কমিশন দিতে হতো, আমি সেটা উদঘাটন করার চেষ্টা করেছি, অনেকখানি করেছি। ওই টাউটদের আমি প্রায় ৪০-৫০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করার, রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা করার, বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নিয়েছি।

দ্বিতীয়ত সরকারি গ্যাস সংযোগ। মূল্যবান এই প্রাকৃতিক জ্বালানি সম্পদ সেক্টরে যারা গ্যাস সংযোগ, গ্যাস চুরির সঙ্গে জড়িত, আমি সেই চক্রকে আইনের আওতায় আনার জন্য অনুসন্ধান-তদন্ত করেছি এবং গ্রেপ্তারও করেছি।

তৃতীয়ত রোহিঙ্গাদের এনআইডি-পাসপোর্ট। বাংলাদেশে প্রায় ২-৫ লাখ রোহিঙ্গা এনআইডি, পাসপোর্ট বা অন্যান্য কাগজপত্র পেয়েছে। এটা আমি প্রথম ধরেছি। তাদের বিরুদ্ধে ২০টি মামলা হয়েছে আমাদের কমিশন থেকে। বেশিরভাগ মামলার বাদী আমি। এই ২০টি মামলা সম্পূর্ণভাবে আমার অনুসন্ধানকৃত।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ক্যান্টিনে টেন্ডার সিন্ডিকেশন হচ্ছিল এক যুগ ধরে। আমি সেটা বন্ধ করেছি। আমি রিপোর্টের মাধ্যমে সত্য তুলে ধরেছি। এটা অথরিটির মাধ্যমে রিপোর্ট আকারে অলরেডি ঢাকায় আছে।

দুদকের কাজই তো দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। দুর্নীতির অনুসন্ধান ও ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব দুদক কর্তৃপক্ষই তো আমাকে দিয়েছে। আমি সেই দায়িত্ব পালন করেছি। দুর্নীতির অনুসন্ধান-তদন্ত-মামলা করলে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় কীভাবে, আমি তা জানি না। দুদকের সুনাম ও রাষ্ট্রের সুনাম বৃদ্ধির জন্য দুর্নীতিবাজদের অবৈধ-অপরাধলব্ধ সম্পদ জব্দ করার জন্য আমি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এতে যদি দুদকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়ে থাকে, তাহলে আমার কোনো জবাব নেই।

ডেইলি স্টার: এই কাজগুলো তো আপনি দীর্ঘদিন ধরে করেছেন। যে সময় অনুসন্ধান- তদন্ত-মামলা করছিলেন, তখন আপনার মানে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানতেন না?

শরীফ উদ্দিন: অবশ্যই ঊর্ধ্বতনরা জানতেন। আমি চট্টগ্রামে কর্মরত অবস্থায় আমার জুরিসডিকশন (আওতাধীন) এলাকা ছিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার। এখানে একজন ডেপুটি ডিরেক্টর (ডিডি) ও একজন ডিরেক্টর বসেন। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ১৬০ কিলোমিটার। এই দূরত্বে আমি অফিসিয়াল গাড়ি ব্যবহার করতাম, উনারা লজিস্টিক সাপোর্ট দিতেন, (সরকারি কোষাগার থেকে) টাকা দেওয়া হতো, প্রয়োজনীয় লোকবল দেওয়া হতো। এসব কিছু গোপনে ঊর্ধ্বতনদের না জানিয়ে করা যায়? এখন যদি বলেন তারা জানেন না, তারা কি কখনো লিখিত দিয়েছেন কমিশনকে যে শরীফের এই কাজগুলো এখতিয়ার বহির্ভূত। সেগুলো মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে ফলাওভাবে, আমি অফিসে রিমান্ডে এনেছি, রিমান্ডের জন্য কক্সবাজার যাচ্ছি অফিসের সেটআপ নিয়েই যাচ্ছি। বরং আমাকে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। না হলে চট্টগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে মামলাগুলো, মেডিকেল থেকে শুরু করে হাউজিং, গণপূর্ত এবং সিডিএর বড় বড় ফাইল, রোহিঙ্গা ফাইলসহ সব ফাইলে তো কমিশন কর্তৃক আমাকে এনডোর্স করা হয়েছে।

ডেইলি স্টার: একসময় আপনার কাজকে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ উৎসাহিত করেছেন। এখন এসে তারা কেন বলছেন যে, আপনি দুদকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন?

