যে কারণে বাংলাদেশে ইমো এত জনপ্রিয়
বিশ্বজুড়ে ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং অ্যাপসের তালিকায় 'ইমো' বেশ নিচে অবস্থান করলেও বাংলাদেশ এটির সবচেয়ে বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে। সবশেষ ২০২১ সালে বাংলাদেশে মোট ডাউনলোড হওয়া অ্যাপগুলোর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ইমো। ইমো কেন বাংলাদেশে এতবেশি জনপ্রিয়, সে বিষয়টি নিয়ে থাকছে এই প্রতিবেদন।
২০২০ সালে ৩ কোটি ৭০ লাখ বার ইনস্টল করার মাধ্যমে বিশ্বে ইমোর শীর্ষ ব্যবহারকারীর দেশে পরিণত হয় বাংলাদেশ। সে বছর শুধু বাংলাদেশের ব্যবহারকারীরা ইমোর মাধ্যমে ৯৬ বিলিয়নের বেশি বার্তা পাঠায় ও ২৬ বিলিয়নের মতো অডিও-ভিডিও কল করে। এ ছাড়া ২০২১ সালে বাংলাদেশে মোট ডাউনলোড হওয়া অ্যাপগুলোর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ইমো।
সাম্প্রতিক সময়ে ইমো ব্যবহারকারীদের এক পরিসংখ্যানে দেখা দেখে বাংলাদেশে ইমোর ব্যবহারকারী রয়েছে ১৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ভারতে ৯ দশমিক ২৯ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সৌদি আরকে ৭ দশমিক ৬৩ শতাং, রাশিয়ায় ৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ ও বিশ্বের বাকি দেশগুলোতে ৫৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং ও অডিও-ভিডিও কলের পাশাপাশি এই অ্যাপের মাধ্যমে মিউজিক, ভিডিও ও পিডিএফসহ বেশ কিছু ফাইল শেয়ারও করা যায়।
যেভাবে শুরু
২০০৫ সালের দিকে লেবানিজ বংশোদ্ভূত দুই ভাই জর্জ ও রালফ হ্যারিকের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় জনপ্রিয় সফটওয়্যার ইমো। ওরাকলের প্রাক্তন কর্মী জর্জ পড়াশুনা করেছে ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানে এবং তার ভাই গুগলেরা সাবেক কর্মী রালফ ছিলেন একজন এমআইটি গ্রাজুয়েট। প্রযুক্তিপ্রেমী এই দুই ভাইয়ের পড়াশুনার বিষয় ছিল কম্পিউটার সায়েন্স। সিলিকন ভ্যালির চাকরি ছেড়ে দুই ভাই চ্যাট সার্ভিসের এই ওয়ান স্টপ সল্যুশন ইমো প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে ইমোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। বৈশ্বিকভাবে এই অ্যাপটি পরিচালনা করছে পেইজবাইটস ইনকরপোরেশন। বর্তমানে, প্লাটফর্মটির মাসিক ওয়েব ট্রাফিকের দিক থেকে সৌদি আরবের পরেই অবস্থান বাংলাদেশের। স্ন্যাপচ্যাট, ফেসবুক মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা উইচ্যাটের মতো অ্যাপগুলো বিশ্বজুড়ে দাপট দেখিয়ে বেড়ালেও ইমোর মতো তুলনামূলক কম জনপ্রিয় একটি প্লাটফর্ম বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যার পেছনের আছে প্লাটফর্মটির বেশ কিছু ফিচারের অবদান।
ইমোর যত সুবিধা-অসুবিধা
ইমোর কিছু নির্দিষ্ট সুবিধার কারণে বাংলাদেশসহ বেশকিছু দেশে এই প্লাটফর্মটি বেশ জনপ্রিয়তা তৈরি করেছে। যার মধ্যে একটি সুবিধা হচ্ছে ইমোর ইন্টারনেট সাশ্রয়ী ব্যবহার সুবিধা। ইমোতে মূলত বার্তাগুলো কমপ্রেসড হয়ে আসে, ফলে বার্তার আকার ছোট হয়ে যায় এবং ইন্টারনেট ডেটার ব্যবহার ও কমে আসে। আর এ কারণে একই পরিমাণ ইন্টারনেট ডেটা দিয়ে অন্যান্য প্লাটফর্মগুলোর তুলনায় ইমোতে অনেক বেশি বার্তা আদান-প্রদান কিংবা বেশি বেশি কল ও ফাইল শেয়ার করা যায়। ইমো ব্যবহারের ফলে বছরে বাংলাদেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের হাজার কোটি টাকা মূল্যের কয়েক কোটি গিগাবাইট ইন্টারনেট সাশ্রয় হয়।