শরীফ উদ্দিন: স্যাররা কেন বলছেন, তা আমার বোধগম্য নয়।

ডেইলি স্টার: ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নে র মতো কাজ করছেন, দুদক কর্তৃপক্ষ লিখিত বা মৌখিকভাবে আপনাকে কখনো সতর্ক করেছিল?

শরীফ উদ্দিন: তারা তো সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন, প্রশংসা করেছেন। আমার কাজে দুদকের 'ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন' হচ্ছে, এমন কোনো কথা কেউ বলেননি। দুদক কর্মীদের এসিআরের একটা নীতিমালা আছে। আমাদের দুদক বিধির ৩৭ (২)-এ বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তার এসিআরে যদি বিরূপ মন্তব্য থাকে, তবে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হবে, সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। আমার জানা মতে, চট্টগ্রাম দুদক-২ এ যিনি ডিডি ছিলেন, তিনি আমার ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ এ ৩টি এসিআর দিয়েছেন এবং সবচেয়ে ভালো এসিআর দিয়েছেন।

২০২০ সালের এসিআর তিনি দিয়েছেন ১ বছর পর নীতিমালা ভায়োলেট করে ২০২১ সালের নভেম্বরের ৯ তারিখে। সব কর্মকর্তা দিয়েছেন ৩ মাসের মধ্যে। আমারটা দিয়েছেন ১১ মাস পর যখন আমার ডিপিসি (বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষা) চলছিল তখন। আমি লিখিত ও মৌখিক দুটোতেই পাস করেছি। তিনি আমার এসিআরে বিরূপ মন্তব্য লিখেছেন যে, আমি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করি, পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করি। কিন্তু তিনি কখনো কোনোদিনও আমাকে একটা শো-কজ করেননি। অন্যান্য কলিগদের কাছে আমাকে নিয়ে গর্ব করতেন যে, শরীফের জন্য চট্টগ্রামের দুদকের মানসম্মান বাড়ছে। সেই তিনিই কেন এসিআরে বিরূপ মন্তব্য লিখলেন, আমার বোধগম্য নয়। এমন এসিআর লেখার জন্য তাকে শো-কজ করা হয়েছে। কমিশন শো-কজ করেছে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের ১২ তারিখ।

ডেইলি স্টার: আপনার কী মনে হয়, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ কেন আসলো?

শরীফ উদ্দিন: আমি চট্টগ্রামে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কর্মরত ছিলাম। আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। রুটিন বদলি হিসেবে আমাকে পটুয়াখালী বদলি করা হয়, একইসঙ্গে ২১ জনকে। আমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ আসা শুরু হয়েছে পটুয়াখালী জয়েনের পর, ২০২১ সালের ১২ আগস্ট থেকে। সবগুলো অভিযোগ চট্টগ্রাম-২ কেন্দ্রিক। আর এ অভিযোগগুলো করেছেন আমার ওপর সংক্ষুব্ধরা। কী কারণে সংক্ষুব্ধ? তাদেরকে আমি গ্রেপ্তার করেছি, তাদের আমি রিমান্ডে নিয়েছি, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নিয়েছি। সে সব আসামিদের অভিযোগ আমাদের কমিশন সেলফ মোটিভেটেড হয়ে আমলে নিয়ে, অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই অভিযুক্ত করে আমাকে চাকরি থেকে রিমোভাল করে দিয়েছে। অথচ একটা অভিযোগও প্রমাণিত হয়নি।

ডেইলি স্টার: অভিযোগগুলোর সত্যতা আছে কিনা?

শরীফ উদ্দিন: না। প্রথমত স্রোতের অনুকূলে গা না ভাসানোর কারণে, তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো দিয়েছেন। তারা প্রথম অভিযোগ দিয়েছেন যে, আমি রিমান্ডে নির্যাতন করেছি। কিন্তু রিমান্ডের (নির্যাতন করার) পর উনি কোর্টে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারের সময় তিনি সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তির নাম বলেছেন। কোর্টে গিয়ে একবারও বলেননি যে, তাকে জোর করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে। তিনি জামিন পেয়েছেন আজ ১ বছর হলো। এই ১ বছরে তিনি জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেননি।

দ্বিতীয়ত, তাকে আমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে কোভিডকালীন প্রতিদিন রিমান্ডে নেওয়ার আগে-পরে হাসপাতালের ডাক্তারের সার্টিফিকেট নিয়েছি। ওই হাসপাতাল দুদক ভেরিফাই করেছে। তাকে কোনো ধরনের শারীরিক নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ডেইলি স্টার: দুদকের রিমান্ড কেমন হয়?

শরীফ উদ্দিন: আমাদের এত লজিস্টিক সাপোর্ট থাকে না। আমাদের নিজস্ব কোনো রিমান্ড সেল নাই। ঢাকায় থাকতে পারে। কক্সবাজার যখন আমার জুরিসডিকশন ছিল এবং আসামিরা বেশিরভাগ ছিল কক্সবাজারকেন্দ্রিক, তখন কক্সবাজারের আসামিকে চট্টগ্রাম অফিসে নিয়ে আসতাম। অফিসে বসে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করতাম। এখানে মারধরের প্রশ্ন আসছে কেন? অফিসে তো অনেক কলিগ থাকে, স্টাফ থাকে। অন্যান্য কর্মকর্তারা থাকেন। গুরুত্বপূর্ণ আসামি বা যাদের পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বা নিরাপত্তা সংকট থাকে, সে সব ক্ষেত্রে আমরা পুলিশের সহযোগিতা নেই। আমরা আসামিদের রাতে থানায় রাখি। আমাদের এখানে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। জিজ্ঞাসাবাদের সময় থানা থেকে নিয়ে আসি, আবার দিয়ে আসি।

ডেইলি স্টার: আপনি বিধি লঙ্ঘন করে কাজ করেছেন। হাইকোর্ট আপনাকে তিরস্কার করেছিল।

শরীফ উদ্দিন: বিষয়টা ব্যাখ্যা করা দরকার। দুর্নীতিবাজদের মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধলব্ধ অর্থ ফ্রিজ করার জন্য টাকা হল্ট করেছি, যেন টাকাটা উইথড্র করতে না পারে। তবে হ্যাঁ, এটা একটা প্রসিডিউরাল মিসটেক। নিয়মটা হচ্ছে, আগে আমার কমিশনে লেখা, কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে কোর্টের মাধ্যমে এটা ফ্রিজ করার নিয়ম। কিন্তু এই যে সময়টা, এই সময়ের মধ্যে সে তো ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ফেলবে। টাকা যাতে তুলতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করেছি। ওই টাকা তো ওই অ্যাকাউন্টেই আছে, ওই ব্যাংকেই আছে। আমি একটা অনুরোধপত্র দিয়েছি ব্যাংকে, আমি কোনো ব্যাংকে কোনো আদেশ দেই নাই। এখানে আমার ক্রিমিনাল ইনটেনশন আছে কিনা, সেটা দেখতে হবে। আমার এই কাজে তো কোনো ক্রিমিনাল ইনটেনশন ছিল না, এটা প্রমাণিত।

আর আমাদের এ ধরনের প্রক্রিয়ায় যেমন জেলার সোহেল রানা, ওসি প্রদীপদের সম্পদের অনুসন্ধান, কিন্তু আমরা আগে থেকে বিভিন্নভাবে করে ফেলি, কারণ এগুলো লেয়ারিং বা প্লেসমেন্ট হয়ে যায়। এর জন্য আমরা হল্ট করি। আমি কিন্তু কমিশন বরাবর লিখেছি ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। চট্টগ্রামে কর্মকালীন অনুমোদন পাইনি। আমি যাওয়ার প্রায় ৩ মাস পর ২০২১ সালের ১৬ আগস্ট এই টাকাটা ফ্রিজ করার পারমিশন দেওয়া হয়। কিন্তু এর মধ্যে টাকাটা সে উত্তোলন করে ফেলেছে। হাইকোর্টের রায় নিয়ে সে উত্তোলন করে ফেলছে। হাইকোর্ট আমাকে ডেকেছিলেন। আমার কাছে ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলেন। তখন আমি ব্যাখ্যা দিয়েছি। আদালত বলেছিলেন, আপনারা তো ১০ মিনিটের মধ্যে ফ্রিজ করে ফেলতে পারেন। আমি বলেছি যে মাননীয় আদালত, এটা কমিশনের প্রসিডিউরাল বিষয়। আমি বলতে পারব না।