বাংলাদেশে ইমো ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই প্রবাসীদের সঙ্গে জড়িতে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যগামী প্রবাসীদের পরিবার ও স্বজনদের মধ্যে এই অ্যাপ ব্যবহারের আধিক্য দেখা যায়। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে আছে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অধিকাংশ জনপ্রিয় অ্যাপগুলো ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-এশীয় দেশগুলোতে জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় ইমো। রিয়াদের বাংলাদেশি দূতাবাস সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সৌদি আরবে প্রায় ২২ লাখ ৮০ হাজার বাংলাদেশি কর্মরত আছে, যে দেশে ইমোর ওয়েব ট্রাফিক সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া প্লাটফর্মটিতে সহজ ব্যবহারের ইন্টারফেস, সহজে কন্টাক্ট অ্যাড করা, ফ্রি সাইনআপ, ১০ জিবি পর্যন্ত ডেটা শেয়ারিং সুবিধা, স্ট্রিমিং সুবিধা ও কন্টাক্ট তালিকায় থাকা সব ইমো ব্যবহারকারীদের তালিকা সহজে পাওয়ার সুবিধা ইমোকে বাংলাদেশে খুব বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছে।
সুবিধার পাশাপাশি ইমোর রয়েছে বেশকিছু অসুবিধাও। বর্তমান বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশের প্রায় ২০ কোটি ব্যবহারকারী ইমোতে যুক্ত থাকলেও প্লাটফর্মটির বিরুদ্ধে নিরাপত্তাজনিত সমস্যার অভিযোগ বহু পুরনো। এ ছাড়া, প্রাইভেসি সংকট, অনাকাঙ্ক্ষিত নোটিফিকেশন ও কন্টেন্ট, অপরিচিত মানুষের কাছে থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত বার্তা কিংবা কল এবং অত্যধিক বিজ্ঞাপনের ফলে ব্যবহারকারীদের মধ্যে ইমো নিয়ে নানান অসন্তোষও রয়েছে।
তবে, ব্যবহারকারীদের ডেটার সুরক্ষা দিতে ২০২১ সালে 'সিক্রেট চ্যাট' নামে একটি এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন ফিচার পরিচয় করিয়ে দেয় ইমো কর্তৃপক্ষ। এই ফিচারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোনো কন্টাক্টের সঙ্গে নিরাপদে যোগাযোগ করা যাবে। 'সিক্রেট চ্যাট'-এর বার্তাগুলোতে রয়েছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে যাওয়ার সক্ষমতা। চ্যাট থেকে বের হওয়া যাওয়া কিংবা চ্যাটিং পর্ব শেষ হলেই বার্তাগুলো নিজে থেকে মুছে যাবে এবং এই গোপন কনভার্সেশনের কোনো চিহ্ন বা ট্রেস থাকবে না।
এছাড়া, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশি গ্রাহকদের তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ফোন নাম্বার ভেরিফিকেশন সিস্টেম চালু করে ইমো। গ্রাহকদের অভিযোগ ও বেশ কিছু অসুবিধা কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশি গ্রাহকদের কাছে আরও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে প্লাটফর্মটি।
তথ্যসূত্র:
ইমো ডট আইএম, ফোর্বস ম্যাগাজিন' ক্রাঞ্চবেজ, স্ট্যাটিস্টা, দ্য ডেইলি স্টার ও ইউএনবি।
Comments