আমাকে যখন ডাকা হয় ২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি, তখন হাইকোর্ট কিন্তু দুদককে সময় দিয়েছেন যে, আপনারা ফ্রিজ করেন। আমাদের ডিরেক্টর (লিগ্যাল) কমিশনকে কিন্তু লিখেছেন যে, এই টাকা যদি দ্রুত ফ্রিজ করা না হয়, তবে রায় আমাদের বিরুদ্ধে যাবে। তারপরও আমাদের বিভিন্ন প্রক্রিয়াগত কারণে সময় দেওয়া হয়েছে। কেন সময় দেওয়া হয়েছে, আমি জানি না। এখন দায়ভার তো শুধু আমার ওপর আসলো এবং আমি যে কাজটা করেছি, আমার ডিডিকে কিন্তু কপি দেওয়া আছে, আমার অথরিটিকে কপি দেওয়া আছে।

ডেইলি স্টার: ৯৪ লাখ টাকা জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখেছেন, এমন অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে। কেন জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলেন?

শরীফ উদ্দিন: নিজের কাছে রেখেছি মানে পকেটে বা বাসায় রেখেছি, বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি র‍্যাব ও ডিজিএফআই ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকা ২ জন সার্ভেয়ারের বাসা থেকে জব্দ করে এবং নগদ ৭ বস্তা আলামত জব্দ করেছে। সব ডিসি অফিসের আলামত। এই আলামতগুলো কেন ও কীভাবে তাদের কাছে গেল, এটা একটা প্রশ্ন। আমি ১৯ মার্চ এই টাকা চট্টগ্রাম অফিসে নিয়ে আসি আমার টিমসহ। আমাদের অফিসের ভল্টে রাখি। আপনারা জানেন দুদক থানার মতো। থানায় যেমন মালখানা থাকে, দুদক অফিসে তেমন মালখানা আছে। ওই টাকা আমাদের মালখানায় বা কাস্টডিতে বা ভল্টে রেখেছি। রাখার পর কোভিড চলে এলো।

কোভিড পরবর্তীতে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েছি এটা জানতে যে, এই টাকাটা জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া কী। তখন তারা আমাকে দুটি প্রসিডিউর জানালেন। শুনে আমার মনে হলো প্রসিডিউর খুবই জটিল। প্রথমে তারা বললেন, আমি একটা ট্রাংকে ভরে ভেতরে আলামতগুলো রেখে একটা লাল মুড়ি দিয়ে দেব। তারা সেটা সিলগালা করে রিসিভ করে আমাকে একটা চালান দেবে এই মর্মে যে, একটা ট্রাংক বুঝে পেলাম। আমি জানতে চাইলাম, ভেতরে যে আলামত আছে সেগুলো লিখবেন না? তারা বললেন, না এটা তাদের লেখার বিষয় না। আমি বললাম, এই মামলা তো ৮-১০ বছর ধরে ট্রায়াল হবে। তাও ট্রায়াল হবে কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষ যদি মামলা রুজু হয় বা চার্জশিটের অনুমোদন হয়। এই টাকাগুলো তো ততদিনে পাউডার হয়ে যাবে। তারা বললেন যে, কিছু করার নাই। তখন আমি আলামত নষ্ট করার ভয়ে জমা দেইনি, যেহেতু টাকার বিষয়।

আর দ্বিতীয় যে বিষয়টা বলেছে, কোর্টের অনুমোদন সাপেক্ষে এই টাকা মার্কেটে সার্কুলেট করতে পারেন। মার্কেটে সার্কুলেট করলে পরবর্তীতে টাকাটা পাবো কীভাবে? তারা বললেন, কোর্টে যখন ট্রায়াল শুরু হবে মামলার, তখন এই সমপরিমাণ অর্থ আমরা কোর্টে দিয়ে দেব। আমি বললাম, সমপরিমাণ অর্থ দিতে পারবেন, কিন্তু এই আলামতের অর্থ কি দিতে পারবেন? তারা বললেন, না সেটা তো সার্কুলেট হয়েই গেছে। তাই আমি ওইদিকেও যাইনি।

তৃতীয় আরেকটা বিষয়, এই টাকাটা ডিসি অফিসের টাকা। ডিসি অফিসের সার্ভেয়ারদের কাছ থেকে উদ্ধার করা। আমি যদি ট্রেজারিতে রাখি, ট্রেজারি তো ডিসি অফিসের শাখাই, আমি আমার আলামত তো ওই শাখায় রাখতে পারি না। এটা ক্রেডিবিলিটির, তদন্তের বিষয়।

চতুর্থত, দুদক আইন বিধি অর্থাৎ ফৌজদারি কার্যবিধিতে আইওর কাছে টাকা রাখা যাবে না, এ ধরনের কোনো বিধি সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই। যদি থেকে থাকে, দুদকের প্রত্যেক কর্মকর্তা আসামি হবেন। কারণ, আমার জানা মতে চট্টগ্রাম-২ থেকে শুরু করে সারা বাংলাদেশে সব কর্মকর্তার কাছে এই ধরনের তদন্তের, গ্রাফট কেসের টাকা থাকে এবং এখনও আছে। এটা তো আইও হিসেবে আমরা রাখতে পারি। রাখা যাবে না এটা তো বলা নেই।

সর্বোপরি আমি যখন ২০২১ সালের ৩০ জুন বদলি হয়ে চলে আসি, আমি আমার রিপোর্টে উল্লেখ করেছি যে এই টাকাটা আমাদের এই ভল্টে আছে বা আমার কাছে আছে। এটা দ্রুত আলামত ও চার্জশিটসহ কোর্টে পেশ করা দরকার। যখন আমাকে কমিশন নির্দেশ দিয়েছে, নথিপত্র হস্তান্তরের জন্য। ডিডি স্যারের কাছে চালানমূলে প্রত্যেকটা নোটসহ উল্লেখ করে আমি তার কাছে জমা দিয়ে এসেছি। এখানে আমি আত্মসাৎ করলাম কোথায়?

ডেইলি স্টার: দুদকের ভল্টে এভাবে টাকা রাখা কি প্রচলিত রীতি, নাকি আপনিই একমাত্র রেখেছেন?

শরীফ উদ্দিন: না। চট্টগ্রাম ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন অফিসের ৮ লাখ ৫ হাজার ৭৫০ টাকা ২০১৯ সালে ট্র্যাপ করা হয়েছিল। ওই টাকা আমাদের দুদক অফিসে ছিল। যতগুলো ট্র্যাপের টাকা, সবগুলো দুদক অফিসে ছিল এবং এখনও আছে।

ডেইলি স্টার: একজন প্রভাবশালীর কারণে দুদক আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে প্রচারণা আছে। আসলেই কী তাই?

শরীফ উদ্দিন: আমার চাকরিচ্যুতির নেপথ্যে কাজ করছে প্রভাবশালী একটি চক্র। এ ক্ষেত্রে আমি ৪টা মামলার বিষয় উল্লেখ করব। এসব আসামিদের দ্বারা মোটিভেটেড হয়ে আমার বিরুদ্ধে কমিশন অভিযোগ দাঁড় করিয়েছে। কক্সবাজারের ল্যান্ড অ্যাকুইজিশনের যারা আছেন মামলা সংশ্লিষ্ট, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাসের যারা আছেন, রোহিঙ্গা এনআইডি-পাসপোর্টের সঙ্গে যারা জড়িত, চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাতের সঙ্গে যারা জড়িত এবং যে চক্র ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আমাকে বাসায় এসে হুমকি দিয়েছে, ওই চক্রের কারণেই আমাকে চাকরি থেকে রিমোভাল করা হয়েছে।

ডেইলি স্টার: আপনাকে বাসায় এসে হুমকি দেওয়ার ঘটনায় পুলিশ বলছে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে মনে হয়নি যে হুমকি দেওয়া হয়েছে। আপনি কী বলবেন?

শরীফ উদ্দিন: সিসিটিভি ক্যামেরায় ভয়েস আসে না। আমি চট্টগ্রাম-২ এর কর্মকর্তা নই। আমি ৮ মাস আগে বদলি হয়ে গেছি। আমার ওখানে ভাড়া বাসা, ফ্যামিলি থাকে। তিনি তো বাসায় আমার কনসার্ন ছাড়া আসতে পারেন না। আমি তো কোনো তদন্তকারী কর্মকর্তাও না। তিনি কেন আমার বাসায় আসবেন, কেন থ্রেট করবেন? এটা আমি অভিযোগ করেছি। আমি সঙ্গে সঙ্গে কমিশনকে জানিয়ে জিডি করেছি এবং কমিশনের কাছে আবেদন করেছি। হুমকিতে কী বলেছে আমি তাও উল্লেখ করে দিয়েছি। এক সপ্তাহের মধ্যে চাকরি যাবে, এই হুমকির কথা উল্লেখ করেছি।

সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমি বাসার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তারা এসে আমাকে থ্রেট করল। তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ অনেক রাফ ছিল। আমার এখানে ৩ জন দারোয়ান ছিল, তাদের হুমকি দিয়েছে, গেট আটকে দিয়েছে। ২৫-৩০ জন লোক এসেছিল।

ডেইলি স্টার: আপনাকে চাকরিচুত্যের প্রক্রিয়াটা কী ছিল?

শরিফ উদ্দিন: আমাকে যে বিধি অনুযায়ী রিমোভাল করা হয়েছে সেটি হলো সার্ভিস রুলের ৫৪(২)। অপরাধমূলক অসদাচরণের জন্য এই ধারা। এই অপরাধের জন্য মামলা করা যাবে, কিন্তু চাকরিচ্যুত করা যাবে না। আমাদের দুদকের আইনের একটা ধারা আছে, কমিশন আইনের ৩১ ধারা। এতে বলা আছে সরল বিশ্বাসে কৃতকর্ম কোনো অপরাধ নয়। আমাকে এই ধারা দেওয়া হয়নি। আমাকে কট করে দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন আগে একজন ইউএনওকে ৪৩ লাখ টাকা আত্মসাতের জন্য ওএসডি করা হয়েছে এবং তার বেতন থেকে টাকা কর্তন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমিও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, তিনিও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। দুই জনের জন্য দুই রকম শাস্তি হতে পারে না। আর আমার তো কোনো মিসঅ্যাপ্রোপ্রিয়েশন নেই। 

আমি সংবিধানের আর্টিকেল ১৩৫ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। কমিশন এবং রাষ্ট্রের কাছে আবেদন করব, আমি মজলুম। আমাকে বাসায় এসে কর্মকালীন সময় যদি হুমকি দিয়ে ১ সপ্তাহের মধ্যে চাকরি খেতে পারে, আমার সঙ্গে আরও অনেক কিছু ঘটাতে পারবে। আমার দায়ের করা মামলাগুলো যদি আমি না থাকি, সুবিধা কাদের? আমাকে বাঁচান। আমাকে কাজ করার সুযোগ দিন। আমি দেশপ্রেম নিয়ে দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে যাবো।

ডেইলি স্টার: দুইদিন আগে আপনি ডেইলি স্টারকে গুমের আশঙ্কার কথা বলেছেন। কেন মনে করছেন গুম হতে পারেন?

শরীফ উদ্দিন: ২০২১ সালের ১৭ জুন যখন রোহিঙ্গাদের এনআইডি দেওয়া নিয়ে আমি মামলা করি তখন তারা ফেসবুকে বলেছে যে, আমাকে সাসপেন্ড করা হবে এবং কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করবে। আমি ফেসবুকের কাটিংসহ আমার অফিসকে দিয়েছি। যেদিন আমাকে রিমোভাল করা হয়েছে ১৬ ফেব্রুয়ারি, তার ২ ঘণ্টা আগে আমি আমার বিভিন্ন মাধ্যমে শুনতে পেরেছি যে আমি চাকরি থেকে রিমোভাল হচ্ছি এবং পটুয়াখালী থেকে আমাকে অ্যারেস্ট করা হবে, আমাকে লাল দালানের ভাত খাওয়াবে। এটা তো আমি শুনেছি।

ডেইলি স্টার: রিমোভালের আগে দুদকের কোনো পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা আপনার সঙ্গে কথা বলেছেন?

শরীফ উদ্দিন: জ্বি না। ৪টা ৪০ মিনিটে ডিডি স্যার আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, তুমি স্টেশন লিভ করো না। তোমার ব্যাপারে একটা ডিসিশন আসছে। তুমি দ্রুত চিঠিটা রিসিভ করো, রিসিভ করে ঢাকায় পাঠাও। আমি সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম মেইলে একটা চিঠি দিলো অপসারণের। আমি পড়ার আগেই আমাকে বলেছে যে ঢাকা থেকে বলেছে রিসিভ করতে। আমি দ্রুত রিসিভ করেছি এবং আমার যে আইডি কার্ড দ্রুত হ্যান্ডওভার করে আন্ডারটেকেন দিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে চলে আসলাম।

ডেইলি স্টার: এরপর কোনো কোনো কর্মকর্তা বা সরকারের কেউ যোগাযোগ করেছে?

শরীফ উদ্দিন: জ্বি না।

Comments

The Daily Star  | English

People will have to take to the streets for voting rights: Fakhrul

People will have to take to the streets like they did on August 5 to realise their voting rights, said BNP Secretary General Mirza Fakhrul Islam Alamgir today

33m ago